এক রাত্রে সে গৃহ থেকে পালাল কবিরাজ চন্দ্রকান্তর সঙ্গে।
কবিরাজ সুরমাকে নিয়ে এসে একেবারে কলকাতায় উঠলেন কাশীর সমস্ত ব্যবসাপাট তুলে দিয়ে। কিন্তু যে আশায় সুরমা গৃহত্যাগ করলো সে আশা তার ফলবতী হল না।
জন্মমুহূর্তেই সন্তানটিকে সেই রাত্রেই চন্দ্রকান্ত যে কোথায় সরিয়ে দিল তার অজ্ঞাতে সুরমা তা জানতেও পারলে না আর।
বিবাহও হল না এবং সন্তানও সে পেল না। অথচ বন্দিনী হয়ে রইলো। সুরমা চন্দ্রকান্তর গৃহে তারই কূট চক্রান্তে।
সন্তানকে একদিন ফিরে পাবে, এই আশায় আশায় চন্দ্রকান্ত সুরমার গতিরোধ করে রাখল। শুধু তাই নয়, অতঃপর চন্দ্রকান্ত সুরমাকে দিয়েই তার ব্যবসা চালাতে লাগল। সুরমাকে টোপ ফেলে বড় বড় রুই-কাতলা গাঁথতে লাগল। সুরমা প্রথম প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছে, তার জবাবে চন্দ্রকান্ত বলেছে, আমার কথামত যদি না চল তো তোমার ছেলেকে একদিন হত্যা করে তোমার সামনে এনে ফেলে দেব।
চোখের জলের ভিতর দিয়েই সুরমা বলতে লাগলেন, সেই ভয়ে আমি সর্বদা সিটিয়ে থাকতাম কিরীটীবাবু। আর আমার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে যত কুৎসিত জঘন্য কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিত। শেষটায়, ওই চোরাই ব্যাপারে এলো একদিন সত্যেন।
সত্যেন!
হ্যাঁ। রজতবাবুর আসল নাম সত্যেন। ঘোমটার আড়ালে সে আমাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু আমি তাকে চিনেছিলাম। আর ওই সত্যেনের সাহায্যেই ওই চন্দ্রকান্ত, যাকে আপনারা শশিশেখর বলে জানেন, তার অন্য এক অংশীদার অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁর মালিক ভূপতি চাটুয্যের সাহায্যে অতর্কিতে একটা কালো ফিতের সাহায্যে পিছন থেকে ফাঁস লাগিয়ে চোরাই কারবারের ব্যাপারটা যার কাছে এতটুকু জানাজানি হয়ে যেত বা আমার ওপরে যারই লোভ পড়ত তাকে হত্যা করতো। এমনি করেই দিনের পর দিন চলছিল নারকীয় কাণ্ড, এমন সময় একদিন আমার দুর্ভাগ্য ছোড়দাও এর মধ্যে এসে পড়লেন ঘটনাচক্রে।
লজ্জায় মুখ ঢাকলেন সুরমা।
তারপর আবার বলতে লাগলেন, এদিকে শয়তান সত্যেন তখন চন্দ্রকান্তর মেয়ে অমলাকে ভুলিয়েছে। সত্যেনের মিষ্টি কথায় অমলা ভুললেও আমি তো জানি তার মানে, সত্যেনের আসল ও সত্যকারের পরিচয়। আমি সতর্ক করে দিলাম চন্দ্রকান্তকে। চন্দ্রকান্ত আমার মুখে সব কথা শুনে কি যেন কী ভেবে রজতকে গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দিল। তারপরই আমার হতভাগ্য ছোড়দাকে এক রাত্রে রেস্তোরাঁর মধ্যেই সেই ফিতের সাহায্যে ফাঁস দিয়ে হত্যা করলে ওরা। এবং রজতকে শেষ করার মতলব করলে। এদিকে ছোড়দার মৃত্যুতে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। দাদাকে চিঠি দিয়ে জানালাম তার মৃত্যুর কথা।
আমরা জানি সে চিঠির কথা। কিরীটী বলে।
জানেন?
