আজই প্রথম নয়। মধ্যে মধ্যে এরকম দ্বিপ্রহরে কিরীটীর চায়ের প্রয়োজন হয় এবং বখশিশের লোভে বংশীবদন দিয়েও যায় চা।
চার পয়সা চায়ের কাপের দামের উপর আরো তিন আনা উপরি লাভ হয় বংশীবদনের। পুরো একটা সিকিই দেয় কিরীটী।
যে আজ্ঞে। বলে রতন সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল।
মিনিট কুড়িক বাদেই বংশীবদন এক কাপ চা নিয়ে এসে কিরীটীর ঘরে প্রবেশ করল।
বাবু, চা
চা-পান করতে করতে কিরীটী বংশীবদনের সঙ্গে আলাপ চালাতে লাগল।
দুচারটা সাধারণ কথাবার্তার পর হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, এ পাড়ার ট্যাক্সি ড্রাইভার গঙ্গাপদকে চিনিস বংশী?
কোন গঙ্গাপদ? ঐ যে হদকো মোটা কেলে লোকটা?
হ্যাঁ।
খুব চিনি। ডেকে দেবো নাকি লোকটাকে? গাড়ি চাই বুঝি?
হ্যাঁ, তোর সঙ্গে আলাপ আছে নাকি?
না। তবে কত্তার সঙ্গে খুব ভাব। মাঝে মাঝে রাত্রে কত্তার ঘরে আসে যে!
কে, ভূপতিবাবুর সঙ্গে?
হ্যাঁ।
তোর কত্তার ঘরে রাত্রে আর কে কে আসে রে?
ঐ গঙ্গপদই আসে বেশী। আর কই কাউকে তো আসতে দেখিনি বড় একটা, তবে মাঝে মাঝে এই মেসের রজতবাবু যেতেন।
রজতবাবু, যেতেন!
হ্যাঁ।
ট্যাক্সি বুঝি গঙ্গাপদরই?
বাবু, শুনেছি কোন এক বাবুর। গঙ্গাপদ তো মাইনে-করা লোক।
খুব ভাড়া খাটে ট্যাক্সিটা, নারে?
ছাই! ভাড়া আর খাটে কোথায়? তবে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে সন্ধ্যারাত্রে চলে যায় ফেরে পরের দিন আবার সন্ধ্যায়!
ভাবছি কাল একবার ট্যাক্সিটা ভাড়া নেবো। পাঠিয়ে দিতে পারিস ওকে একবার?
কাল বোধ হয় ও যেতে পারবে না বাবু!
কেন?
কাল রাত্রে গঙ্গাপদ যে বলছিল, পরশু মানে কাল রাত্রে ভাড়ায় যাবে। ফিরবে পরদিন– সারা রাত ভাড়া খাটালে অনেক পায় কিনা।
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। একটা সিকি ও চায়ের কাপটা নিয়ে বংশীবদন চলে গেল।
পরের দিন রাত তখন সোয়া আটটা হবে। কিরীটী এক কাপ চা নিয়ে রেস্তোরাঁর দরজার ধারে একটা টেবিলের সামনে বসে স্থির দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা খোলা দরজা বরাবর রাস্তার ওধারে ফুটপাত ঘেষে লাইটপোস্টটার অল্প দূরে পার্ক করা আছে। এতদূর থেকেও আবছা অস্পষ্ট বোঝা যায় গাড়ির চালকের সীটে বসে আছে একজন ছায়ামূর্তি। কিরীটী অন্যমনস্কের মত চা-পান করলেও তার সদাজাগ্রত দৃষ্টি ছিল W. B. T. 307 ট্যাক্সিটার ওপরেই। বড় রাস্তার ঠিক মোড়েই সেই সন্ধ্যা থেকে আরো একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।
ক্ৰমে ক্ৰমে রাতের প্রহর গড়িয়ে চলে। একটি দুটি করে রেস্তোরাঁর খরিদ্দার চলে যেতে থাকে। রাত প্রায় দশটার সময় কিরীটী হঠাৎ যেন চমকে ওঠে।
আপাদমস্তক চাদরে আবৃত্ত একটি নারীমূর্তি এসে W. B. T. 307 ট্যাক্সি গাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই নিঃশব্দে ট্যাক্সির দরজাটা খুলে গেল।
