ফটিকের শেষের কয়েকটা কথা কিরীটী শুনতে পেল না, কে একজন খরিদ্দার চপের কিমার মধ্যে নাকি কাঠের গুঁড়ো পেয়েছে, সে চেচাচ্ছে, বলি ওহে বংশীবদন! আজকাল কিমার বদলে স্রেফ বাবা কাঠের গুঁড়ো চালাচ্ছ? ধর্মে সইবে না বাবা, ধর্মে সইবে না। উচ্ছন্নে যাবে।
ভূপতিচরণ হোটেলের মালিক হন্তদন্ত হয়ে প্রায় এগিয়ে এলেন, কি বলছেন স্যার! অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁর প্রেস্টিজ নষ্ট করবেন না!
খানিকটা গোলমাল ও হাসাহাসি চলে। হোটেলের সবেধন নীলমণি ওয়েটার বংশীবদন একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মত। ফটিক তখন বলছে, এক পসলা তার আগে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দিব্যি ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে দেখলাম পূর্বদিক থেকে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল–তারপর সেই গাড়ি থেকে একজন লোককে দেখলাম কি একটা ভারী মত জিনিস ধরে গাড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে রাখল। তবে শালা গাড়িটা যখন চলে যায় না তখন দেখছি গাড়িটা একটা ট্যাক্সি
বলিস কি ফটকে! ট্যাক্সি!
হ্যাঁ। আর এ পাড়ারই ট্যাক্সি।
মাইরি!
তবে আর বলছি কি! W. B. T. 307। গঙ্গাপদর সেই কালো রঙের চকচকে প্রকাণ্ড ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা
তারপর?
তারপর আর কিছু জানি না বাবা। কোথায় মাঝরাতে কে কি করছে না করছে জেনে লাভ কি! সোজা গিয়ে বিছানায় লম্বা। ঘুম ভাঙল আজ সকালে প্রায় আটটায়, তখন আমার বোন চিনুর কাছে শুনি আমাদের বাড়ির সামনে নাকি হৈ-হৈ কাণ্ড! সাত নম্বর বাড়ির করিডরের সামনে কাল একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে। পুলিস এসেছে—সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল গত রাত্রির কথা। তাড়াতাড়ি উঠে আগে শালা জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তবু, কি বেটারা রেহাই দেয়! ধাওয়া করেছিল আমার বাড়ি পর্যন্ত। বললে, সামনের বাড়িতে থাকেন, দেখেছেন নাকি কিছু? স্রেফ বলে দিলাম—মাল টানা অভ্যাস আছে মশাই। অত রাত্রে কি আর জ্ঞানগম্যি থাকে!
কথাটা শেষ করে শ্রীমান ফটিক বেশ রসিয়ে রসিয়ে আবার হাসতে লাগল।
কিরীটীরও মনে পড়ে ন্যায়রত্ন লেনের মোড়ে অনেক দিন ওর নজরে পড়েছে ঝকঝকে ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা। নম্বরটা যার W. B. T. 307।
ড্রাইভিং সীটে মোটা কালোমত যে লোকটাকে বসে বসে প্রায়ই ঝিমুতে দেখা যায়, তার বসন্তের ক্ষতচিহ্নিত গোলালো মুখখানাও কিরীটীর মানসনেত্রে উঁকি দিয়ে গেল ঐ সঙ্গে।
ডিসটো ট্যাক্সি গাড়ি, W. B. T. 307
গাড়ির কথাটা ও নম্বরটা বার বার কিরীটীর মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে।
এই পাড়ায় গত কয়েক মাস ধরে যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আজ পর্যন্ত চারচারটি রহস্যময় মৃত্যু কেবলমাত্র লাশের মধ্যে প্রমাণ রেখে গিয়েছে, ঐ W. B. T. 307 নম্বরের গাড়ির সঙ্গে কি তার কোন যোগাযোগ আছে?
