ঘরটি তার পছন্দ হয়েছে এবং বলতে গেলে পূর্বের ভাড়ার চাইতে কয়টি টাকা কম ভাড়াতেই পাওয়া গিয়েছে সত্যশরণের সুপারিশে।
কিরীটীর ঘরে কিরীটী একা। বাকী তিনটি ঘরে সত্যশরণকে নিয়ে মোট ছয়জন বোর্ডার আছেন। সত্যশরণকে বাদ দিয়ে বাকী পাঁচজনের মধ্যে দুইজন হরবিলাস ও শ্যামবাবু, উভয়েই প্রৌঢ় এবং সর্বাপেক্ষা পুরাতন বাসিন্দা এ বাড়ির। এবং বলতে গেলে তাঁরাই বাকী বোর্ডারদের জুটিয়ে দোতলাটাকে সেমি মেসে পরিণত করেছেন। দুজনেই মার্চেন্ট অফিসে কাজ করেন এবং প্রতি শনিবার অফিস থেকে আর বাসায় না ফিরে সোজা একেবারে দেশের বাড়িতে চলে যান। শনি ও রবিবারটা সেখানে কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে আর মেসে না গিয়ে সোজা একেবারে অফিস করতে চলে যান। এমনি করেই প্রতি শনি ও রবিবারটা দেশের বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে অফিস করেন ছাপোষা নিরীহ কেরানীর মত। এবং একেবারে ঘোরতর সংসারী ওঁরা দুইজন এক ঘরেই থাকেন।
আর তিনজনই অল্পবয়সী। জীবনবাবু একটা সিনেমার গেটকীপার। মাসে ত্রিশটি টাকা পান ও এক জায়গায় টিউশনি করেন। সুধাংশুবাবু, কোন একটি বিলাতী ঔষধের কোম্পানীর নন-মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ এবং রজতবাবু একটি নামকরা বিলাতী ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ভ্রাম্যমাণ দালাল। সত্যশরণ বাসাটা সেমি মেস বলেছিল, কারণ ওখানে কেবল থাকবারই ব্যবস্থা আছে। আহারের কোন ব্যবস্থাই নেই। দুটি ভৃত্য আছে, বলাই ও রতন, বাবুদের প্রয়োজনমত দিনের বা রাত্রের আহার্য সামনের ট্রামরাস্তার ঠিক ওপরেই অন্নপূর্ণা হোটেল থেকে নিয়ে আসা থেকে চা জলখাবার ও অন্যান্য যাবতীয় সর্বপ্রকার ফুট-ফরমাসই খেটে থাকে। বেশীর ভাগ সময় বেলা বোর্ডাররা অবশ্য যে যার হোটেলে গিয়েই আহারপর্বটা সেরে আসেন প্রত্যহ।
অন্নপূর্ণা হোটেলটির ব্যবস্থাও ভালই। দামেও সস্তা এবং সাধারণ ডাল ভাত তরকারি মাছের ঝোল এবং মধ্যে মধ্যে মাংসও পাওয়া যায়।
অন্নপূর্ণা হোটেলটি অনেক দিনকার। এবং তার সামনের অংশে ছোটখাটো একটা পার্টিশন তুলে ও গোটা দুতিন ভাঙা নড়বড়ে টেবিল ও চেয়ার বেঞ্চ পেতে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাও একটা আছে। অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁ।
অন্নপূর্ণা হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিক একজন ঢাকার লোক।
ভদ্রলোকের নাম ভূপতিচরাণু চাটুয্যে। সরু প্যাঁকাটির মত রোগা ডিগডিগে এবং কালো কালির মত গায়ের রং।
দাড়িগোঁফ কামানো, তেল-চকচকে ভাঙা তোবড়ানো একখানা মুখ। পানের রস ও দোক্তার মেছেতা পড়া ইদুরের মত ছোট ছোট দুপাটি দাঁত। গরুর মত দিবারাত্রই প্রায় সর্বদা মুখে পানের জাবর কাটছেন।
