Site icon BnBoi.Com

রাত্রি যখন গভীর হয় – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

রাত্রি যখন গভীর হয় - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. নতুন ম্যানেজার

রাত্রি যখন গভীর হয় – কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. নতুন ম্যানেজার

ডিসেম্বরের শেষের শীতের রাত্রি।

কুয়াশার ধূসর ওড়নার আড়ালে আকাশে যেটুকু চাঁদের আলো ছিল তাও যেন চাপা পড়ে গেছে।

মিনিট কয়েক হল মাত্র এক্সপ্রেস ট্রেনটা ছেড়ে চলে গেল।

গাড়ির পিছনকার লাল আলোটা এতক্ষণ যা দেখাচ্ছিল, একটা রক্তের গোলার মত, এখন সেটাও কুয়াশার অস্বচ্ছতায় হারিয়ে গেছে।

স্টেশনের ইলেকট্রিক বাতিগুলো কুয়াশার আবরণ যেন ভেদ করে উঠতে পারছে না। ধানবাদ স্টেশনের লাল কাঁকর-ঢালা চওড়া প্ল্যাটফর্মটা জনশূন্য।

একটু আগে ট্রেনটা থামার জন্য যে সামান্য চঞ্চলতা জেগেছিল, এখন তার লেশমাত্রও নেই।

একটা থমথম করা স্তব্ধতা চারিদিকে যেন। জুতোর মচমচশব্দ জাগিয়ে দুজন ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজন বেশ লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার, পরিধানে কালো রংয়ের দামী সার্জের সুট। তার উপর একটা লং কোট চাপানো। মাথায় পশমের নাইট ক্যাপ, কান পর্যন্ত ঢাকা।

অন্যজন অনেকটা খাটো। পরনে ধুতি, গায়ে-মাথায় একটা শাল জড়ানো। মুখে একটা জ্বলন্ত বিড়ি।

চা-ভেণ্ডার তার চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এল, বাবু, গরম চা? গরম চা? …

না, প্রথম ব্যক্তি বললে।

গলার স্বরটা বেশ ভারী ও মোটা।

চা-ভেণ্ডার চলে গেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে ফিরে প্রথম ব্যক্তি প্রশ্ন করলে, সুশান্তবাবু যেন খুন হলেন কবে?

গত ২৮শে জুন রাত্রে।

আজ পর্যন্ত তাহলে তাঁর মৃত্যুর কোন কারণই খুঁজে পাননি?

না, খুনীকে খুঁজতেও তো কসুর করলাম না। আমাদের কুলী-গ্যাং, কর্মচারীরা, মায় পুলিস অফিসাররা পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে সবাই হয়রান হয়ে গেছেন।

আশ্চর্য!

তা আশ্চর্য বৈকি! পর পর তিনজন ম্যানেজার এমনি করে কোয়াটারের মধ্যে খুন হলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম, এরপর কেউ আর এখানে কাজ নিয়ে আসতেই চাইবেন না। হাজার হোক একটা প্যানিক (ভীতি) তোবলে লোকটি ঘন ঘন প্রায় শেষ বিড়িটায় টান দিতে লাগল।

শঙ্কর সেন মৃদু হেসে বললেন, আমি লয়াবাদে একটা কলিয়ারীতে মোটা মাইনের চাকরি। করছিলাম। তাহলে কথাটা আপনাকে খুলেই বলি—ঐ যে ভয়ের কথা কি বললেন—আমাদের বড়বাবুর মুখে এখানকার ঐ ভয়ের ব্যাপারটা শুনে চার মাসের ছুটি নিয়ে এই চাকরিতে এসে জয়েন করেছি।

কিন্তু–

ভয় নেই, পছন্দ হলে থেকে যাব।

আপনার খুব সাহস আছে দেখছি, শঙ্করবাবু!

শুধু আমিই নয়—শঙ্কর সেন বলতে লাগলেন, আমার এক কলেজ-ফ্রেণ্ডকেও লিখেছি আসতে। বর্তমানে সে শখের গোয়েন্দাগিরি করে। যেমন দুর্দান্ত সাহস, তেমন চুলচেরা বুদ্ধি। কেননা আমার ধারণা, এইভাবে পর পর আপনাদের ম্যানেজার নিহত হওয়ার পিছনে ভৌতিক কিছু নেই, আছে কোন শয়তানের কারসাজী।

বলেন কি স্যার? আমার কিন্তু ধারণা এটা অন্য কিছু!

অন্য কিছু মানে? শঙ্কর সেন বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।

যে জমিটায় ওঁরা অর্থাৎ আমাদের কর্তারা কলিয়ারী শুরু করতে ইচ্ছা করেছেন, ওটা একটা অভিশপ্ত জায়গা। ওখানকার আশপাশের গ্রামের সাঁওতালদের কাছে শুনেছি, ওই জায়গাটা নাকি বহুকাল আগে একটা ডাকাতদের আড্ডাখানা ছিল, সেই সময় বহু লোক এখানে খুন হয়েছে। সেই সব হতভাগ্যদের অদেহী অভিশপ্ত আত্মা আজও ওখানে দিবারাত্রি নাকি ঘুরে বেড়ায়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। কতদিন রাত্রে বিশ্রী কান্না ও গোলমালের শব্দে আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। আবছা চাঁদের আলোয় মনে হয়েছে যেন হালকা আবছা কারা মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

অল বোগাস! দাঁতে দাঁত চেপে শঙ্কর সেন বললে।

আমি জানি স্যার, ইংরাজী শিক্ষা পেয়ে আপনারা আজ এসব হয়ত বিশ্বাস করতে চাইবেন না, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি। মরণই আমাদের শেষ নয়। মরণের ওপারে একটা জগৎ আছে এবং সে জগতের যারা বাসিন্দা তাদেরও প্রাণে এই মাটির পৃথিবীর লোকদের মতই দয়া, মায়া, ভালবাসা, আকাঙক্ষা, হিংসা প্রভৃতি অনুভূতিগুলো আছে এবং মাটির পৃথিবী ছেড়ে গেলেও এখানকার মায়া সহজে তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না।

একটানা কথাগুলো বলে বিমলবাবু একটা বিড়ি ধরিয়ে প্রাণভরে টানতে লাগলেন।

কই, আপনার বাসের আর কত দেরি?

এই তো, আর মিনিট কুড়ি বাকি।

চলুন, রেস্টুরেন্ট থেকে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।

আজ্ঞে চায়ে আমার নেশা নেই।

তাই নাকি? বেশ, বেশ। কিন্তু এই শীতে চা-বিনে থাকেন কি করে?

আজ্ঞে গরীব মানুষ।

দুজনে এসে কেলনারের রেস্টুরেন্টে ঢুকল এবং চায়ের অর্ডার দিয়ে দুজনে দুখানা চেয়ার দখল করে বসল।

আপনি আপনার যে বন্ধুটির কথা বলছিলেন, তাঁর বুঝি গোয়েন্দাগিরিতে খুব হুজুগ আছে? হ্যাঁ, হজুগই বটে। শঙ্করবাবু হাসতে লাগল।

হুঁ। ওই এক-একজনের স্বভাব। নেই কাজ তো খই ভাঁজ! তা বড়লোক বুঝি? টাকাকড়ির অভাব নেই, বসে বসে আজগুবী সব খেয়াল মেটান!

বেয়ারা চায়ের সরঞ্জাম রেখে গেল।

আসুন না বিমলবাবু, কেতলি থেকে কাপে দুধ চিনি মিশিয়ে র-চা ঢালতে ঢালতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কর বললে, বড্ড ঠাণ্ডা, গরম গরম এক কাপ চা মন্দ লাগবে না!

আচ্ছা দিন, বিমলবাবু বলে, আপনার request, মানে অনুরোধ–

শঙ্কর বিমলবাবুকে এক কাপ চা ঢেলে দিল। চায়ের কাপে বেশ আরাম করে চুমুক দিতে দিতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিমলবাবু শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তা আপনার সে বন্ধুটির নাম কী?

নাম কিরীটী রায়।

কিরীটী রায়! কোন্ কিরীটী রায়? বর্মার বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্রমর প্রভৃতির যিনি রহস্য ভেদ করেছিলেন?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোকের নাম হয়েছে বটে! কবে আসবেন তিনি?

আজই তো আসবার কথা ছিল, কিন্তু এল না তো দেখছি। কাল হয়ত আসবে।

এমন সময় বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল।

বাস এসে গেছে।

বাস মানে একটা কম্পার্টমেন্ট এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়।

চা-পান শেষ করে দাম চুকিয়ে দিয়ে দুজনে বাসে এসে উঠে বসল।

অল্পক্ষণ বাদেই বাস ছেড়ে দিল।

শীতের অন্ধকার রাত্রি কুয়াশার আবরণের নীচে যেন কুঁকড়ে জমাট বেঁধে আছে।

খোলা জানলাপথে শীতের হিমশীতল হাওয়া হু-হু করে এসে যেন সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়ে যায়। এতগুলো গরম জামাতেও যেন মানতে চায় না। দুজনে পাশাপাশি বসে চুপচাপ।

কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি ওদের গন্তব্য স্থান। কাতরাসগড় স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বেশ খানিকটা পথ। রাত্রি প্রায় তিনটের সময় গাড়ি এসে কাতরাসগড় স্টেশনে থামল। অদূরে স্টেশন-ঘর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। একটা সাঁওতাল কুলি এদের অপেক্ষায় বসে ছিল।

তার মাথায় সুটকেস ও বিছানা চাপিয়ে একটা বেবী পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে ওরা রওনা হয়ে পড়ল।

নিঝুম নিস্তব্ধ কনকনে শীতের রাত্রি।

আগে বিমলবাবু এগিয়ে চলেছে, হাতে তার আলো, চলার তালে তালে দুলছে।

আলোর একঘেয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধ প্রান্তরের মৌনতা ভঙ্গ করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা দমকা হাওয়া হু-হু করে বয়ে যায়।

মাঝখানে শঙ্কর। সবার পিছনে মোটঘাট মাথায় নিয়ে সাঁওতালটা।

একপ্রকার ঝোঁকের মাথায়ই শঙ্কর এই কাজে এগিয়ে এসেছে। চিরদিন বেপরোয়া জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এ দুনিয়ায় ভয়ডর বলে কোন কিছু, কোন প্রকারে বিপদ-আপদ তাকে পিছনটান দিয়ে ধরে রাখতে পারে নি। সংসারে একমাত্র বুড়ী পিসীমা। আপনার বলতে আর কেউ নেই। কেই বা বাধা দেবে?