পরের দিনও সন্ধ্যার পর কিরীটী আবার থানায় গেল।
বিকাশ একটা জরুরী কাজে যেন কোথায় বের হয়েছিলেন, একটু পরেই ফিরে এলেন।
কিরীটীকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, এই যে কিরীটী! কতক্ষণ?
এই কিছুক্ষণ। তারপর ময়না-তদন্ত হল?
বিকাশ বসতে বসতে বললেন, হ্যাঁ, ময়না-তদন্তও হয়েছে—লোকটার identityও পাওয়া গিয়েছে।
পাওয়া গিয়েছে নাকি?
হ্যাঁ। লোকটার নাম অরবিন্দ দত্ত। এককালে চন্দননগরের ঐ দত্তরা বেশ বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ ছিল। এখন অবিশ্যি পড়তি অবস্থা। তিন ভাই-বীজেন্দ্র, মহেন্দ্র, অরবিন্দ। ঐ মানে অরবিন্দই ছোট সবার।
হ্যাঁ, তা লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল ইত্যাদি কোনকিছু খোঁজখবর পেলে?
পেয়েছি, আর সেইখান থেকে মানে বীজেন্দ্রবাবুর ওখান থেকেই আসছি। বীজেন্দ্রবাবু আজ বছর দশেক হল আলাদা হয়ে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ হিসাবে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের বাড়িখানা নিয়ে বসবাস করছেন।
তা বীজেন্দ্রবাবুর সংবাদ পেলে কি করে?
সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার!
কি রকম?
সেও এক ইতিহাস হে! বলে বিকাশ বলতে শুরু করেন, বলেছি তো বীজেন্দ্রবাবুরা চন্দননগরের বাসিন্দা। বছর আষ্টেক আগে বীজেন্দ্রবাবুদের এক বিধবা বোন ছিলেন সুরমা। সেই বোন ও দুই ভাই মহেন্দ্র ও অরবিন্দ কাশী যান। কাশীতে দত্তদের একটা বাড়ি আছে বাঙালীটোলায়। তাঁরা গিয়েছিলেন মাস দুই কাশীতে থাকবেন বলেই। মধ্যে মধ্যে তাঁরা ঐভাবে এক মাস কাশীর বাড়িতে গিয়ে নাকি কাটাতেন। যা হোক সেবারে চার মাস পরে দুই ভাই তাঁদের স্ত্রী পুত্র নিয়ে যখন ফিরে এলেন সুরমা ফিরল না তাঁদের সঙ্গে। ফিরে এসে ওঁরা রটালেন সুরমা নাকি কাশীতে হঠাৎ দুদিনের জ্বরে মারা গিয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়—সুরমা মরেনি, গৃহত্যাগ করেছিল এক রাত্রে।
বীজেন্দ্রবাবু, বললেন নাকি ও-কথা?
হ্যাঁ, শোন– বললাম তো একটা গল্প! অরবিন্দ মধ্যে মধ্যে কলকাতায় এসে দাদার এখানে উঠতেন। দু-চার দিন থেকে আবার চলে যেতেন। শুকনো জমিদারীর কোনরূপ আয় না থাকলেও অরবিন্দবাবুর অবস্থাটা কিন্তু ইদানীং বছর আষ্টেক মন্দ যাচ্ছিল না। বরং বলতে গেলে বেশ একটু অর্থসচ্ছলতাই ছিল তাঁর। যাহোক যা বলছিলাম, এবারে অরবিন্দবাবু, গত শনিবার মানে প্রায় আটদিন আগে কলকাতায় আসেন চন্দননগর থেকে। এবং অন্যান্য বারের মত দাদার ওখানেই ওঠেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ রাত্রি দেড়টায় বাড়ি ফিরে দাদা বীজেন্দ্রবাবুকে ডেকে বলেন, সুরমার খোঁজ তিনি পেয়েছেন। এবং তখনই তিনি তাঁর দাদাকে সুরমা সম্পর্কে আট বছর আগেকার সত্য কাহিনী খুলে বলেন। বীজেন্দ্রবাবু এর আগে আসল রহস্যটা সুরমা সম্পর্কে জানতেন না।