তারপর?
তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত –
কি রকম?
বৃহষ্পতিবার রাত্রের পর শেষ দেখা হয় অরবিন্দবাবুর সঙ্গে বীজেন্দ্রবাবুর শুক্রবার সকালে। তারপর আর দেখা হয়নি। এবং রবিবার সকালের ডাকে একখানা খামের চিঠি পান বীজেন্দ্রবাবু।
চিঠি! কার?
সুরমা দেবীর।
কি চিঠি?
এই দেখ সে চিঠি, বলতে বলতে বিকাশ চিঠিটা বের করে কিরীটীর হাতে দিলেন। খামের উপরে ডাকঘরের ছাপ আছে। শ্যামবাজার পোস্টঅফিসের ছাপ।
কিরীটী ছেড়া খাম থেকে ভাঁজকরা চিঠিটা টেনে বের করল। সংক্ষিপ্ত চিঠি।
শ্রীচরণেষু বড়দা,
ছোটদা মারা গিয়েছেন। তাঁর মৃতদেহ বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে পুলিস মর্গে চালান
দিয়েছে। সৎকারের ব্যবস্থা করবেন। ইতি
আপনাদের হতভাগিনী বোন সুরমা
একবার দুবার তিনবার কিরীটী চিঠিটা পড়ল।
সুরমা গৃহত্যাগিনী বোন মৃত অরবিন্দ দত্তের! কিন্তু সে অরবিন্দর মৃত্যু সংবাদ জানলে কি করে?
নিশ্চয়ই অকুস্থানে সুরমা উপস্থিত ছিল, না হয় তার জ্ঞাতেই সব ব্যাপারটা ঘটেছে। অন্যথায় সুরমার পক্ষে ঐ ঘটনা জানা তো কোনমতেই সম্ভবপর নয়। লাশ পাওয়া গিয়েছে শ্যামবাজারেই।
চিঠির ওপরে ডাকঘরের ছাপও শ্যামবাজারের। তবে কি পলাতকা সুরমা শ্যামবাজারেই কোথায়ও আত্মগোপন করে আছে!
কিরীটীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়ল বিকাশের প্রশ্নে, কি ভাবছ কিরীটী?
কিছু না। হুঁ, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট কি?
Throttle করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কিরীটী, বীজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পরে থেকে সমস্ত ব্যাপারটা যেন আরো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।
কিরীটী বলে, কিছু clue তো আমাদের হাতে এসেছে। এইবার তো মনে হচ্ছে আমরা তবু এগুবার পথ পেয়েছি।
কি বলছো তুমি কিরীটী?
আমি তোমাকে আরো একটা clue দিচ্ছি—এই অঞ্চলে একটা ডিসোটা ট্যাক্সি গাড়ি আছে। নম্বরটা তার W. B. T. 307। ট্যাক্সিটার ওপরে একটু নজর রাখ। হয়তো আরো এগিয়ে যেতে পারবে।
বিকাশ যেন বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান, কি বলছো তুমি! ট্যাক্সির ড্রাইভার গঙ্গাপদ যে আমার বেশ চেনা লোক হে? অনেকবার আমার প্রয়োজনে ভাড়ায় খেটেছে। তাছাড়া গঙ্গাপদ লোকটাও spotless, ওর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টই তো পাইনি।
কিন্তু সেইটাই বড় কথা নয় বিকাশ। মৃদু হেসে কিরীটী বলে।
কিন্তু, বিকাশ তবু ইতস্তত করতে থাকেন।
বললাম তো, প্রদীপের নীচেই বেশী অন্ধকার। যাহোক আজ উঠি–আবার দেখা হবে।
কিরীটী আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলো।
৬. কিরীটী বাসায় ফিরে এলো
কিরীটী বাসায় ফিরে এলো যখন রাত প্রায় নটা।
রজতবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে দেখে কিরীটী দাঁড়ালো দরজাগোড়ায়। রজতবাবু তা হলে ফিরেছেন! পরশু যে সেই দক্ষিণ কলকাতায় কাজ আছে বলে চলে গিয়েছিলেন, এ দুদিন আর ফেরেননি। রজতবাবুর গলা কানে এলো, বেশ ভালো করে বাঁধ –রাস্তায় যেন আবার খুলে না যায়।
রজতবাবুর ঘরের দরজাটা অর্ধেকটা প্রায় খোলাই ছিল। সেই খোলা দ্বারপথে উঁকি দিয়ে কিরীটী দেখল, রজতবাবু মেসের ভৃত্য রতনের সাহায্যে বাক্স-বিছানা সব বাঁধাছাঁদা করছেন।
ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল কিরীটী, কি ব্যাপার রজতবাবু বাঁধাছাঁদা করছেন সব?