বিমলবাবুর মুখ থেকেই শোনে কলিয়ারীর ইতিহাসটা শঙ্কর। বছর-দুই আগে কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে পূর্ববঙ্গের এক ধনীপুত্র কলিয়ারী করবার ইচ্ছায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু একমাস যেতে না যেতেই ম্যানেজার রামহরিবাবু একান্ত আশ্চর্যভাবে তাঁর কোয়ার্টারে এক রাত্রে নিহত হন। দ্বিতীয় ম্যানেজার বিনয়বাবু কিছুদিন বাদে কাজে বহাল হন। দিন পনের যেতে না যেতে তিনিও নিহত হন। তারপর এলেন সুশান্তবাবু, তাঁরও ঐ একই ভাবে মৃত্যু ঘটল। পুলিস ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্টাতেও কে বা কারা। যে এঁদের এমন করে খুন করে গেছে তার সন্ধান করতে পারলে না। তিন-তিনবারই একটি কুলি বা কর্মচারী নিহত হয়নি, তিনবারই ম্যানেজার নিহত হল। মৃত্যুও ভয়ঙ্কর। কে যেন ভীষণভাবে গলা টিপে হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যু ঘটিয়েছে, গলার দুপাশে দুটি মোটা দাগ এবং গলার পিছনের দিকে চারটি কালো গোল ছিদ্র।

শঙ্কর যেখানে কাজ করছিল সেখানকার বড়বাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একান্তকৌতূহলবশেই নিজে অ্যাপ্লিকেশন করে কাজটা সে নিয়েছে চারমাসের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে।

এখানে রওনা হবার আগের দিন কিরীটীকে একটা চিঠিতে আগাগোড়া সকল ব্যাপার জানিয়ে আসবার জন্য লিখে দিয়ে এসেছে।

কিন্তু এই নিষুতি রাতে নির্জন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়, কে জানে এমনি করে নিশ্চিত মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাল করল কি মন্দ করল!

অদূরে একটা কুকুর নৈশ স্তব্ধতাকে সজাগ করে ডেকে উঠল।

ওরা এগিয়ে চলে।

০২. ভয়ঙ্কর চারটি কালো ছিদ্র

শঙ্কর সেন কিরীটীর কলেজের বন্ধু, একই কলেজ থেকে ওরা বি.এস্-সি. পাস করেছিল।

রসায়নে এম. এস্-সি পাস করে শঙ্কর মামার বন্ধুর কলিয়ারীতে কাজ নিয়ে চলে যায়। সেও দীর্ঘ পাঁচ বছরের কথা। কিরীটী তার আগেই রহস্যভেদের জালে পাক খেতে খেতে এগিয়ে গেছে অনেকটা। বছর-দুই আগে কলকাতায় দুজনের একবার ইস্টারের ছুটিতে দেখা হয়েছিল।

তারপর কেউ কারও সংবাদ পায়নি। হঠাৎ শঙ্করের চিঠি পেয়ে কিরীটী বেশ খুশীই হল।

জংলীকে ডেকে সব গোছগাছ করতে বলে দিল।

পরের দিন তুফান মেলে যাবে সব ঠিক, এমন সময় সুব্রত এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।

একতলার ঘরে জংলীকে সব গোছগাছ করতে দেখে প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কি জংলী?

বাবু কাতরাসগড় চলেছেন।

হঠাৎ?

কী জানি বাবু! আপনাদের কয় বন্ধুর কি মাথার ঠিক আছে? বর্মা, লঙ্কা, হিল্লী-দিল্লীতে আপনারা লাফালাফি করতেই আছেন।

সুব্রত হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানছিল। সুব্রতর পায়ের শব্দে মুদ্রিত চোখেই বললে:

কিবা প্রয়োজনে
এ অকিঞ্চনে
করিলে স্মরণ?

সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল :

আসি নাই সন্ধি হেতু,
ফাটাফাটি রক্তারক্তি
খুনোখুনি,
যাহা হয় কিছু!
পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি;
জংলীরে সাথে লয়ে
কোথায় চলেছ;
দিয়ে অভাগা আমারে ফাঁকি?

কিরীটী বললে:

করিয়াছি মন
সুদূর কাতরাসগড়।
বারেক আসিব ঘুরি

নে নে, থামা বাবা তোর কবিতা! সত্যি হঠাৎ কাতরাসগড় চলেছিস কেন?

কিরীটী সোফার ওপরে সোজা হয়ে বসে, হাতের প্রায়-নিভন্ত সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে বললে, হৈ-হৈ ব্যাপার, রৈরৈ কাণ্ড!

অর্থাৎ?

শোন। কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি একটা কোল্‌ফিল্ড আছে। সেটার মালিক পূর্ববঙ্গের কোন এক যুবক জমিদার-নন্দন।

তারপর?

কলিয়ারী স্টার্ট করা হয়েছে; অর্থাৎ তোমার কলিয়ারীর গোড়াপত্তন আরম্ভ করা হয়েছে মাস-দুই হল।

থামছিস কেন, বল না!

কিন্তু মাস-দুয়েকের মধ্যে তিন তিনটে ম্যানেজার খুন হয়েছেন।

তার মানে?

আরে সেই মানেই তো solve করতে হবে।

বুঝলাম। তা কী করে ম্যানেজার তিনজন মারা গেলেন?

ময়না-তদন্তে জানা গেছে তাঁদের গলা টিপে মারা হয়েছে এবং গলার পিছন দিকে মারাত্মক রকমের চারটি করে ছিদ্র দেখতে পাওয়া গেছে। তাছাড়া অন্য কোন দাগ বা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।

শরীরের অন্য কোন জায়গায়ও না?

না, তাও নেই।

আশ্চর্য!

তা আশ্চর্যই বটে! সত্যিই আশ্চর্য সেই চারটি কালো ছিদ্র! এবারকার নতুন ম্যানেজার হচ্ছে আমারই কলেজ-ফ্রেণ্ড শঙ্কর সেন। সেও তোমার মতই গোঁইয়ার-গোবিন্দ ও একজন পাকা অ্যাথলেট। সে সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে আমায় সেখানে যেতে লিখেছে।

দেখ কিরীটী, সুব্রত বললে, একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে!

যথা?

এবারকার রহস্যের কিনারার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দে। এতদিন তোমার সাকরেদি করলাম, দেখি পারি কিংবা হারি-হরি।

বেশ তো। আমার সঙ্গেই চল না।

না, তা হবে না। পুরোপুরি আমার হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে তুই মাথা দিতে পারবি না!

পুরাতন কলেজ-ফ্রেণ্ড, যদি অসন্তুষ্ট হয়?

কেন, অসন্তুষ্ট হবে কেন? আমি হালে পানি না পাই, তবে না-হয় তুই অবতীর্ণ হবি!

কিন্তু তখন যদি সময় আর না থাকে, বিশেষ করে একজনের জীবনমরণ যেখানে নির্ভর করছে!

সব বুঝি কিরীটী। তার নিয়তি যদি ঐ কলিয়ারীতেই থাকে তবে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। তুই আমি তো কোন্ কথা, স্বয়ং ভগবানও পারবে না।

তা বটে। তা বেশ, তুই তাহলে কাল রওনা হয়ে হ্যাঁ। শঙ্করকে একটা চিঠি ড্রপ করে দেব সমস্ত ব্যাপার খুলে লিখে।

হ্যাঁ, তাই দে। ভয় নেই কিরীটী, সুব্রত রায়কে তুই এটুকু বিশ্বাস করতে পারিস, বুদ্ধির খেলায় না পারি দেহের সবটুকু শক্তি দিয়েও তাকে প্রাণপণে আগলাবই।

দেহের শক্তিতে সেও কম যায় না সুব্রত। একটু গোলমাল ঠেকলেই কিন্তু তুই আমায় খবর দিস ভাই। অবিশ্যি চিঠি থেকে যতটুকু ধরতে পেরেছি তাতে ব্যাপারটা যে খুব জটিল তা মনে হয় না। এক কাজ করিস তুই, বরং প্রত্যেক দিন কতদূর এগুলি বিশদভাবে আমায় চিঠি লিখে জানাস, কেমন?

