কিরীটীর শেষের কথায় সুরমা উপর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
হ্যাঁ, আপনি মুখ বুজে থাকলেও অবশ্যম্ভাবীকে আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না সুরমা দেবী। আমরা জাল যে মুহূর্তে গুটিয়ে আনবো সেই মুহূর্তেই আপনাদের দলের অন্যান্য সকলের সঙ্গে আপনাকেও তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আমি তা চাই না। আপনি যদি স্বেচ্ছায় সব স্বীকার করেন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সকলের মধ্যে টেনে এনে আপনাকে দাঁড়াবার লজ্জা ও অপমান হতে নিষ্কৃতি দেবো। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, এই বিশ্রী ব্যাপারের মধ্যে যতটুকু আপনি আপনার ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক জড়িত হয়ে পড়েছেন, সেটা হয়ত আপনাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই হতে হয়েছে। আরো একটা কথা আপনার জানা দরকার। আমীর আলি অ্যাভিনুর বাড়িতে আজ কিছুক্ষণ পূর্বে রজতবাবুর হত্যা-ব্যাপারটাও আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।
দ্বিতীয়বার চমকে সুরমা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কয়েকটি মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধতার মধ্যে দিয়েই কেটে গেল।
কিরীটী সুরমা দেবীর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল সোজাসুজি আক্রমণকে প্রতিরোধ করবার আর তাঁর ক্ষমতা নেই। কোন নারীই ঐ অবস্থায় নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না!
নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালেন সুরমা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে আবার। দুজনের চোখের টি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হল।
কিরীটী চোখে চোখ রেখেই প্রশ্ন করল, তাহলে কি ঠিক করলেন সুরমা দেবী?
সুরমা দেবী নিশ্চুপ।
বুঝতেই পারছেন আর চুপ করে থেকে কোন লাভ হবে না! মাঝ থেকে কেবল পুলিশের টানা-হেচড়াতে কেলেঙ্কারিই বাড়বে।
কি বলবো বলুন?
আপনার যা বলবার আছে—
আমার?
হ্যাঁ!
কয়েকটা মুহূর্ত আবার নিঃশব্দে মাথা নীচু করে বসে রইলেন সুরমা দেবী, তার পর মাথা তুলে ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, বলবো।
তবে বলুন।
হ্যাঁ বলবো, সব কথাই বলবো। নইলে তো আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।
বলতে বলতে সুরমা দেবীর দুচোখের কোল বেয়ে দুটি অশ্রুর ধারা নেমে এলো।
সুরমা দেবী বলতে লাগলেনঃ
আপনারা তো আমার পরিচয় জানতেই পেরেছেন। তাই পরিচয় দিয়ে মিথ্যা সময় আমি নষ্ট করতে চাই না। সব বলছি, পনের বছর বয়সের সময় আমার বিবাহ হয়। এবং বিবাহের ঠিক দশ দিন পরেই, দুর্ভাগ্য আমার, সর্পাঘাতে আমার স্বামীর মৃত্যু হয় তাঁর কর্মস্থল ময়ূরভঞ্জে। তিনি ছিলেন ফরেস্ট অফিসার। আমার স্বামীর একটি ছোট জাঠতুত ভাই ছিল সত্যেন। সত্যেন মধ্যে মধ্যে আসত আমাদের বাড়িতে। স্বামীকে চেনবার আগেই তাঁকে ভাগ্যদোষে হারিয়েছিলাম। আমার তখন ভরা যৌবন। সেই সময় সত্যেন এসে আমার সামনে দাঁড়াল। শ্বশুরবাড়ির দিক দিয়ে আমার বৃদ্ধ শাশুড়ী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাই বিধবা হবার পরও মধ্যে মধ্যে সেখানে আমায় যেতে হতো। এবং গিয়ে দুচার মাস সেখানে থাকতামও। ক্রমে সত্যেনের সঙ্গে হলো ঘনিষ্ঠতা। বলতে বলতে সুরমা দেবী চুপ করলেন।
সুরমা দেবীর জবানবন্দীতেই বলি।
সত্যেনের সঙ্গে সুরমার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতায় যা হবার তাই হল। সুরমা যখন নিজে বুঝতে পারল তার সর্বনাশের কথা, ব্যাকুল হয়ে উঠলো সে এবং লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে তখুনি সত্যেনকে একদিন ডেকে সব কথা খুলে বলতে একপ্রকার বাধ্য হল!
সত্যেন লোকটা ছিল কিন্তু আসলে একটা শয়তান। সে বললে, আরে তার জন্যে ভয়টা কি। সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
ব্যবস্থা! কিসের ব্যবস্থা?
কিসের আবার! গোলমাল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ভেবো না তুমি। তার জন্যে ভয়টা কি! সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সুরমা সত্যেনের কথায় রাজী হয় না। ইতস্তত করে বলে, দেখ একটা কাজ করলে হয় না?
কি?
আমি রাজী আছি। বিবাহটাই হয়ে যাক।
বিয়ে!
হ্যাঁ।
কেন, তুমি তো ক্ষেপেছো! বিয়ে করবো তোমাকে!
তার মানে?
ঠিক তাই।
কিন্তু এতদিন তো তুমি
পাগল না ক্ষেপা! ওসব বাজে চিন্তা ছেড়ে দাও সুরমা। আমার ব্যবস্থা তোমায় মেনে নিতেই হবে।
লোহার মত কঠিন ও ঋজু হয়ে এল সুরমার দেহটা মুহূর্তে। তীক্ষ্ণ গম্ভীর কণ্ঠে সে কেবল বলল, ঠিক আছে, তোমায় কিছু ভাবতে হবে না।
সুরমা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল।
শোন শোন সুরমা— সত্যেন ডেকে বাধা দেয় সুরমাকে।
সুরমা কেবল বললে, চলে যাও এখান থেকে।
পরের দিনই সুরমা চন্দননগরে দাদাদের ওখানে চলে এলো। মা ও অরবিন্দ সমস্ত ব্যাপারটাই জানতে পারল। কেবল জানতে পারল না আসল ব্যক্তিটি কে। সুরমা কিছুতেই প্রকাশ করল না।
বোন সুরমাকে নিয়ে তারা চলে এলো কাশীতে।
সেইখানেই একদিন কবিরাজ চন্দ্রকান্তর সঙ্গে আলাপ হয় অরবিন্দর।
চন্দ্রকান্তকে দিয়েই তারা কাঁটা তুলবার ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু চন্দ্রকান্ত সে-পথ দিয়েই গেলেন না। কাশীতে তিনি মুক্তাভস্ম নাম দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চোরাই কোকেনের কারবার চালাচ্ছিলেন। এবং ঐ সময়টায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠায় চন্দ্রকান্তও কাশীর ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র কোথাও সরে যাবার মতলব করছিলেন। তাঁর সংসারে ছিল আগের পক্ষের একটি ছেলে ও মেয়ে।
চন্দ্রকান্ত বললেন, শোন সুরমা, তুমি যদি রাজী থাকো আমি তোমাকে বিবাহ করতে রাজী আছি—কেন ও মহাপাপে মা হয়ে নিজেকে জড়াবে! ভ্রূণহত্যা মহাপাপ।
সুরমা প্রথমটায় কবিরাজের প্রস্তাবে বিহ্বল হয়ে যায়। চন্দ্রকান্ত তাকে বিবাহ করে সম্মান দেবে! পরে অনেক ভেবে রাজী হয়ে গেল সুরমা চন্দ্রকান্তরই প্রস্তাবে। কারণ সে নিজেও ওই কথাটা ভাবতে পারছিল না।