হ্যাঁ মিঃ রায়, এ বাসা ছেড়ে আমি আজ চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছেন!
তা নয়ত কি? মশাই অপমান সহ্য করেও পড়ে থাকবো?
তা কোথায় যাচ্ছেন?
বালিগঞ্জে—একেবারে লেক অঞ্চলে। দোতলার ওপরে একটা চমৎকার ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে—ভাড়াটা অবশ্য কিছু বেশী। তা কি করা যাবে, এ হতচ্ছাড়া জায়গায় কোন ভদ্রলোক থাকে। যেমন বাড়ি তেমনি বাড়িওলা! বেটা অভদ্র ইতর
কবিরাজ মশাইয়ের ওপরে বড্ড চটে গিয়েছেন দেখছি
চটবো না! অভদ্র ইতর কোথাকার!
মেসের দ্বিতীয় ভৃত্যও এসে ঘরে প্রবেশ করল, ট্যাক্সি এসে গেছে, বাবু!
ট্যাক্সি গলির মধ্যে এনেছিস তো?
হ্যাঁ স্যার একেবারে দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছি। বলতে বলতে ভৃত্যের পশ্চাতে যে লোকটি ঘরে এসে প্রবেশ করল, কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত তার মুখের দিকে নিজের অজ্ঞাতেই তাকিয়ে থাকে।
বসন্ত-ক্ষতচিহ্নিত সেই গোলালো মুখ গঙ্গাপদর। W. B. T. 307-এর ড্রাইভার গঙ্গাপদ।
জিনিসপত্র কি কি যাবে? গঙ্গাপদ আবার প্রশ্ন করে।
বিশেষ কিছু নয়। এই যে দেখছো ঐ দুটো সুটকেসু ঐ বেডিংটা, ব্যাস!
অতঃপর ভৃত্যের সঙ্গে ধরাধরি করে গঙ্গাপদই মাল ট্যাক্সিতে নিয়ে গিয়ে তুলল।
রজতবাবুর ঘরটা খালি হয়ে গেল।
রাত দশটার সময় ঐ রাত্রেই সিঁড়িতে কবিরাজ মশায়ের খড়মের খটখট শব্দ ধ্বনিত হয়ে উঠলো।
কৌতুহল দমন করতে না পেরে কিরীটী বাইরে এসে দেখলে ভিষগরত্ন রজতবাবুর খালি ঘরটার দরজায় একটা তালা লাগাচ্ছেন। কিরীটীকে দেখে কবিরাজ মশাই বললেন, শুন্য ঘর থাকা ভাল নয় রায় মশাই। তাই তালাটা লাগিয়ে দিয়ে গেলাম। মূষিকের উপদ্রব হতে পারে।
আরো দিন দুই পরে। বেলা দ্বিপ্রহর। মেসের ভৃত্য বলাই আগেই চলে গিয়েছে, রতনও যাবার জন্য সিঁড়িতে নেমেছে, পিছন থেকে কিরীটীর ডাক শুনে রতন ফিরে দাঁড়াল।
রতন!
কি বলছেন? রতনের মুখে সুস্পষ্ট বিরক্তি। ভাবটা– যাবার সময় আবার পিছু ডাকা কেন!
যাবার পথে অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় বংশীবদনকে বলে যেও তো এক কাপ চা আমার ঘরে দিয়ে যেতে।