বেশ, সেই কথাই রইল।

 ০৩. মানুষ না ভূত

কোল্‌ফিল্ডটা প্রায় উনিশ-কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে।

ধূ-ধূ প্রান্তর। তার মাঝে একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে কুলিবস্তি বসানো হয়েছে। টেমপোরারি সব টালি ও টিনের সে তুলে ছোট ছোট খুপরী তোলা হয়েছে। কোন-কোনটার ভিতর থেকে আলোর কম্পিত শিখার মৃদু আভাস পাওয়া যায়। অল্প দূরে পাকা গাঁথনি ও উপরে টালির সে দিয়ে ম্যানেজারের ঘর তোলা হয়েছে এবং প্রায় একই ধরনের আর দুটি কুঠি ঠিকাদার ও সরকারের জন্য করা হয়েছে। ম্যানেজারের কোয়াটার এতদিন তালাবন্ধই ছিল। বিমলবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দেয়।

কোয়ার্টারের মধ্যে সর্বসমেত তিনখানি ঘর, একখানি রান্নাঘর ও বাথরুম।

মাঝখানে ছোট একটি উঠোন। দক্ষিণের দিকে বড় ঘরটায় একটা কুলি একটা ছাপর খাটের ওপরে শঙ্করের শয্যা খুলে বিছিয়ে দিল।

আচ্ছা আপনি তা হলে হাতমুখ ধুয়ে নিন স্যার। ঠাকুরকে দিয়ে আপনার জন্য লুচি ভাজিয়ে রেখে দিয়েছি, পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে। বংশী এখানে রইল।

বিমলবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।

শঙ্কর শয্যার ওপরে গা ঢেলে দিল।

রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল।

কিন্তু কুয়াশার আবছায়ায় কিছু বোঝবার জো নেই।

একটু বাদে বিমলবাবুর ঠাকুর লুচি ও গরম দুধ দিয়ে গেল। দু-চারটে লুচি খেয়ে দুধটুকু এক ঢোকে শেষ করে শঙ্কর ভাল করে পালকের লেপটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল।

পরের দিন বিমলবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে শঙ্কর দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের অরুণ রাগ তখন ঝিলিক হানছে।

সারাটা দিন কাজকর্ম দেখেশুনে নিতেই চলে গেল।

বিকেলের দিকে সুব্রত এসে পৌঁছল।

কিরীটী তার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল।

সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শঙ্কর বেশ খুশীই হল।

তারও দিন দুই পরের কথা।

এ দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেছে।

সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবশ্যকীয় কয়েকটা কাগজপত্র শঙ্কর টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় বসে দেখছে।

সুব্রত বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

শঙ্কর উৎকীর্ণ হয়ে উঠল, কে?

আমি স্যার, চন্দন সিং।

ভিতরে এস চন্দন।

চন্দন সিং অল্পবয়েসের পাঞ্জাবী যুবক।

এই কলিয়ারীতে ম্যানেজারের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে কাজে বহাল হয়েছে।

কি খবর চন্দন সিং?

আপনি আমায় ডেকেছিলেন?

কই না! কে বললে? কতকটা আশ্চর্য হয়েই শঙ্কর প্রশ্ন করলে।

বিমলবাবু অর্থাৎ সরকার মশাই বললেন।

বিমলবাবু বললেন! তারপর সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। বসো ঐ চেয়ারটায়। তোমার সঙ্গে গোটাকতক কথা আছে।

চন্দন সিং একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল।

এখানকার চাকরি তোমার কেমন লাগছে চন্দন?

পেটের ধান্ধায় চাকরি করতে এসেছি স্যার, আমাদের পেট ভরলেই হল স্যার।

না, তা ঠিক বলছি না। এই যে পর পর দুজন ম্যানেজার এমনিভাবে নিহত হলেন—

সহসা চন্দন সিংয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়তে শঙ্কর চমকে উঠল। চন্দনের সমগ্র মুখখানি ব্যেপে যেন একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিন্তু চন্দন সিং সেটা সামলে নিল।

শঙ্কর বলতে লাগল, তোমার কী মনে হয় সে সম্পর্কে?

চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় যেন কী একটা কিছু বেচারী প্রাণপণে এড়িয়ে যেতে চায়।

তুমি কিছু বলবে চন্দন?

সোৎসুকভাবে শঙ্কর চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে তাকাল।

একটা কথা যদি বলি, অসন্তুষ্ট হবেন না তো স্যার?

না, না–বল কি কথা?

আপনি চলে যান স্যার। এ চাকরি করবেন না।

কেন? হঠাৎ এ-কথা বলছ কেন?

না স্যার, চলে যান আপনি। এখানে কারও ভালো হতে পারে না।

ব্যাপার কি চন্দন? এ বিষয়ে তুমি কি কিছু জান? টের পেয়েছ কিছু?

ভূত!…আমি নিজের চোখে দেখেছি।

ভূত!

হ্যাঁ। অত বড় দেহ কোন মানুষের হতে পারে না।

আমাকে সব কথা খুলে বল চন্দন সিং!

আপনার আগের ম্যানেজার সুশান্তবাবুমারা যাবার দিন-দুই আগে বেড়াতেবেড়াতে পশ্চিমের মাঠের দিকে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিকে অস্পষ্ট আঁধার, হঠাৎ মনে হল পাশ দিয়ে যেন ঝড়ের মত কী একটা সন্ন্ করে হেঁটে চলে গেল। চেয়ে দেখি লম্বায় প্রায় হাত পাঁচ-ছয় হবে। আগাগোড়া সর্বাঙ্গ বাদামী রংয়ের আলখাল্লায় ঢাকা।

সেই অস্বাভাবিক লম্বা মূর্তিটা কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একটা পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেলাম। উঃ,সে হাসি মানুষের হতে পারে না।

তারপর?

তার পরের দিনই সুশান্তবাবুও মারা যান। শুধু আমিই নয়, সুশান্তবাবুও মরবার আগের দিন সেই ভয়ঙ্কর মৃর্তি নিজেও দেখেছিলেন।

কি রকম?

রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সে রাতে কুয়াশার মাঝে পরিষ্কার না হলেও অল্প অল্প চাঁদের আলো ছিল–রাত্রে বাথরুম যাবার জন্য উঠেছিলেন, হঠাৎ ঘরের পিছনে একটা খুকখুক কাশির শব্দ পেয়ে কৌতূহলবশে জানালা খুলতেই দেখলেন, সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের মত হেঁটে যাচ্ছে।

সে মৃর্তি আমি আজ স্বচক্ষে দেখলাম শঙ্করবাবু! দুজনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বক্তা সুব্রত। সে এর মধ্যে কখন একসময়ে ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।

০৪. আঁধারে বাঘের ডাক

কী দেখেছেন?

ভূত! চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শঙ্করবাবুর অ্যাসিটেন্ট?

চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।

এখানকার ঠিকাদার কে, চন্দনবাবু?

ছট্টু লাল।

তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই। কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে!

দেব, নিশ্চয়ই দেব।

আচ্ছা চন্দনবাবু, আপনাকে কটা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?

সে কি কথা! নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?

আমি শঙ্করবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি, জানেন তো?

জানি।

কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম, তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।

নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমি ওঁকে বলছিলাম এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে। আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে এ জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।

আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।

কি বলছেন সুব্রতবাবু?

হ্যাঁ—ঠিকই বলছি—

কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরি কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব–তাই আমার ইচ্ছে সুব্রতবাবু। শঙ্কর বললে।

বড় রকমের একটা বিপদ-আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শঙ্করবাবু?…অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।

যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে, তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শঙ্কর বললে।

যুক্তি হয়ত নেই শঙ্করবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে! সুব্রত বলে!

কিন্তু, চন্দন সিং বলে, শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মূর্তি দেখেছি তাই নয় স্যার, মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারেনা। বাঁচা অসম্ভব। এর আগে তিনবার আক্রমণটা ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়ে গেছে-কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের ওপর দিয়ে যাবে না!

সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হল।

চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল, রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।

শঙ্কর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।

শঙ্করের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।

আজও সে শয্যায় শোরার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল। সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে টেবিলল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল। কিরীটী

কাল তোকে এসে পৌঁছানোর সংবাদ দিয়েছি। আজ এখানকার আশপাশ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধূ-ধূ মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা, যেন চারিদিকের প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।

বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইশারা, প্রকৃতির বুক ছুঁয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোল্‌ফিল্ড বসেছে, তারই মাইলখানেক দূরে বহুকাল আগে একসময়  একটা কোল্‌ফিল্ড ছিল। আকস্মিকভাবে এক রাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনও মাঝে মাঝে বড় বড় গর্তমত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তের মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়।

অভিশপ্ত খনির বুকে দুর্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্রকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি, অন্ধকার চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছনপানে ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য, কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না!

লম্মায় প্রায় ছ হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা, তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হনহন করে যেন একটা ঝড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।

আমি নির্বাক হয়ে সেই অপস্রিয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।

এত কাছাকাছি মনে হল–যেন আশেপাশে কোথায় রাঘটা ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।

তুই হয়ত বলবি আমার শোনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।

তাছাড়া তুই তো জানিস, সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ সিরসির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম বাসায় ফেরবার জন্য।

চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্নভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।

একবার, দুবার, তিনবার।

সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল।

তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল-ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝনঝন শব্দে ততক্ষণে শঙ্করের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।

ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?

শঙ্করবাবু, আমি সুব্রত।

সুব্রতবাবু!

হ্যাঁ। ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।

বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।

অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূণাবর্ত তুলেছে।

বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?

হ্যাঁ।

কিসের গোলমাল?

বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলিবস্তির দিক থেকে আসছে। সুব্রত বললে, চলুন একবার খবর নেওয়া যাক।

বেশ চলুন।

দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট-ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হল।

গোলমালটা ক্রমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ-পাতাল-ফাটানো একটা বাঘের কুদ্ধ গর্জন রাত্রির আঁধারকে যেন ফালি ফালি করে জেগে উঠল আবার অকস্মাৎ।

এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।

সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।

শঙ্কর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে। যেন সহসা একটা তীব্ৰ বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় ও পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারও মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে এক ঝটকায় ঘরের খিল খুলে ফেলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টচটা জ্বেলে লাফিয়ে পড়ল।

আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা বোধ হয় ঘটতে কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।

সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শঙ্কর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।

বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতে টর্চের তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি, অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।

বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।

ততক্ষণে শঙ্করও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে!