নারীমূর্তি ট্যাক্সিতে উঠে বসল এবং উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করে।
কিরীটীও আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রেস্তোরাঁ থেকে উঠে সোজা গিয়ে দ্রুতপদে বড় রাস্তার মোড়ে যে দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা অপেক্ষা করছিল তার মধ্যে গিয়ে উঠলো।
বড় রাস্তায় পড়লেও W. B. T. 307 ট্যাক্সিটা ট্রামের জন্য আটক পড়ে তখনও বেশীদূর এগোতে পারেনি। কিরীটী ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করে। ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে ট্যাক্সিটা প্রস্তুত হয়েই ছিল পূর্ব হতে সঙ্কেতমত। কিরীটী চাপা গলায় ড্রাইভার মনোহর সিংকে কি যেন নির্দেশ দিল।
গ্রীষ্মের রাত্রি দশটায় কলকাতা শহর এখনো লোকজনের চলাচল ও যানবাহনের বৈচিত্র্যে সরগরম।
আগেকার গাড়িটা সোজা কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট ধরে এগিয়ে গিয়ে বৌবাজারের কাছাকাছি বাঁয়ে বাঁক নিয়ে শিয়ালদহের দিকে এগিয়ে চলল। শিয়ালদহের মোড়ে এসে ডাইনে বেকে এবারে চলল সারকুলার রোড ধরে সোজা। জোড়াগির্জা ছাড়িয়ে সারকুলার রোডের কবরখানা ছড়িয়ে বাঁয়ে বেকল।
আগের গাড়িটা চলেছে এবারে আমীর আলি অ্যাভিনু ধরে।
হঠাৎ একসময় আগের গাড়ির স্পীডটা কমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে মনোহরও তার পা-টা তুলে নেয় গাড়ির অ্যাকসিলারেটারের ওপর থেকে।
ট্রাম ডিপোটা ছাড়িয়ে বাঁ-হাতি একটা সরু গলির মুখে গাড়িটা দাড়াল।
গাড়ি থেকে পূর্ববর্তী সর্বাঙ্গে চাদরে আবৃত মহিলাটি নেমে গেলেন এবং ট্যাক্সিটাও সামনের দিকে চলে গেল। হাত-দশেক ব্যবধানে মনোহর তার ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছিল। বিকাশ প্রশ্ন করেন, ব্যাপার কি কিরীটীবাবু?
কিরীটী ট্যাক্সির দরজা খুলে নামতে নামতে বললে, নামুন-এবং মনোহরের দিকে ফিরে তাকে ও কনস্টেবলকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে চলল।
বিকাশ কিরীটীকে অনুসরণ করেন। সরু গলিপথ, গলির মুখে একটিমাত্র লাইটপোস্ট। গলির পথ জুড়ে অদ্ভুত একটা আলোছায়ার লুকোচুরি চলছে যেন।
কিন্তু গলির মুখে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না কিরীটী। তবু, কিন্তু কিরীটী গলির মধ্যে ঢুকে এগিয়ে চলে। ব্লাইণ্ড গলি। কিছুটা এগুতে শেষ হয়ে গিয়েছে। সামনেই নিরেট দেওয়াল। গলির দুপাশে দোতলা তিনতলা সব বাড়ি আলোছায়ায় যেন স্তুপ বেধে আছে।
সব কয়টি বাড়িরই দরজা বন্ধ। মাত্র একটি বাড়ির খোলা জানালাপথে খানিকটা আলোর আভাস লাগছে গলিপথে।
জানালাপথে উঁকি দিয়ে দেখল কিরীটী, সাহেবী কেতায় সোফা-সেট-কাউচে সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম। এবং সেই ড্রয়িংরুমের মধ্যে একটি সোফার উপরে পাশাপাশি বসে একটি তরুণবয়স্ক পুরুষ ও একটি নারী।