কি বল তো?
বলছিলাম কি ঘরটা পাওয়া যাবে ঠিকই। বাড়ীওয়ালাও ভাড়াটে পেলেই ভাড়াও দেবেন। কিন্তু
কিন্তু কি? বল না ভাই কি বলতে চাও?
বলছিলাম ঐ ঘরটা সম্পর্কেই। ঘরে যিনি পূর্বে ছিলেন, মানে আমাদের অনিলবাবু, আজ থেকে ঠিক একমাস আগে হঠাৎ একদিন ভোরে তাঁকে মেসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, তারপর খুজতে খজতে মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ঠিক সামনে বড় লাল দোতলা বাড়িটার গাড়িবারান্দার নিচে। সংবাদপত্রেও অবশ্য ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়েছিল—পড়েছিলে কিনা জানি না।
সত্যশরণের কথায় কিরীটী চমকে ওঠে।
ঐ অঞ্চলের শেষ হত্যাকাণ্ডটির কথা মনের পাতায় সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে। অদ্ভুত যোগাযোগ তো! মনের কৌতুহল দমন করে কিরীটী শান্তকণ্ঠে বলে, তাতে আর হয়েছে কি!
না, তাই বলছিলাম আর কি। হাজার হলেও বন্ধুমানষ তুমি, সব কথা তোমাকে আগে থাকতে খুলে বলাই ভাল। আর ঠিক তার পাশের ঘরেই আমি থাকি কিনা।
বটে! তা ভদ্রলোক মানে সেই অনিলবাবুর সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই আলাপ-পরিচয় ছিল সত্য? কিরীটী এবারে পাল্টা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, তা একটু-আধটু ছিল বৈকি। পুলিশ অবশ্য সেজন্য আমাকে প্রশ্ন করে কম হয়রানি করেনি!
অনিলবাবু, তোমাদের ওখানে কতদিন ছিলেন?
তা প্রায় মাস দশেক তো হবেই। তাই তো বলছিলাম, শান্তশিষ্ট নিরীহ ভদ্রলোক, তিনি যে হঠাৎ ঐ ভাবে মারা যাবেন ভাবতেই পারিনি।
জীবন-মৃত্যুর কথা তো বলা যায় না সত্যশরণ। তাছাড়া কার জীবনে কখন কোন পথে যে কোন আকস্মিক ঘটনার আবির্ভাব ঘটে কেউ তো তা বলতে পারে না।
তা যা বলেছ ভাই!
তা ছাড়া হয়ত এমনও হতে পারে, তোমরা তার সম্পর্কে যতটুকু জানতে তার বাইরে এমন কোন ব্যাপার হয়ত তার জীবনে ছিল যেখানে তার ঐ আকস্মিক মৃত্যুর কোন যোগসূত্র ছিল।
কিরীটীর কথায় সত্যশরণ যেন হঠাৎ চমকে ওঠে, বলে আশ্চর্য! তুমি তুমি সেকথা জানলে কি করে কিরীটী?
কিরীটীও কম বিস্মিত হয়নি সত্যশরণ ঐভাবে হঠাৎ তার কথায় চমকে ওঠায়। নিছক কথার পিঠে কথা হিসাবেই কথাটা কিরীটী বলেছিল।
তাই পরক্ষণেই মৃদুকণ্ঠে বলে, এর মধ্যে আর জানাজানির কি আছে! এ তো অনুমান মাত্র। আর এমন কিছু অসম্ভবও নয়।
আমি অবশ্য পুলিসের কাছে বলিনি কিছুই। কারণ পুলিসের ব্যাপার তো জানই। তিলকে তাল করতে তারা সিদ্ধহস্ত। ওদের যত এড়িয়ে চলা যায় ততই বুদ্ধিমানের কাজ।
সত্যশরণের কথায় কিরীটী বেশ যেন একটু চাঞ্চল্য অনুভব করে এবং আরো একটু ঘেষে বসে প্রশ্ন করে, সত্যিই কোন interesting ব্যাপার কিছু ছিল নাকি তোমাদের সেই অনিলবাবুর জীবনে?