তবে?

বুঝতে পারিছ না, সত্যি সত্যিই এ কি তবে ভৌতিক ব্যাপার!

বলতে বলতে শঙ্কর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাজঁই ও বাবলা গাছ পড়ে। সেইদিকে শঙ্করের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল, কে? কে ওখানে?

একটা কালো মৃর্তি। তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।

চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে, ওই দেখুন বাঘ! সরে যান, গুলি করি!

শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ সজোরে সুব্রতর কণ্ঠে ফুটে বের হয়ে এল।

স্যার আমি! গুলি করবেন না স্যার! ইয়োর মোস্ট ফেথফুল অ্যাণ্ড ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট!

একটা চাপা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজল।

কে?

আমি বিমল দে। কলিয়ারীর সরকার।

বিমলবাবু! শঙ্করের বিস্মিত কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এল।

দুজনে এগিয়ে গেল।

শঙ্কর বিমলবাবুর গায়ের ওপরে টর্চের আলো ফেলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, এত রাত্রে এখানে এই শীতে মাঠের মধ্যে কি করছিলেন?

আগাগোড়া একটা সাদা ডোরাকাটা ভারী কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে বিমলবাবু সামনে দাঁড়িয়ে।

আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, স্যার!

আমার কাছে যাচ্ছিলেন? শঙ্কর প্রশ্ন করলে।

হ্যাঁ। কুলি-ধাওড়ায় একটা লোক খুন হয়েছে।

খুন হয়েছে? …সুব্রত চমকে উঠল।

হ্যাঁ বাবু, খুন হয়েছে!

গোলমালটা তখন বেশ সুস্পষ্ট ভাবে কানে এসে বাজছে।

চলুন দেখে আসা যাক।

সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর বললে।

আগে শঙ্কর, মাঝখানে বিমলবাবু ও সর্বশেষে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে কুলিবস্তির দিকে এগিয়ে চলল।

মাথার উপরে তারায় ভরা রহস্যময়ী অন্ধকার রাতের আকাশ কী যেন এক ভৌতিক বিভীষিকার প্রতীক্ষ্ণয় উগ্রীব।

আজ রাতে কুয়াশার লেশমাত্র নেই।

০৫. আবার ভয়ঙ্কর চারিটি ছিদ্র

সকলেই নির্বাক। কারও মুখে কোন কথা নেই। শুধু রাতের স্তব্ধ মৌনতার বুকে জেগে উঠেছে কতকগুলো ভয়ার্ত লোকের একটানা গোলমালের এলোমেলো একটা ক্রমবর্ধমান শব্দের রেশ।

সহসা সুব্রত কথা বললে, আপনার কোয়াটারটা কোথায় বিমলবাবু?

কেন, এখানেই তো থাকি!

এখানেই মানে? কোথায়? মানে লোকেশানটা চাচ্ছি!

কুলিদের ধাওড়ার লাগোয়া। আমি আর রেজিংবাবু একই ঘরে থাকি।

আপনার রেজিংবাবুর নাম কি?

রামলোচন পোদ্দার।

তিনি কোথায়?

তিনি ধাওড়ার দিকে গেছেন।

গোলমাল শোনবার আগে ঘুমোচ্ছিলেন বুঝি?

না। রামলোচনবাবু ঘুমোচ্ছিলেন, আমি জেগে বসে হিসাবপত্র দেখছিলাম।

কথা বলতে বলতে ততক্ষণ তারা কোফিল্ডের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অদূরে অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে চানকের উপরের চাকাটা দেখা যাচ্ছে।

চারিদিকে একটা থমথমে ভাব এবং সেই থমথমে প্রকৃতির বুকে একটা অস্পষ্ট গোলমালের সুর, কেমন যেন ভৌতিক বলে মনে হয়।

ধাওড়ায় তখন সাঁওতাল পুরুষ ও কামিন সকলেই প্রায় একজায়গায় ভিড় করে মৃদু গুঞ্জনে জটলা পাকাচ্ছে। শঙ্করকে দেখে সকলে ভিড় ছেড়ে সরে দাঁড়াতে লাগল।

একটা ঘরের দরজার সামনে সকলে এসে দাঁড়াল।

একটি বলিষ্ঠ চব্বিশ-পঁচিশ বছরের সাঁওতাল যুবক চিৎ হয়ে পড়ে আছে।

সামনেই একটা কেরোসিনের ল্যাম্প দপদপ করে জ্বলছে প্রচুর ধূম উদগিরণ করে।

প্রদীপের লাল আলোর মলিন আভা মৃত সাঁওতাল যুবকের মুখের উপরে প্রতিফলিত হয়ে মৃতের মুখখানাকে যেন আরও বিভীস, আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।

মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কালো চুলগুলো এলোমেলো। গোল গোল বড় বড় চোখের মণি দুটো যেন চক্ষুকোটর থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। জিভটা খানিকটা বের হয়ে এসেছে মুখ-বিবর থেকে। সমগ্র মুখখানি ব্যেপে একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ফুটে উঠেছে।

সুব্রত মৃতের মুখের ওপরে শক্তিশালী টর্চের উজ্জ্বল আলো ফেলল।

অত্যুজ্জ্বল আলোয় মৃত ব্যক্তির গলার দিকে নজর পড়তেই সুব্রত চমকে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি প্রখর করে দেখতে লাগল।

গলার দুপাশে আঙুলের দাগ যেন চেপে বসে গেছে।

নাকের নীচে হাত দিয়ে দেখলে, কোথাও আর শ্বাসপ্রশ্বাসের লেশমাত্র নেই।

অনেকক্ষণ মারা গেছে। হিমকঠিন অসাড়।

টর্চের আলোয় মৃতদেহটাকে সুব্রত ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখল। মৃতদেহটিকে উপুড় করে দিতেই ও লক্ষ্য করল রক্তে কালো কালো চারটি ছিদ্র ঘাড়ের দিকে যেন কি এক বিভীষিকায় ফুটে উঠেছে। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ ধারাল অস্ত্রের অগ্রভাগ দিয়ে পাশাপাশি পর পর চারটি ছিদ্র করা হয়েছে।

শঙ্কর প্রশ্ন করলে, কী দেখছেন সুব্রতবাবু? উঠে আসুন!

সুব্রত টর্চটা নিভিয়ে দিল, হ্যাঁ, চলুন। কী ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু!

সকলে বাইরে এসে দাঁড়াল।

শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে ক্ষীণ চাঁদের এক টুকরো জেগে উঠেছে, যেন বাঁকানো ছোরা একখানি। সহসা কে এক নারী আলুলায়িতা কুন্তলা, পাগলিনীর মতই শঙ্করবাবুর পায়ের উপরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, বাবু রে, হামার কি হল রে–

সকলে চমকে উঠল।

একজন বৃদ্ধগোছের সাঁওতাল এগিয়ে এল, ও সোহাগী। কী করবি বল্—

কে এই মেয়েটি বিমলবাবু? শঙ্করবাবু প্রশ্ন করলেন।

ঝন্টুর স্ত্রী, বাবু। সোহাগী।

কে ঝন্টু?

যে লোকটা মারা গেছে।

তুই এখন যা সোহাগী। তোর একটা ব্যবস্থা করে দিব রে। শঙ্কর বলে। সান্তনা দেয়।

ঝন্টুকে ছেড়ে আমি থাকতে লারব বাবু গো। ঝন্টুকে তুই আমায় ফিরায়ে দে বাবু।

কেঁদে আর কি করবি বল্! যা ঘরে হ্যাঁ।

না, না। ঘরকে আমি যাব না রে। ঘর আমার আঁধার হয়ে গেল। ঝন্টু আমার নাই রে। ওরে ঝন্টু রে!

চুপ কর, সোহাগী, চুপ ক।

সহসা বিমলবাবু প্রচণ্ড বেগে ধমক দিয়ে উঠলেন, এই মাগী, থাম! ভূতে তোর স্বামীকে খুন করেছে, তার ম্যানেজারবাবু কি করবে? যা ওঠ ওঠ! যত সব নচ্ছার বদমায়েস এসে জুটেছে। যা ভাগ যা! অন্ধকার রাতে আনমনে পথ চলতে চলতে সহসা একটা তীব্র আলোর ঝাপটা মুখে এসে পড়লে পথিক যেমন ক্ষণেকের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সোহাগীও তেমনি সহসা যেন তার সকল শোক ভুলে মুহূর্তের জন্য মৌন বাক্যহারা হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে বিমলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং পায়ে পায়ে পিছন হেঁটে সরে যেতে লাগল।

চলুন ম্যানেজারবাবু, ওদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। পুলিসে খবর দিতে হবে, লাশ ময়নাতদন্তে যাবে। যত সব হাঙ্গামা! পোষাবে না বাপু এখানে আর আমার চাকরি করা। ভূতের আড্ডা! কে জানে কবে হয়ত আবার আমার ওপরেই চড়াও হবে! বাপ মা ছেলেপিলে ছেড়ে এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণটা শেষে কি খোয়াব?

