- বইয়ের নামঃ হাড়ের পাশা
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
১. কিরীটী একটা ঘর খুঁজছিল
কিরীটী একটা ঘর খুঁজছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে।
শুধু শ্যামবাজার অঞ্চলেই নয়, বিশেষ করে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর কাছাকাছি কোন এক জায়গায় হলেই যেন ভাল হয়।
যে সময়কার কথা বলছি তখনও কলকাতা শহরে ভাড়াটে বাড়ি পাওয়ার বিভ্রাটটা এখনকার মত এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় যেতে যেতে অনেক ‘টু লেট’ই চোখে পড়ত।
নির্দিষ্ট অঞ্চলে দু’একটা ঘর যে কিরীটী পায়নি তাও নয়, কিন্তু ঠিক পছন্দসই হচ্ছিল না যেন।
বিশেষ করে নির্দিষ্ট একটি পরিধির মধ্যেই নয়, কিরীটী যে একটি ঘর খুজছিল ঐ অঞ্চলে—তার কারণও অবশ্য একটা ছিল কিন্তু সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
এমন সময় অকস্মাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে ডালহাউসী স্কোয়ার অঞ্চলে কলেজের একদা সহপাঠী সত্যশরণের সঙ্গে একটা চলমান ট্রামে দেখা হয়ে গেল কিরীটীর। এবং কথায় কথায় সত্যশরণ শ্যামবাজার অঞ্চলেই থাকে শুনে তাকেও ঘরের কথা বলায় সত্যশরণ বললে, আমরা ন্যায়রত্ন লেনে যে সেমি মেসবাড়িটায় থাকি সেইখানেই তো কিছুদিন হলো একটি ঘর খালি পড়ে আছে।
সত্যি কথা বলতে গেলে বাড়িটার মধ্যে দোতলায় সেই ঘরটিই সব চাইতে ভাল। আকারে বড়। দক্ষিণ খোলা।
চমৎকার, ঐ ঘরটা তাহলে আমার জন্য ঠিক করে দাও ভাই। কিরীটী অতি মাত্রায় যেন উৎসুক হয়ে ওঠে।
আরে সেজন্যে আটকাবে না। ঘরটা তো দেখেই আগে পছন্দ করো, তাছাড়া বাড়িওয়ালা মন্দ লোক নয়, ভাড়াও দেবে যখন।
পছন্দ ঠিক হয়ে যাবে ভাই। অন্ততঃ তোমার মুখে শুনে তাই মনে হচ্ছে। ঘরটা আজই পাওয়া যায় কিনা বল। তাহলে সন্ধ্যার পর তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করবো!
ব্যাপার কি হে! তোমার যে একেবারে তর সইছে না। তোমার সে শিয়ালদার বাণীভবন মেস কি হলো?
সেখানে ঠিক সুবিধা হচ্ছে না ভাই। তাই অনেক দিন থেকেই ছেড়ে দেবো দেবো ভাবছি।
বেশ তাহলে চল। আমি তো এখন বাসাতেই ফিরছি। ঠিক আছে, তাই চল। শুভস্য শীঘ্রম। দ্বিপ্রহরের কর্মব্যস্ত কলকাতা শহর। ট্রাম চলছে ঠং ঠং ঘণ্টি বাজিয়ে শ্যামবাজার অভিমুখেই।
কিরীটী সত্যশরণের পাশে বসে মনে মনে ভাবছিল তারই দেওয়া সংবাদটির কথা।
ঘরটা দেখেই কিরীটীর বিশেষ পছন্দ হয়ে গেল।
ন্যায়রত্ন লেনে এমন একটি ঘর পাওয়া যাবে এবং একেবারে ঠিক এতটা মনোমত জায়গায় কিরীটী ভাবেনি—আশাও করেনি, অদ্ভুত যোগাযোগ।
দিন কয়েক আগে কিরীটীর পূর্বপরিচিত শ্যামপুকুর থানার ও. সি. বিকাশ সেনের ওখানে কিরীটী নিজেই ঘুরতে গিয়েছিল বলতে গেলে একপ্রকার তার নিজের কৌতূহলেরই তাগিদে।
গত তিন মাসের মধ্যে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর আশেপাশে তিন-তিনটি অত্যন্ত রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
তিনজন নিহতের মধ্যে একজন অবাঙালী বেহারী মধ্যবয়সী, একজন অল্পবয়েসী পাঞ্জাবী মুসলমান ও সর্বশেষজন ৩৫/৩৬ বৎসর বয়স্ক বাঙালী যুবক।
এবং কোনবারই মৃতের দেহে কোনরুপ আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কেবল প্রত্যেকেরই গলায় একটি সরু, কালো দাগ দেখা গিয়েছে মাত্র।
এবং করোনার্স রিপোর্ট হচ্ছে : শ্বাসরোধে মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে।
নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের এবং বলতে গেলে নির্দিষ্ট একটি পরিধির মধ্যে গত তিন-চার মাসের মধ্যে তিন-তিনটি রহস্যজক হত্যাকাণ্ড এবং প্রত্যেকেরই শ্বাসরোধে মৃত্যু ও প্রত্যেকেরই গলায় একটি করে সরু কালো দাগ—সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঐ সংবাদটি কিরীটীর কৌতূহলকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। এবং ঐ অঞ্চলের থানা অফিসার বিকাশের সঙ্গে কিছুটা পূর্ব পরিচয় থাকায় শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের বশবতী হয়েই কিরীটী বিকাশের ওখানে গিয়ে এক সন্ধ্যারাত্রে হাজির হয়।
একথা সেকথার পর আসল কথা উত্থাপন করায় বিকাশ সেন বলেন, ব্যাপারটা যেন আগাগোড়াই মিস্টিরিয়াস কিরীটী। অনেক অনুসন্ধান করেও কোন হদিস করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ বিকাশ, তিন-তিনটি হত্যাব্যাপারে minutely observe করলে একটা কথাই মনে হয় না কি কোথায় যেন একটি অদৃশ্য যোগসূত্র ঐ হত্যা-ব্যাপারগুলোর মধ্যে বর্তমান আছে! কিরীটী জবাব দিয়েছিল।
তুমি যেন বেশ একটু interested বলেই মনে হচ্ছে রায় ঐ ব্যাপারে। বিকাশ জবাব দেন।
সত্যি কথা বলতে কি সেন, সেইজন্যই আমার আসা।
হ্যাঁ, তা বেশ তো, দেখ না, যদি কোন কিনারা করতে পার ব্যাপারটার। আমরা পুলিশ বাধ্য হয়ে হাত ধুয়েই বসে আছি ও ব্যাপারে।
বলা বাহুল্য সেই রহস্যপূর্ণ ব্যাপারটার একটা ভাল করে অনুসন্ধান করবার মতলবেই তারপর থেকে কিরীটী ঐ অঞ্চলে একটা থাকবার আস্তানা খুজছিল। কারণ তার ধারণাই হয়েছিল ঐ হত্যা ব্যাপারগুলোর পশ্চাতে বিশেষ কোন একটা রহস্য আছে। এবং ঐ রহস্যের কিনারা করতে হলে সর্বাগ্রে অকুস্থানের আশেপাশে বা নিকটে কোথাও তাকে কিছুদিন ডেরা বেধে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।
ট্রাম চলেছে মন্থর গতিতে। কিরীটীর আত্মচিন্তায় বাধা পড়ল হঠাৎ সত্যশরণের কথায়।
তোমাকে একটা কথা পূর্বেই খুলে বলে রাখা ভাল কিরীটী। সত্যশরণ যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে কথাটা বলতে গিয়েও।