লোকটি কিন্তু ভারি অমায়িক ও মিশুকে প্রকৃতির। খদ্দেরের সুখ-দুঃখ সুবিধা-অসুবিধা বেশ বোঝেন। হৃদয় আছে লোকটার। এবং সেইজন্যই পাড়াতে হোটেল বনাম রেস্তোরাঁটি চলেও বেশ ভালই।
সত্যশরণদের মেসবাড়ি অর্থাৎ দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটার কাছেই নীচের বাঁধানো উঠানের মধ্যে পার্টিশন তুলে উপরের তলার অধিবাসীদের কলপায়খানার ব্যবস্থা হয়েছে। মোট কথা ওপরের তলার বাসিন্দাদের সঙ্গে নীচের তলার অর্থাৎ বাড়িওয়ালা ও তাঁর পরিবারবর্গের কোন সম্পর্কই নেই, যদি ওপরের ঘরের জানালা ও বারান্দা থেকে নীচের তলার পার্টিশনের অপর পার্শ্বের বাঁধানো উঠানের প্রায় সবটাই এবং ঘরের সামনেকার বারান্দার কিছুটা অংশ চোখে পড়ে।
নীচের তলায় থাকেন সবটাই নিয়ে বাড়ির মালিক কবিরাজ শ্রীশশিশেখর ভিষগরত্ন সপরিবারে। শান্ত নির্বিরোধী ভদ্রলোক শশিশেখর ভিষগরত্ন।
কালো আলকাতরার মত গাত্রবর্ণ। মেদবহুল থলথলে চেহারা। পিঠ ও বুকভর্তি ঘন কুঞ্চিত রোমচর্যে মনে হয় যেন একটি অতিকায় রোমশ ভাল্লক। বিশেষ করে যখন তিনি বাইরের ঘরের তক্তপোশের ওপরে বিস্তৃত মলিন ফরাসের ওপরে বসে থাকেন একটি থেলো হুঁকো হাতে নিয়ে।
দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মাথায় তৈলসিক্ত বাবরি চুল। কপালে আঁকা সর্বদাই একটি রক্তসিন্দরের বিপন্দ্রক। মুলোর মত সাদা ঝকঝুঁকে দন্তপাটি হাসতে গেলেই শুধু, যে বিকশিত হয়ে পড়ে তাই নয়, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত তাম্রকট সেবনে অভ্যস্ত কালচে বর্ণের মাড়িটিও যেন খিঁচিয়ে ওঠে। তাতেই হাসিটা বিশ্রী কুৎসিত দেখায় আরো। কুৎসিত সেই হাসি শশিশেখরের পর কালচে ওঠপ্রান্তে যেন লেগেই আছে। কথায় কথায়ই তিনি হাসেন সেই কুৎসিত হাসি। তবে সশব্দ নয়, নিঃশব্দ। এবং কথা বলেন অত্যন্ত কম। স্বল্পভাষী। শশিশেখরকে কেউ বড় একটা কথা বলতেই দেখে না। ভদ্রলোকের সংসারে স্ত্রী যাকে কখনো বড় একটা দেখাই যায় না এবং গলাও যার বড় একটা শোনাই যায় না, মুখের উপরে সর্বদাই দীর্ঘ একটি অবগুণ্ঠন টানা। বাড়ির বাইরেও বড় একটা তাকে দেখা যায় না।
এবং একটি ছেলে অনিলশেখর, বয়স বাইশ-তেইশ হবে। আর একটি মেয়ে অমলা, বয়স বছর উনিশ-কুড়ির বেশী হবে না।
কি চেহারায় বা গাত্রবর্ণে কবিরাজ মশায়ের সঙ্গে তার ছেলে ও মেয়ে অনিলশেখর বা অমলার যেন কোন সৌসাদৃশ্যই নেই।
অনিলশেখর ও অমলার রূপ যেন ঝলমল করে। যেমনই সুঠাম সুন্দর চেহারা তেমনই উজ্জল গৌর গাত্রবর্ণ।
সংসারে আরো একটি প্রাণী আছে। কবিরাজ মশাইয়ের দুরসম্পর্কীয় ভাগ্নে দ্বিজপদ।