চলুন শঙ্করবাবু, কোয়াটারে ফেরা যাক। সুব্রত বলে।

সকলে কুলী-ধাওড়া ছেড়ে কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল। সকলেই নীরবে পথ অতিবাহিত করে চলেছে, কারও মুখে কোন কথা নেই।

পথ চলতে চলতে একসময় বিমলবাবু বলল, বলছিলাম না, এই কোলফিল্ডটা একটা পরিপূর্ণ অভিশাপ! এখানে কারও মঙ্গল নেই। কিন্তু এবারে দেখছি আপনি স্যার বেঁচে গেলেন। এর আগের বারের আক্রোশগুলো ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়েই গেছে এবং আগেকার ঘটনা অনুযায়ী বিপদটা আপনার ঘাড়েই আসা উচিত ছিল। তা যাক, ভলই হল এক দিক দিয়ে।

তার মানে? সহসা সুব্রত প্রশ্ন করে বসল।

বিমলবাবু যেন সুব্রতর প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মানে—মানে আর কি! ওই কুলীগুলোর জীবনের আর কী দাম আছে বলুন? ওদের দু-দশটা মরলে কী এসে গেল!

সহসা স্তব্ধ রাতের মৌনতাকে ছিন্নভিন্ন করে সোহাগীর করুণ কান্নার আকুল রেশ কানে এসে বাজল সবার। ঝন্টু রে—তু ফিরে আয় রে! ওরে আমার ঝন্টু রে!

সুব্রতর পায়ের গতিটুকু যেন সহসা লোহার মত ভারী হয়ে অনড় হয়ে গেল। বিমলবাবুর দিকে ফিরে শ্লেষমাখা সুরে সে বলল, তা যা বলেছেন বিমলবাবু! দুনিয়ার আবর্জনা ওই গরীবগুলো। যাদের মরণ ছাড়া আর গতি নেই, এ সংসারে তারা মরবে বৈকি!

নিশ্চয়ই। আপনিই বলুন না, ওই জংলীগুলোর প্রাণের দাম কি-ই বা আছে? বিমল বলে ওঠে।

০৬. খাদে রহস্যময় মৃত্যু

বাকি রাতটুকু সুব্রতর চোখে আর ঘুম এল না। সে আবার অর্ধসমাপ্ত চিঠিখানা নিয়ে বসল।

কিরীটী, চিঠিটা তো শেষ করেই রেখেছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটা তোকে না লিখে পারলাম না। কুলী-ধাওড়ায় ঝন্টু নামে এক সাঁওতাল যুবক রাত্রে খুন হয়েছে। বিমলবাবু প্রমাণ করতে চান, ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভৌতিক। অর্থাৎ ভূতের কাণ্ড। তবে মৃতের গলার পিছনদিকে আগের মতই চারটি ভয়ঙ্কর কালো ছিদ্র আছে দেখলাম। আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন খুবই সহজ। জলের মতই সহজ।…তোর চিঠির প্রত্যুত্তরের আশায় রইলাম। চিঠি পেলেই ভাবছি শ্রীমানকে পুলিসের হাতে তুলে দেব। কেননা ওই ধরনের শয়তান খুনীদের এমন সহজভাবে দশজনের সঙ্গে চলে-ফিরে বেড়াতে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? আমার যতদূর মনে হয়, আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ব্যাপারটার একটা সহজ মীমাংসা করে দিতে পারব। তোর উপস্থিতির বোধ হয় আর প্রয়োজন হবে না। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা রইল। তোর সুব্রত।

চিঠিটা শেষ করে সুব্রত চেয়ার থেকে উঠে একটা আড়ামোড়া ভাঙল।

রাতের আকাশের বিদায়ী আঁধার দিগ্বলয়ের প্রান্তকে তখন ফিকে করে তুলেছে।

সুব্রত বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

শীতের হাওয়া ঝিরঝির করে সুব্রতর শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহমনকে যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।

ঘুমোননি বুঝি সুব্রতবাবু!

শঙ্করের গলার স্বর শুনে সুব্রত ফিরে দাঁড়াল।

এই যে আপনিও উঠে পড়েছেন দেখছি। ঘুমোতে পারলেন না বুঝি?

না, ঘুম এল না। কিন্তু গতরাত্রের ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি মনে হয় সুব্রতবাবু?

দেখুন শঙ্করবাবু, ব্যাপারটা যে খুব কঠিন বা জটিল তা কিছু নয়, তবে এটা ঠিক যে, এর আগে যে-সব খুন এখানে হয়েছে তার সমস্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে চট করে উপনীত হতে পারছি না। যতদূর মনে হয় এর পিছনে একটা দল আছে, অর্থাৎ একদল শয়তান এই ভয়ঙ্কর খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে।

বলেন কি?

হ্যাঁ, তাই। একজন লোকের ক্ষমতা নেই এত tactfully এতগুলো লোকের মধ্যে থেকে এমন পরিষ্কার ভাবে খুন করে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।

.

হাত-মুখ ধুয়ে চা পান করতে করতে শঙ্কর আর সুব্রত গতরাত্রের ঘটনারই আলোচনা করছিল, এমন সময় একটা কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির, বাবু গো, সর্বনাশ হয়েছে!

কি হয়েছে?

তের নম্বর কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে কাল রাত্রে দশজন সাঁওতাল কুলী মারা গেছে।

শঙ্কর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।

সর্বনাশ! এক রাত্রে দশ-দশটা লোকের একসঙ্গে মৃত্যু! কিন্তু রাত্রে তো এ মাইনে কাজ চালাবার কথা নয়? তবে—তবে কেমন করে এ দুর্ঘটনা ঘটল?

রেজিৎবাবু কোথায় রে টুইলা? শঙ্কর কুলীটাকে প্রশ্ন করল।

রেজিংবাবু তো ওধারপানেই আসতেছে দেখলুম বাবু। দেখা গেল সামনের অপ্রশস্ত কাঁচা কয়লার গুঁড়ো ছড়ানো রাস্তাটা ধরে একপ্রকার দৌড়তে দৌড়তে রামলোচন পোদ্দার আসছে। রামলোচনবাবু এসে শঙ্করের সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মোটাসোটা চর্বিবহুল নাদুসনুদুস চেহারাখানি, পরনে খাকি হাফ প্যান্ট ও খাকি হাফ শার্ট। ঠোঁটের ওপরে বেশ একজোড়া পাকানো গোঁফ। মাথায় সুবিস্তীর্ণ টাক চক্ করে। বয়েস বোধ করি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে।

এ কি শুনছি রামলোচনবাবু?

সর্বনাশ হয়ে গেছে, ঠিকই শুনেছেন স্যার–একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই খনি বুঝি আর চালানো গেল না!

সব খুলে বলুন।

কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে দশজন কুলী চাপা পড়ে মারা গেছে!

কাল রাত্রে মানে? অর্থাৎ আপনি বলতে চান রাত্রিতে কাল কয়লাখনিতে কাজ হচ্ছিল?

আজ্ঞে না।

আজ্ঞে না! তার মানে? এই তো বললেন কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে দশজন মারা গেছে!

আজ্ঞে তা তো গেছেই–

খনিতে কয়লা কাটার কাজ না থাকলে কেন তারা সেখানে গিয়েছিল? নিশ্চয়ই খনির মধ্যে লুকোচুরি খেলতে নয়? এ খনির নিয়ম কি? পাঁচটার মধ্যে খনির সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায় তো? রাত্রে কোন কাজ হয় না?

আজ্ঞে!

তবে তারা রাত্রে খনির মধ্যে কি করে গেল? চানক সন্ধ্যা পাঁচটার পর খাদে লোক নামায় না তো!

না, তা নামায় না। এবং রাত্রি সাতটা পর্যন্ত চানক ভোলা থাকে খাদের লোক শুধু ওঠাবার জন্য।

এমনও তো হতে পারে শঙ্করবাবু, সেই দশটি লোক গত রাত্রে খাদ থেকে মোটে ওঠেইনি, খাদেই ছিল? হঠাৎ সুব্রত বলে।

Impossible! খনির কুলিদের নামের একটা লিস্ট আছে। খাদে যারা নামে ও কাজশেষে খাদ থেকে উঠে আসে, নামের Registry-র সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয় তাদের নাম। এতে ভুলচুক হওয়া সম্ভব নয় সুব্রতবাবু!

কিন্তু আগে সব কিছুর খোঁজ নেওয়া দরকার শঙ্করবাবু। চলুন দেখা যাক খোঁজ নিয়ে আসলে ব্যাপারটা কি?

বেশ, চলুন।

তখনি দুজন রামলোচন ও টুইলাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

পথ চলতে চলতে সুব্রত শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করল, নামের রেজিস্ট্রি খাতা কার কাছে থাকে শঙ্করবাবু?

সরকারবাবু—আমাদের বিমলবাবুর কাছে থাকে।

তিনি তো নাম মিলিয়ে নেন?

হ্যাঁ।

তবে আগে চলুন বিমলবাবুর খোঁজটা নেওয়া যাক, তিনি হয়তো এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।

চলুন।

শীতের সকাল। পথের দুপাশের কচি দূর্বাদলগুলির গায়ে রাতের শিশিরবিন্দুগুলি সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে।

কিছুদূর এগিয়ে যেতেই খনির সীমানা পড়ে। ট্রাম-লাইনের পাশে একটা শূন্য কয়লা গাড়ির চারদিকে একদল সাঁওতাল জটলা পাকাচ্ছে, সকলেরই মুখে একটা ভয়চকিত ভাব।

শঙ্করকে আসতে দেখে দলের মধ্যে একটা মৃদু গুনগুন ধ্বনি জেগে উঠল।

কুলীদের সর্দার রতন মাঝি এগিয়ে এল।

কি খবর মাঝি? কিছু বলবি?

আমরা আর ইখানে কাম করতে পারব বাবু!

কেন রে?

ই খনিতে ভূত আছে, বাবু।

ভূত? ওসব বাজে কথা, তাছাড়া কার ছেড়ে দিলে খাবি কি?

