কিরীটী হাসতে থাকে।
বিকাশ বলে, তুমি হাসছ রায়—
ব্যস্ত হয়ে তো কোন লাভ নেই। ব্যাপার যা বুঝছি, বেশ একটু জটিলই। সব কিছু গুছিয়ে আনতে একটু সময় নেবে। কিরীটী আশ্বাস দেয়।
বিকাশ কিরীটীর শেষের কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু বুঝতে পেরেছো নাকি?
না, মানে
দোহাই তোমার, যদি কিছু বুঝতে পেরে থাকে তো সোজাসুজি বল। আমি ভাই সত্যিই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তাড়াহুঁড়োর ব্যাপার তো নয় ভাই এটা। খুব ধীরে ধীরে এগুতে হবে।
তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে কিরীটী বিকাশকে, হ্যাঁ ভাল কথা মৃতদেহের identification হয়েছে?
না, কই আর হলো! এখন পর্যন্ত কোন খোঁজই পড়েনি।
মৃতদেহ তো মর্গেই এখনো আছে তাহলে?
হ্যাঁ। কাল পোস্টমর্টেম হবে।
মৃতদেহের আশেপাশে বা মৃতদেহে এমন কিছু নজরে পড়েছে তোমার suspicion হওয়ার মত, বা কোন clue?
না, তেমন কিছু নয়—তবে কাল শেষরাত্রে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে সেই বাড়ির ব্যালকনির ধার ঘেষে গাড়ির টায়ারের দাগ পাওয়া গিয়েছিল রাস্তায়।
আর কিছু? মানে মৃতদেহের জামার পকেটে কোন কাগজপত্র বা কোন রকমের ডকুমেন্ট বা
না।
মর্গে গিয়ে একবার মৃতদেহটা দেখে আসা যেতে পারে?
তা আর যাবে না কেন!
আজ এখনি?
এখুনি!
হ্যাঁ।
বিকাশবাবু কি একটু ভেবে বললেন, বেশ চল।
দুজনে থানা থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ময়নাঘরে এলেন।
ময়নাঘরের ইনচার্জ ডোমটা ময়নাঘরের সামনেই একটা খাটিয়া পেতে শুয়ে ছিল। ইউনিফর্ম পরিহিত বিকাশকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল।
আজ সকালে শ্যামবাজার থেকে যে লাশটা এসেছে সেটা দেখবো, ভিতরে চল।
কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে ডোমটা দরজা খুলতেই একটা উগ্র ফর্মালীন ও অনেকদিনের মাংসপচা চামসে মিশ্রিত গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঝাপটা দিল।
হলঘরটা পার হয়ে দুজনে ডোমের পিছনে পিছনে এসে ঠাণ্ডাঘরে প্রবেশ করল।
একটা স্ট্রেচারের উপরে সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহটা মেঝেতেই পড়েছিল।
ডোমটা চাদরটা সরিয়ে দিল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক।
মুখটা যেন কালচে মেরে গিয়েছে। নিখুতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো। ডান গালের উপরে একটা মটরের মত কালো আঁচিল।
পরিধানে ফিনফিনে আন্দির পাঞ্জাবি ও সরু কালোপাড় মিহি মিলের ধুতি।
আন্দির জামার তলা দিয়ে নেটের গেঞ্জি চোখে পড়ে।
কিরীটী নীচু হয়ে দেখলে, গলায় আধ ইঞ্চি পরিমাণ একটা সরু কালো দাগ গলার সবটাই বেড় দিয়ে আছে।
চোখ দুটো যেন ঠেলে কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়, চোখের তারায় সাব-কনজাংটাইভ্যাল হিমারেজও আছে।
মুখটা একটু হাঁ করা; কষ বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত কালচে রক্তের ধারা জমাট বেধে আছে।
মৃতদেহ উল্টেপাল্টে দেখল কিরীটী, দেহের কোথাও সামান্য আঘাতের চিহ্নও নেই।
স্পষ্টই বোঝা যায় কোন কিছু গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে।
ডান হাতের উপরে উল্কিতে A ইংরাজী অক্ষরটি লেখা। কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চলুন বিকাশবাবু, দেখা হয়েছে।
মর্গ থেকে বের হয়ে কিরীটী আর বিকাশবাবুর সঙ্গে গেল না। বিকাশবাবুর ভবানীপুরের দিকে একটা কাজ ছিল, তিনি ভবানীপুরগামী ট্রামে উঠলেন।
কিরীটী শ্যামবাজারগামী ট্রামে উঠল।
রাত বেশী হয়নি। সবে সাড়ে আটটা।
কলকাতা শহরে গ্রীষ্মরাত্রি সাড়ে আটটা তো সবে সন্ধ্যা!
ট্রাম থেকে নেমে কিরীটী সোজা একেবারে অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁয় এসে উঠলো।
এক কাপ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিতে হবে।
রেস্তোরাঁ তখন চা-পিপাসীদের ভিড়ে বেশ সরগরম।
কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। একপাশে নিত্যকার মত ছোট একটা টেবিল নিয়ে কাউন্টারের মধ্যে বসে আছেন অন্নপূর্ণা হোটেল ও রেস্তোরাঁর আদি ও অকৃত্রিম একমাত্র মালিক ভূপতিচরণ।
রেস্তোরাঁটায় পাড়ার ছেলেদেরই বেশী ভিড়। নানা আলোচনা চলছিল খদ্দেরদের মধ্যে চা-পান করতে করতে ঐ সময়টায়।
হঠাৎ কানে এলো কিরীটীর, তার ডান পাশের টেবিলে চারজন সমবয়সী ছোকরা চা-পান করতে করতে সকালের ব্যাপারটাই আলোচনা করছে।
কিরীটী উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
লাচুলওয়ালা পাঞ্জাবি ও সার্টের কমবিনেশন জামা গায়ে ৩০।৩২ বৎসরের একটি যুবক তার পাশের যুবকটিকে বলছে, তোদের বাড়ি তো একেবারে সাত নম্বর বাড়ির ঠিক অপজিটে, আর তুই তো শালা রাত্রিচর, তোরও চোখে কিছু পড়েনি বলতে চাস ফটকে?
সম্বোধিত ফটিক নামধারী যুবকটি প্রত্যুত্তরে বলে, একেবারে যে কিছুই দেখিনি মাইরি তা নয়, তবে ধেনোর নেশার চোখে খুব ভাল করে ঠাওর হয়নি।
কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় শিকারী বিড়ালের কানের মত সতর্ক সজাগ হয়ে ওঠে।
ধেনো! বলিস কি ফটকে! তোর তো সাদা ঘোড়া চলে না রে!
ফটিক তার বন্ধু রেবতীর কথায় ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে থাকে। বোঝা যায় কথাটা তার মনে লেগেছে। তারপর বলে, কি করি ভাই! জানিস তো অভাবে স্বভাব নষ্ট। গত মাস থেকে মা আর দুশোর বেশি একটা পয়সা দেয় না। শালা দুশো টাকা মাসের পনের তারিখেই ফুটুস ফুঁ! তাই ঐ ধেনোই ধরতে হয়েছে। কাল রাত্রে নেশাটাও একটু বেশী হয়েছিল
মুখবন্ধ ছেড়ে ব্যাপারটা বল তো! রেবতী বলে ওঠে।
তখন বোধ করি ভাই সাড়ে তিনটে হবে। নেশাটা বেশ চড়চড়ে হয়ে উঠেছে—