চমকে ওঠে কিরীটী। কারণ পুরুষটিকে না চিনলেও নারীটীকে চিনতে তার কষ্ট হয়নি দেখা মাত্রই। সেই ভদ্রমহিলা! যাকে মাত্র কয়েকদিন পূর্বে রাত্রে ভিষগরত্নের বাইরের ঘরে অনবগুণ্ঠিতা দেখেছিল সে।
কিন্তু ভদ্রমহিলাটির আজকের সাজসজ্জার ও সে-রাত্রের সাজসজ্জার মধ্যে ছিল অনেক তফাৎ। গা-ভর্তি জড়োয়া গহনা, পরিধানে দামী সিল্কের শাড়ি।
অপূর্ব রূপ খুলেছে দামী সিল্কের শাড়ি ও জড়োয়া গহনায়। চোখ যেন একেবারে ঝলসে যায়। আর পুরুষটির পরিধেয় সাজসজ্জা দেখলে মনে হয় ধনী কোন গুজরাট দেশীয় লোক। কিন্তু চিনতে পারল না চোখে কালো চশমা থাকায়। পুরুষটি হঠাৎ স্পষ্ট বাংলায় বলে, এসেছ?
আমার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে-চল
কিন্তু মাল?
মালও গাড়িতেই আছে।
বেশ, তবে চল।
কিন্তু টাকাটা?
ও হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলে গিয়েছিলাম একদম বলতে বলতে জামার পকেটে হাত চালিয়ে একতাড়া নোট বের করে মহিলার হাতে তুলে দিল পুরুষটি।
গুনতে হবে নাকি?
তোমার খুশি।
মহিলাটি মৃদু হেসে নোটগুলো এক এক করে সত্যই গুনে দেখল। সব একশো টাকার নোট। নোটগুলো গুনে ব্লাউজের মধ্যে চালান করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
চল—
আর একটু বসবে না?
একটু কেন-সারারাতই তো থাকবো সঙ্গে সঙ্গে। চল—ওঠ।
যুবকটি উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু মহিলাটি হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে, একটু বোস আসছি।
মহিলাটি ভিতরে চলে গেল। যুবকটি বসে আছে। হঠাৎ পা টিপে টিপে কে একজন কালো মুখোশে মুখ ঢেকে সোফার উপরে উপবিষ্ট যুবকের অজ্ঞাতেই তার পশ্চাতে এসে দাঁড়াল এবং সঙ্গে সঙ্গে দপ করে ঘরের আলো গেল নিভে।
কি হল! আলো নিভে গেল যে! বিকাশ চাপা কণ্ঠে বলেন।
চুপ! কিরীটী সাবধান করে দেয়।
অন্ধকারে একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ, একটা ঝটাপটি শোনা যাচ্ছে।
পরক্ষণেই কিরীটী আর দেরি না করে গিয়ে বন্ধ দরজার উপরে ধাক্কা দেয়।
দরজায় ধাক্কা দিতেই বুঝলে দরজা ভিতর হতে বন্ধ।
প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিতে দিতে একসময় মট করে শব্দ তুলে ভিতরের খিলটা বোধ হয় ভেঙে দরজা খুলে গেল।
দুজনে হড়মড় করে অন্ধকার বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করে। পাশের ঘরে ঢুকে অন্ধকারে হাতের টর্চের আলো ফেলতেই কিরীটী চমকে উঠলো।
মেঝের উপরে পূর্বদৃষ্ট তরুণ যুবকটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
ঘরের আলোর সুইচটা সন্ধান করে আলোটা জালানো হল। ভূপতিত যুবকটিকে তুলে ধরতে গিয়েই বোঝা গেল সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার চোখের চশমাজোড়া খুলে ফেলতেই কিরীটী চমকে ওঠে। অস্ফুট কণ্ঠে তার শব্দ বের হয় একটি মাত্র, এ কি! রজতবাবু! এবং মৃত্যু তার পূর্বপূর্বের মতই। গলায় সেই সরু কালো দাগ।
বিকাশ বললেন, চেনো নাকি লোকটাকে?
হ্যাঁ। রজতবাবু– আমাদের মেসেই ছিল!
কিন্তু সেই মহিলাটি গেলেন কোথায়?
চল, বাড়িটা খুঁজে একবার দেখি। যদিও মনে হচ্ছে পাওয়া যাবে না আর।
সত্যিই তাই। বাড়ির মধ্যে দোতলার ও একতলার সব ঘরগুলিতেই তালাবন্ধ। কোথাও মহিলাটির সন্ধান পাওয়া গেল না।
চল, ফিরি।
কিরীটী ও বিকাশ দ্রুতপদে নিজেদের ট্যাক্সিতে এসে উঠে বসতেই মনোহর ইঙ্গিত করে দেখাল ওধারে ফুটপাথে W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিরীটী ঠিক করলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।
বেশীক্ষণ কিন্তু অপেক্ষা করতে হল না। দেখা গেল দুটো বাড়ির পরের গলির ভিতর থেকে একজন চাদরে আবৃত মহিলা বের হয়ে সোজা তাদের ট্যাক্সির দিকেই এগিয়ে আসছে।
নেহাৎ হিসাবেরই ভুল বোধ হল কিরীটীর।
অন্ধকারে ভুল ট্যাক্সির খোলা দরজা-পথে ট্যাক্সির মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাটি ভুল বুঝতে পারলেও তখন আর ফিরবার পথ ছিল না। বিকাশের হাতে উদ্যত লোডেড পিস্তল।
কিন্তু মহিলাটি যেন নির্বিকার।
গোলমাল করে কোন লাভ হবে না। চুপটি করে বসে থাকুন। বলেই কিরীটী মনোহরকে নির্দেশ দিল সোজা থানার দিকে গাড়ি চালাতে।
ট্যাক্সিটা এসে থানার সামনে দাঁড়াতেই, সর্বাগ্রে কিরীটী বিকাশকে ডেকে চুপি চুপি কি কতকগুলো নির্দেশ দিয়ে ভদ্রমহিলাটিকে নিয়ে থানার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল! ভদ্রমহিলাটি এতক্ষণ গাড়িতে সারাটা পথ একটি কথাও বলেননি। ওরাও তাঁকে কোন কথা বলবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি। কিরীটীর চোখের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে সচল পাষাণমূর্তির মত ভদ্রমহিলা কিরীটীকে অনসরণ করে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী একটি চেয়ার দেখিয়ে বললে, বসুন। যদি ভুল না হয়ে থাকে তো মনে হচ্ছে আপনিই বোধ হয় বীজেন্দ্রবাবু ও নিহত অরবিন্দবাবুদের বোন সুরমা দেবী!
ভদ্রমহিলা কিরীটীর কথায় বারেক চমকে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বললেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি দাঁড়িয়েই রইলেন।
বসুন সুরমা দেবী!
ইতিমধ্যে বিকাশ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আর একটা চেয়ার টেনে বসলেন।
বসুন! আবার কিরীটী অনুরোধ জানাল।
এবং সুরমা দেবী এবারে একটা চেয়ারে উপবেশন করলেন।
বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়, নেহাৎ ভাগ্যচক্রেই আপনি আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে পড়েছেন! শুনেন সুরমা দেবী, আপনি হয়তো এখনো বুঝতে পারেননি যে আমরা আট-ঘাট বেধেই আপনাকে আজ সন্ধ্যার পর অনুসরণ করেছিলাম যখন আপনি ন্যায়রত্ন লেনের বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে চাপেন।