কিন্তক তুরাই বল কেনে বাবু, প্রাণটি হাতে নিয়ে এমনি করে কেমনে কাজ করি—

চন্দন সিং ও বিমলবাবু এসে হাজির হলেন।

এই যে বিমলবাবু, কাল রেজিস্ট্রি খাতা আপনি মিলিয়েছেন তো? শঙ্কর প্রশ্ন করল।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সকলে খাদ থেকে উঠে এসেছিল working hours-এর পরে–মানে যারা কাল দিনের বেলায় কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিল, তারা সকলে আবার খাদ থেকে ফিরে এসেছিল তো?

তা এসেছিল বৈকি।

তবে এই রকম দুর্ঘটনা ঘটল কি করে? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই? চানক যে চালায় সে লোকটা কোথায়?

কে, আবদুল?

হ্যাঁ।

সে চানকের মেসিনের কাজেই আছে।

তাকে একবার ডেকে আনুন।

বিমলবাবু আবদুল ডাকতে চলে গেলেন।

রতন মাঝি আবার এগিয়ে এল, বাবু, আমরা কুলীকামিনরা আজ চলে যাবে রে!

তোদের কোন ভয় নেই। দুটো দিন সবুর কর, আমি সব ঠিক করে দেব। ভূতটুত ওসব যে একদম বাজে কথা, এ আমি ধরে দেব। যা তোরা যে যার কাজে যা!

কিন্তু দেখ গেল শঙ্করের আশ্বাসবাক্যেও কেউ কাজে যাবার কোন গরজই দেখাচ্ছে না।

তু কি বলছিস বাবু, আমি বোঙার নামে কিরা কেটে বলতে পারি এ খনিতে ভূত আছে!

এমন সময় বিমলবাবু আবদুল মিস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।

আবদুলকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত সন্ধ্যায় সে যথারীতি আটটার মধ্যেই চানক বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং সে যতদূর জানে খাদে আর কেউ তখন ছিল না।

চানকের এঞ্জিনে চাবি দেওয়া থাকে না মিস্ত্রী?

জিজ্ঞাসা করল সুব্রত।

হ্যাঁ, সাবু।

চাবি কার কাছে থাকে?

আজ্ঞে আমার কাছেই তো।

আচ্ছা আজ সকালে চানকের এঞ্জিনের কাছে গিয়ে এঞ্জিনে চাবি দেওয়াই দেখতে পেয়েছিলে তো?

হ্যাঁ, সাব।

চলুন শঙ্করবাবু, খাদের যে কাঁথিতে পিলার ধসে গেছে সে জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসি।

বেশ, চলুন। আসুন বিমলবাবু, চল চন্দন সিং।

তখন সকলে মিলে খাদের দিকে রওনা হল।

০৭. নেকড়ার পুঁটলি

এক, দো, তিন!!!

কয়লা খাদের মুখে অসেটার ঘণ্টা বাজালে, এক, দো, তিন–

ঠং ঠং ঠং।…ঘণ্টার অদ্ভুত আওয়াজ, এক দো তিন বলবার সঙ্গে সঙ্গে গম্ গম্ ঝন্ ঝন্ করে চানকের গহ্বরের স্তরে স্তরে প্রতিধ্বনিত হল।

পাতালপুরীর অন্ধ গহ্বর থেকে যেন মরণের ডাক এল—আয়! আয়! আয়!

এ যেন এক অশরীরী শব্দমুখর হাতছানি।

রেজিংবাবু রামলোচন পোদ্দার চানকের মুখে আগে এসে দাঁড়াল।

তিন ঘণ্টার মানে মানুষ এবারে খাদে চানকের সাহায্যে নামবে তারই সংকেত।

চানকের রেলিং-ঘেরা খাঁচার মত দাঁড়াবার জায়গায় শঙ্কর, রেজিংবাবু, সুব্রত, রতন মাঝি ও আরও দুজন সদার গ্যাসল্যাম্প নিয়ে প্রবেশ করল।

অন্ধকার গহর-পথে ঘড়ঘড় শব্দে চানক নামতে শুরু করল।

বাইরের রৌদ্রতপ্ত পৃথিবী যেন সহসা সামনে থেকে ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।

উপরের সুন্দর পৃথিবী যেন খাদের এই বীভৎস অন্ধকারের সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে দূরে সরে গেছে।

সকলে এসে খাদের মধ্যে নামল।

কঠিন স্তব্ধ অন্ধকার। কালো কয়লার দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মিশে এক হয়ে গেছে।

মৌন আঁধারের মধ্যে শীতটা যেন আরও জমাট বেঁধে উঠেছে। সদার তিনজন গ্যাসল্যাম্প হাতে এগিয়ে চলল পথপ্রদর্শক হয়ে, অন্য সকলে চলল পিছু পিছু। সম্মুখে ও আশেপাশে কালো কয়লার দেওয়ালে সামান্য যেটুকু আলো গ্যাস-ল্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ছে, তা ছাড়া চারিদিকে কঠিন মৌন অন্ধকার যেন কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় হাঁ করে গিলতে আসছে।

সকলের পায়ের শব্দ অন্ধকারের বুকে শুধু যেন জীবনের একমাত্র সাড়া তুলছে। এবং মাঝে মাঝে দু-একটা কথার টুকরো আর কাটা কাটা শব্দ।

সহসা রতন মাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াল।

১৩নং কাঁথিতে যাবার মেন গ্যালারী এইটাই নাহি মাঝি? প্রশ্ন করলেন বিমলবাবু।

আজ্ঞে বাবু।

চালটা এখানে একটু খারাপ আছে না?

আজ্ঞে।

এখানে একটু সাবধানে আসবেন ম্যানেজারবাবু। এপাশের লোকেশন্টার কি ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখেছেন স্যার? শঙ্কর নীরবে পথ চলতে লাগল। বিমলবাবুর কথার কোন জবাব দিল না।

পথের মধ্যে জল জমে আছে। সেই জল আশেপাশে দেওয়ালের গা বেয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে। জলের মধ্য দিয়ে হাঁটার পর্দন জলের সপসপ শব্দ হতে লাগল।

আরও খানিকটা এগিয়ে মাঝি একটা সরু সুড়ঙ্গ-পথের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, সামনেই গ্যাস-ল্যাম্পের স্রিয়মান আলোয় এক অপ্রশস্ত গুহাপথ যেন হাঁ করে মৃত্যুক্ষুধায় ওৎ পেতে আছে।

এই তেরো নম্বর কাঁথি সাব। রতন মাঝি বললে।

হাতের গ্যাসল্যাম্পটা আরও একটু উঁচু করে সুড়ঙ্গ-পথের দিকে মাঝি পা বাড়াল, যাইয়ে সাব।

সুড়ঙ্গ-পথে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া গেল না। প্রকাণ্ড একটা কয়লার চাংড়া ধসে পড়ে পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। এবং সেই চাংড়ার তলা থেকে একটা সাঁওতাল যুবকের দেহের অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। বুক পিঠ এক হয়ে গেছে। কান ও মুখের ভিতর দিয়ে এক ঝলক রক্ত বের হয়ে এসে কালো কয়লা ঢালা পথের ওপরে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। পাশেই একটা লোহার গাঁইতি পড়ে আছে।

সকলে স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। শুধু একসময় শঙ্করের বুকখানা কাঁপিয়ে একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।

প্রথমেই কথা বললেন বিমলবাবু, Rightly served! কথাটা যেন একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতই সকলের অন্তরে গিয়ে বিঁধল।

বেটারা নিশ্চয়ই চুরি করে রাত্রে কয়লা তুলতে এসেছিল! কথাটা বললেন রেজিংবাবু রামলোচন পোদ্দার।

কিন্তু কোন্ পথে কেমন করে ওরা এল বলুন তো? প্রশ্ন করলে সুব্রত, চানকে তো চাবি দেওয়াই ছিল।

ভূতুড়ে মশাই। সব ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা। বললে তো আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন না মশাই। ভূতের কখনো চাবির দরকার হয়? এখন দেখুন। চানকে চাবি দেওয়া রইল, অথচ এরা দিব্যি খাদের মধ্যেই এসে ঢুকল এবং মারা গেল। বিমলবাবু বললেন।

হুঁ, চলুন এবারে ফেরা যাক। আর এখানে থেকে কী হবে? চল মাঝি, শঙ্কর বললে। .. সকলে আবার ফিরে চলল। সুব্রত সকলের পিছনে চিন্তাকুল মনে অগ্রসর হল। সহসা অন্ধকারে পায়ে কী ঠেকতে তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে দেখতেই কী যেন অন্ধকারে পথের ওপরে হাতে ঠেকল। সুব্রত নিঃশব্দে সেটা হাতে তুলে নিয়ে আবার পথ চলতে লাগল।

বস্তুটা কাপড়ের পুঁটলি।

সুব্রত পুঁটলিটা জামার পকেটে ভরে নিল।

সকলে এসে আবার চানকের মুখে উপস্থিত হল।

অনসেটার আবার ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে চানকের সাহায্যে খাদের উপরে তুলে নিল।

সেদিনকার মত খাদের কাজ বন্ধ রাখবার আদেশ দিয়ে শঙ্কর বাংলোয় ফিরে এল। এক রাতের মধ্যে এতগুলো পর পর মৃত্যু শঙ্করকে যেন দিশেহারা করে দিয়েছে। কী এখন সে করবে? কোন্ পথে কাজ শুরু করবে? বাংলোয় ফিরে খনির কর্তা সুধাময় চৌধুরীর কাছে একটা জরুরী তার করে দিল।

০৮. পুঁটলি-রহস্য

সুব্রত এসে বাংলোয় নিজের ঘরে ঢুকল।

নানা এলোমেলো চিন্তায় সেও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নিছক একটা অ্যাকসিডেন্ট, না অন্য কিছু! কিন্তু সবচাইতে আশ্চর্য লোক গেল কী করে খাদের মধ্যে?