হ্যাঁ। তারপর বলুন।
রজতকে তাড়াবার পর সে আসবে না জানতাম। তাই আমিই তাকে একটা চিঠি দিই চন্দ্রকান্তর পরামর্শমত—যে আমি নিজে টাকার বিনিময়ে ভুলিয়ে নিয়ে তার হাতে অমলাকে তুলে দেবো; এই আশ্বাস দিয়ে পার্ক সার্কাসের গার্ডেনের রজতের সঙ্গে ঝগড়ার পর তাকে ডেকে পাঠাই। এদিকে রজতের দ্বারা অনিষ্ট হতে পারে এই ভেবে চন্দ্রকান্তও ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার জন্য। আর সেই সঙ্গে আমারও ছিল প্রতিহিংসা। আমার আজকের এই চরম দুর্গতির জন্য তো সেই দায়ী। সে-ই তো আমাকে লোভে ফেলে এই চরম সর্বনাশের পথে একদা টেনে এনেছিল। তাই প্রতিজ্ঞা করলাম মনে মনে, যেতেই যদি হয় তাকে শেষ করে যাবো এবং এইবারই সর্বপ্রথম ও শেষবার চন্দ্রকান্তর দুষ্কৃতিতে তাকে সাহায্য করতে সর্বান্তঃকরণে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কাজ শেষ হয়েছে। আপনি কিরীটীবাবু এখানে এনে আমাকে বলেছিলেন, নিয়তি-চালিত হয়েই নাকি আপনাদের গাড়িতে এসে আমাকে উঠতে হয়েছে, কিন্তু তা নয়।
কি বলছেন আপনি সুরমা দেবী? বিকাশ প্রশ্ন করেন।
ঠিক তাই। স্বেচ্ছায় আমি আপনাদের গাড়িতে উঠেছি।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। আপনারা যে ট্যাক্সি করে আমাদের অনুসরণ করছেন সেটা আমি পূর্বাহ্নেই টের পেয়েছিলাম। আজ রাত্রে রজতকে শেষ করে পুলিশের কাছে এসে সব বলে দেবো পূর্ব হতে সেটা মনে মনে স্থির-সংকল্প হয়েই আমি প্রস্তুত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। কথাটা বলতে বলতে কিসের একটা পুরিয়া হঠাৎ সুরমা দেবী হাতের মুঠোর থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিলেন চোখের পলকে।
বাধা দেবেন না কিরীটীবাবু, আর। আমাকে যেতে দিন। সত্যই কলঙ্কিনী আমি।
আর কথা বলতে পারলেন না সুরমা দেবী।
শেষের কথাগুলো জড়িয়ে তাঁর অস্পষ্ট হয়ে গেল।
কিরীটী বললে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে, কিন্তু আর তো দেরি করা চলে না। আমাদের এখুনি যেতে হবে। নচেৎ পাখী উড়ে যেতে পারে।
সুরমার মৃতদেহ ঐখানেই পড়ে রইলো। ওরা থানা থেকে বের হয়ে গেল।
৭. থানা থেকে একজন
থানা থেকে একজন এ. এস. আই. ও জনাতিনেক কনস্টেবলকে অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় ভূপতিচরণকে গ্রেপ্তার করতে পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী ও বিকাশ নিজেরা গেল ন্যায়রত্ন লেনের বাসার দিকে সোজা।
রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ বিকাশ ও কিরীটী সাধারণ বেশেই এসে ভিষগরত্নের সদর দরজায় ধাক্কা দিল।
দ্বিপদ এসে দরজা খুলে দিল চোখ মুছতে মুছতে।
কবিরাজ মশাই আছেন?
হ্যাঁ—উপরে ঘুমোচ্ছেন।
যাও, তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো গে। বলল এক ভদ্রলোক বিশেষ জরুরী কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।