তেমন কিছু না অবশ্য। সত্যশরণ এবারে আমতা আমতা করে জবাব দেয়।
কিরীটী বুঝতে পারে, সত্যশরণ ঝোঁকের মুখে হঠাৎ কথাটা শুরু করে এখন কোন কারণে এড়িয়ে যেতে চাইছে তাকে।
কিরীটী তাই এবারে বন্ধুকে যেন একটু উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেই কণ্ঠে আরো ঘনিষ্ঠতার সুর ঢেলে বলে, আহা, বলই না। শোনাই যাক না। প্রেম-ট্রেম ঘটিত কিছু নাকি?
আশ্চর্য, সত্যি তাই! But how the devil you could guess!
আন্দাজে অন্ধকারে ঢিলটা নিক্ষেপ করলেও লক্ষ্যভেদ করেছে। কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়, আরে এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার? Young man-ওইটাই তো স্বাভাবিক!
সত্যিই তাই। অনিলবাবুর জীবনে সাত বছরের এক মধুর প্রেমকাহিনী ছিল।
বটে!
বাধা বা সংকোচ যতটুকু ছিল হঠাৎ সেটা একবার অপসারিত হয়ে বলে চললো।
বিনতা দেবীর সঙ্গে ছিল অনিলবাবুর ভালবাসা। অবস্থার উন্নতি না করা পর্যন্ত বিবাহ হবে না, তাই চলেছিল ওঁদের উভয়ের অপেক্ষার পালা। অনিলবাবু প্রায়ই বলতেন আমাকে, ছোট একটি নিজস্ব নিরালা গৃহকোণ, ব্যাকে কিছু টাকা ও শান্ত নিরূপদ্রব জীবন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ফাগুনে তাদের বিবাহের সব স্থিরও একপ্রকার হয়ে গিয়েছিল, সামনের বৈশাখেই শুভকাজটা সম্পন্ন করবেন তাঁরা। এবং অনিলবাবুর আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যুর দিন দুই আগেই ঐ আসন্ন উৎসবের কথা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনাও হয়েছিল।
অনিলবাবুর সেই পরিচিতা বিনতা দেবীর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি?
না। ফটোই দেখেছি কেবল, সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেনি।
উভয়ের আসা-যাওয়া ছিল না?
ছিল। তবে একতরফা অনিলবাবুই যেতেন দেখতাম মধ্যে মধ্যে বিনতা দেবীর ওখানে। বিনতা দেবীকে কখনো আসতে দেখিনি এখানে।
অনিলবাবুর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও আসেনি?
না। তবে তাঁর দাদা এসেছিলেন ভাগলপুর থেকে। মেসে অনিলবাবুর জিনিসপত্র যা ছিল নিয়ে যেতে।
বিনতা দেবী কলকাতাতেই কোন স্কুলে বুঝি শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন?
না। শুনেছি বাগনান গার্লস স্কুলের শিক্ষয়িত্ৰী তিনি।
ইতিমধ্যে গাড়ি শ্যামবাজারের কাছাকাছি এসে পড়ায় তখনকার মত আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তী স্টপেজে উভয়ে ট্রামগাড়ি থেকে অবতরণ করে।
২. ন্যায়রত্ন লেনে
অবশ্য ন্যায়রত্ন লেনে সত্যশরণের বর্ণিত নির্দিষ্ট বাসাটা ঠিক বাসা নয়, সেমি মেসবাড়ি, পূর্বেই সে কথা সত্যশরণ কিরীটীকে জানিয়েছিল।
বাড়িচা দোতলা; ওপরে ও নীচে চার ও তিন সর্বসমেত সাতটি ঘর। এবং বাড়িটা নাতিপ্রশস্ত গলির একপ্রকার শেষপ্রান্তে।
ওপরের তলার চারটি ঘরই মাঝারি আকারের। ছোটও নয় খুব, প্রশস্তও নয়। এবং চারটি ঘরের মধ্যে সর্বশেষ ঘরের আগের দক্ষিণখোলা ঘরটিই খালি ছিল। ঘরটা কিরীটীর পছন্দ হওয়ায় গৃহকর্তার সঙ্গে সত্যশরণই কিরীটীর হয়ে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে দিল এবং কিরীটী যথারীতি পরের দিনই দ্বিপ্রহরে এসে ঘরটি অধিকার করল।