নাঃ, ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়। চাকরকে এক কাপ গরম চা দিতে বলে শঙ্কর ইজিচেয়ারটার ওপরে গা-টা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল।

চিন্তা করতে করতে কখন একসময় জাগরণ-ক্লান্ত দুচোখের পাতায় ঘুমের দুলুনি নেমেছে তা ও টেরই পায়নি। ভৃত্যের ডাকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল।

বাবুজি, চা!

ভৃত্যের হাত থেকে ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে সামনের একটা টিপয়ের ওপরে সুব্রত নামিয়ে রাখল।

ভৃত্য ঘরে থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

খোলা জানালাপথে রৌদ্রঝলকিত শীতের সুন্দর প্রভাত। দূরে কালো পাহাড়ের অস্পষ্ট ইশারা। ওদিকে ট্রাম লাইনে পর পর কখানা খালি টবগাড়ি। কয়েকটা সাঁওতাল যুবক সেখানে, দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। চা পান শেষ করে সুব্রত উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা এঁটে জামার পকেট থেকে খনির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া নাকড়ার ছোট পুঁটলিটা বের করল।

একটা আধময়লা রুমালের ছোট পুঁটলি।

কম্পিত হস্তে সুব্রত পুঁটলিটা খুলে ফেলল।

পুঁটলিটা খুলতেই তার মধ্যকার কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা মাঝারি গোছের ডিনামাইট, একটা পলতে, একটা টর্চ।

আশ্চর্য, এগুলো খনির মধ্যে কেমন করে গেল!

ডিনামাইট কেন? সুব্রত ভাবতে লাগল। ডিনামাইট সাধারণত খাদের মধ্যে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধসাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সঙ্গে পলতেও একটা দেখা যাচ্ছে। এই ডিনামাইটের সঙ্গে পলতের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধসানোর সুবিধা হয়।

টর্চ! এটা বোধ হয় অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এইসব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধসাতে? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু ধসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে, তবে এগুলো সেখানে ফেলে এল কেন? তবে কি ধসায়নি? না। ধসিয়ে চলে এসেছিল? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, আরও ডিনামাইট আরও পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেতে এটার আর কোন দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে। কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢোকবার তো মাত্র একটিই পথ! চানকের সাহায্যে? চানকের চাবি কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রী বললে তার কাছেই থাকে। চাবিটা এমন কোন মূল্যবান চাবি নয়; টাকাকড়ির সিন্দুকের চাবি নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবি নয়, সামান্য চানকের চাবি। চাবিটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয় এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবিটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়—মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি—সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু রুমালটা! রুমালটা কার? সুব্রত রুমালখানি সোজা দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুত্থানুরূপে পরীক্ষা করতে লাগল।

রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংক্লথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালের একধারে ছোট অক্ষরে লাল সুতোয় লেখা ইংরাজী অক্ষর S. c.

এক কোণে ধোপর চিহু রয়েছে…।

সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জট পাকাতে লাগল। কার রুমাল! কার রুমাল! S.C. নামের initial যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শঙ্কর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশী, শচীন, কিংবা শৈলেশ, কিংবা সনং, সুকুমার, সমীর, সুধাময়! কে, কে? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, অন্য কারও রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল! তবে?

সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক আসতেই হবে। সে আসবে! আসবে!

অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

সুব্রত চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে। বাইরে গোলমাল শোনা গেল।

পুলিসের লোক এসে গেছে অদূরবর্তী কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।

চঞ্চল পদে পুঁটলিয়া আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।

দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দি নিয়ে, ধাওড়ার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাশগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শঙ্করবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।

সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল, এখানে ইতিপূর্বে যেসব ম্যনেজার খুন হয়েছেন তাঁদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলি সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান তবে তার বড় উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, এ-কথা বলতে! আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হয়ে কত যে সুখী হলাম! কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।

সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিসের লোক হয়েও যে আপনি এতখানি উদার, সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। কিরীটী যদি এখানে আসে তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাব। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা নমস্কার।

০৯. আঁধার রাতের পাগল

সুব্রত শঙ্করবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।

বিকেলের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেন: কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কতার হুকুম আছে, কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক, খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।

রাতে শঙ্কর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু? কাল থেকে তাহলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?

হ্যাঁ, দিন। দু-চারদিনের মধ্যে আমার তো মনে হয় আর খুনটুন হবে না।

শঙ্কর হাসতে হাসতে বললে, আপনি শুনতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?

না, গুনতে-ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।

যাহোক, শঙ্কর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামীকাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয় সেই আদেশ দিয়ে দিল।

বিমলবাবু কাঁচুমাচু ভাবে বললে, আবার ঐ ভূতপ্রেতগুলোকে চটাবেন স্যার! আমি আপনার most obedient servent, যা order দেবেন—with life তাই করব। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মত একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার।

ভূতপ্রেতের ব্যাপার! কখন কি ঘটে যায়!

শঙ্কর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান, সব ব্যবস্থা করুন গে, যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু হতে পারে।

কিন্তু স্যার—

যান যান, রাত হয়েছে। সারারাত কাল ঘুমুতে পারিনি।

বেশ। তবে তাই হবে। আমার আর কি বলুন? আমি আপনাদের most obedient and humble servent বইতো নয়!

বিমলবাবু চলে গেলেন।

বাইরে শীতের সন্ধ্যা আসন্ন হয়ে এসেছে। সুব্রত কোমরে রিভালবারটা খুঁজে গায়ে একটা কালো রংয়ের ফারের ওভারকোট চাপিয়ে পকেটে একটা টর্চ নিয়ে বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়াল।

পায়ে-চলা লাল সুরকির রাস্তাটা কয়লা-তঁড়োয় কালচে হয়ে ধাওড়ার দিক বরাবর চলে গেছে।

সুব্রত এগিয়ে চলে। পথের দুপাশে অন্ধকারের মধ্যে বড় বড় শাল ও মহুয়ার গাছগুলো প্রেতমূর্তির মত নিঝুম হয়ে যেন শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। পাতায় পাতায় জোনাকির আলল, জ্বলে আর নেভে, নেভে আর জ্বলে। গাছের পাতা দুলিয়ে দূর প্রান্তর থেকে শীতের হিমেল হাওয়া হিলহিল করে বয়ে যায়।

সর্বাঙ্গ সিরসির করে ওঠে।

কোথায় একটা কুকুর শীতের রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে।

সুব্রত এগিয়ে চলে।

অদূরে পাঁচ নম্বর কুলি-ধাওড়ার সামনে সাঁওতাল পুরুষ ও রমণীরা একটা কয়লার অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে চারিদিকে গোলাকার হয়ে ঘিরে বসে কী সব শলা-পরামর্শ করছে। আগুনের লাল আভা সাঁওতাল পুরুষগুলোর খোদাই করা কালো পাথরের মত দেহের ওপর প্রতিফলিত হয়ে দানবীয় বিভীষিকায় যেন রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

তারও ওদিকে একটা বহু পুরাতন নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ শীতের ধূম্রাচ্ছন্ন অন্ধকারে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই অস্পষ্ট মনে হয়।

চারিদিকে বোয়ান গাছের জঙ্গল, তারই পাশ দিয়ে শীর্ণকায় একটি পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদী, আর শুষ্কপ্রায় শুভ্র বালুরাশির উপর দিয়ে একটুখানি নির্মল জলপ্রবাহ শীতের অন্ধকার রাতে এঁকেবেঁকে আপন খেয়াল-খুশিতে অদূরবর্তী পলাশবনের ভিতর দিয়ে ঝিরঝির করে কোথায় বয়ে চলেছে কে জানে!

পলাশবনের উত্তর দিকে ছয় ও সাত নম্বর কুলি-ধাওড়া। সেখান থেকে মাদল ও বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়।

সহসা অদূরবর্তী মহুয়া গাছগুলির তলায় ঝরাপাতার ওপরে একটা যেন সজাগ সতর্ক পায়ে চলার খস শব্দ পেয়ে সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

বুকের ভিতরকার হৃৎপিণ্ডটা যেন সহসা প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে থমকে থেমে গেল। পকেটে হাত দিয়ে সুব্রত টটা টেনে বের করল। যে দিক থেকে শব্দটা আসছিল ফস করে সেই দিকে আলোটা ধরেই বোম টিপে দিল।

অন্ধকারের বুকে টর্চের উজ্জ্বল আলোর রক্তিম আভা মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে অট্টহাসি হেসে ওঠে।

কিন্তু ওকে? অন্ধকারেপলাশ গাছগুলোর তলায় বসে অন্ধকারে কী যেন গভীর মনেযোগের সঙ্গে খুঁজছে।

আশ্চর্য!

এই অন্ধকারে, পলাশবনের মধ্যে অমন করে লোকটা কি খুঁজছে?

সুব্রত এগিয়ে গেল।

লোকটা বোধ করি পাগল হবে।

একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া এলোমেলো বিশ্বস্ত জট-পাকানো চুল। মুখ ধুলোবালিতে ময়লা হয়ে গেছে এবং মুখে বিশ্রী দাড়ি। গায়ে একটা বহু পুরাতন ওভারকোট; শতছিন্ন ও শত জায়গায় তালি দেওয়া। পিঠে একটা নেকড়ার ঝুলি, পরনেও একটা মলিন লংস।

সুব্রত টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।

এই, তুই কে রে? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।

কিন্তু লোকটা কোন জবাবই দেয় না সুব্রতর কথায়, শুকনো ঝরে-পড়া শালপাতাগুলো একটা ছোট লাঠির সাহায্যে সরাতে সরাতে কী যেন আপন মনে খুঁজে বেড়ায়।

এই, তুই কে?

সুব্রত টর্চের আলোটা লোকটার মুখের উপর ফেলে। সহসা লোকটা চোখ দুটো বুজিয়ে চকে দুপাটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

লোকটা কেবল হাসে।

হাসি আর যেন থামতেই চায় না। হাসছে তো হাসছেই। সুব্রতও সেই হাসিভরা মুখটার ওপরে আলো ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিতান্ত বোকার মতই চুপ করে!

সুব্রত আলোটা নিভিয়ে দিল।

সহসা লোকটা ভাঙা গলায় বলে ওঠে, তু কি চাস বটে রে বাবু!

সুব্রত বোঝে লোকটা সাঁওতাল, বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।

তোর নাম কি? কোথায় থাকিস?

আমার নাম রাজা বটে!…থাকি উই—যেথা মারাংবরু রঁইছে।

এখানে এই অন্ধকারে কি করছিস?

তারে তুর দরকারটা কী? যা ভাগ!

সুব্রত দেখলে সরে পড়াই ভাল। পাগল। বলা তো যায় না! সুব্রত সেখান থেকে চলে এল।

পলাশবন ছাড়লেই ৬নং কুলির ধাওড়া।

রতন মাঝি সেখানেই থাকে। পলাশ ও শাল বনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুলি-ধাওড়ার সামনে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের লাল রক্ত আভাস।

মাদলের শব্দ কানে এসে বাজে, ধিতাং ধিতাং!

সঙ্গে সঙ্গে বাঁশিতে সাঁওতালী সুর।

সারাদিন খাদে ছুটি গেছে, সব আনন্দে উৎসবে মত্ত হয়ে উঠেছে।

ধাওড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা কালো কুকুর ঘেউ-উ-উ করে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি সাঁওতাল যুবক এগিয়ে এল, কে বটে রে? আঁধারে ঠাওর করতে পারছি। রা করিস না কেনে?

রতন মাঝি আছে? সুব্রত কথা বলে।

আরে, বাবু! ও পিন্টু, বাবুকে বসবার দে। বসেন আইজ্ঞা। রতন মাঝি সুব্রতর সামনে এগিয়ে আসে।

আধো আলো আধো আঁধারে মাঝির পেশল কালো দেহটা একটা যেন প্রেতের মতই মনে হয়।

কিছু সংবাদ আছে মাঝি?

না বাবু। সারাটি দিনমানই রইলাম বটে।

সুব্রত আরও কিছুক্ষণ রতন মাঝির সঙ্গে দু-চারটে আবশ্যকীয় কথা বলে ফিরল।

১০. অদৃশ্য আততায়ী

সেই আগেকার পথ ধরেই সুব্রত আবার ফিরে চলেছে। আকাশে কাস্তের মত সরু একফালি চাঁদ জেগেছে; তারই ক্ষীণ জোৎস্না শীতার্ত ধরণীর ওপরে যেন স্বপ্নের মতই একটা আলোর ওড়না বিছিয়ে দিয়েছে। পলাশ ও মহুয়াবনে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো চাঁদের আলোর আলপনা। বনপথে যেন আলোর আলপনা ঢাকাই বুটি বুনে দিয়েছে। মাদল ও বাঁশির শব্দ তখনও শোনা যায়।

সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবেই ধীরে ধীরে পথ চলছিল, সহসা সোঁ করে কানের পাশে একটা তীব্র শব্দ জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই স্তব্ধ আলোছায়া-ঘেরা বনতল প্রকম্পিত করে বন্দুরে আওয়াজ জেগে উঠল: গুড়ুম! এবং সঙ্গে সঙ্গে কার যেন আর্ত চিৎকার কানে এল। সুব্রত থমকে হতচকিত হয়ে যেন থেমে গেল।

প্রথমটা সে এতখানি বিচলিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ব্যাপারটা যেন ভাল করে কোনো কিছু বুঝে উঠতেই পারে না। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে কোমরবন্ধে লোডেড রিভলবারটা ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে যেদিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছিল সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। কিছু দেখা যায় না বটে তবে শুকনো পাতার ওপরে একটা ঝটাপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সুব্রত রিভলভারটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে টটা জ্বালল এবং টর্চের আলো ফেলে সন্তর্পণে এগিয়ে গেল, শব্দটা যে দিক থেকে আসছিল সেই দিকে।

অল্প খুঁজতেই সুব্রত দেখলে একটা পলাশ গাছের তলায় কে একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে।

সুব্রত লোকটার গায়ে আলো ফেললে। লোকটা একজন সাঁওতাল যুবক। লোকটার ডানদিকের পাঁজরে গুলি লেগেছে। তাজা লাল টকটকে রক্তে বনতলের মাটির অনেকটা সিক্ত হয়ে উঠেছে। লোকটার পাশেই একটা সাঁওতালী ধনুক ও কতকগুলো তীর পড়ে আছে। সুব্রত লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু সাঁওতালটাকে চিনতে পারল না। লোকটা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দু-একবার ক্ষীণ অস্ফুট স্বরে কী যেন বিড়বিড় করে বলতে বলতে হতভাগ্য শেষ নিঃশ্বাস নিল।

সুব্রত নেড়েচেড়ে দেখল, শেষ হয়ে গেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস সুব্রতর বুকখানাকে কাঁপিয়ে বের হয়ে গেল।

সে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলো ফেলে ফেলে আশেপাশের বন ও ঝোপঝাড় দেখলে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

হতভাগা সাঁওতালটা বন্দুকের গুলি খেয়ে মরেছে এবং স্বকর্ণেসে বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনতে পেয়েছে।

কিন্তু কে মারলে? কেনই বা মারলে?

নানাবিধ প্রশ্ন সুব্রতর মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল। কিন্তু এটা ঠিক, যে-ই মেরে থাক সে সশস্ত্র।

অন্ধকার বনপথে সুব্রতর কাছেলোডেড রিভলবার থাকলেও সে একা। তার উপর এখানকার পথঘাট তার তেমন ভাল চেনা নয়। অলক্ষ্যে বিপদ আসতে কতক্ষণ? আর বিপদ যদি আচমকা অন্ধকারে আশপাশ থেকে এসেই পড়ে তবে তাকে ঠেকানো যাবে না। অথচ এত বড় একটা দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এমনি করে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। অতএব এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।

সুব্রত সজাগ হয়ে উঠল। টর্চের আলো জ্বেলে সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকেদেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলল। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!

কেবলই একজনের পর একজন খুনই হচ্ছে! কারা এমনি করে নৃশংসভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে?

কিসের প্রয়োজনেই বা এমনি ভয়ঙ্কর খেলা? কিন্তু পথ চলতে একটু আগে যে সোঁ করে শব্দটাকে সে কানের পাশে শুনেছিল সেটাই বা কিসের শব্দ?

কিসের শব্দ হতে পারে? নানারকম ভাবতে ভাবতে সুব্রত অন্ধকার শালবনের পধ ধরে যেন বেশ একটু দ্রুতপদেই অগ্রসর হতে থাকে।

রাত্রি কটা বেজেছে কে জানে! আসবার সময় তাড়াতাড়িতে হাতঘড়িটা পর্যন্ত আনতে মনে নেই। খানিকটা দ্রুত হেঁটে শালবন পেরিয়ে সুব্রত পাহাড়ী নদীটার ধারে এসে দাঁড়াল। মাথার উপরে আকাশের বুকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় যেন একটা সূক্ষ্ম রূপালি পর্দা থিরথির করে কাঁপছে। কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র নেই। দূরে সাঁওতাল ধাওড়া থেকে একটানা একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

শীতের পাহাড়ী নদী, একেবারে জল নেই বললেই হয়। অনেকটা পর্যন্ত শুধু বালি আর বালি। নদীটা হেঁটেই সুব্রত পার হয়ে গেল।

সামনেই একটা প্রান্তর। প্রান্তর অতিক্রম করে সুব্রত চলতে লাগল।

আনমনে চিন্তা করতে করতে কতটা পথ সুব্রত এগিয়ে এসেছে তা টের পায়নি, সহসা অদূরে আবছা চাঁদের আলোয় প্রান্তরের মাঝখানে দৃষ্টি পড়তেই সুব্রত থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

এখানে আসবার পরের দিন সন্ধ্যার দিকে প্রান্তরের মাঝে বেড়াতে বেড়াতে যে ভয়ঙ্কর মৃর্তিটা দেখেছিল অবিকল সেই মূর্তিটাই যেন লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে জনহীন মৃদু চন্দ্রালোকে প্রান্তরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলেছে।

সুব্রত ক্ষণেক দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল, তারপরই কোমরের লেদার কেস থেকে অটোমেটিক রিভলবারটা বের করে অদূরের সেই চলমান মৃর্তিটাকে লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল।

নির্জন প্রান্তরের অন্ধকারে একঝলক আগুনের শিখা উদগিরণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে একটা আওয়াজ ওঠে—গুড়ুম!

সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তরকে ভয়চকিত করে ক্ষুধিত শার্দুলের ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল। পর পর তিনবার।

চমকে উঠতেই সুব্রত চকিতের জন্য চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে ফেলেছিল; কিন্তু পরক্ষণেই

যখন চোখের পাতা খুলল, দেখল, দ্রুত হাওয়ার মতই সেই মূর্তি ক্রমে দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মূর্তিটিকে যে জায়গায় দেখা গিয়েছিল সেই দিকে লক্ষ্য করে সুব্রত রিভলবারটা হাতে নিয়ে দৌড়ল।

আন্দাজমত জায়গায় এসে পৌঁছে সুব্রত টচটা জ্বেলে চারিদিকের মাটি ভাল করে লক্ষ্য করে দেখতে লাগল।

সহসা ও লক্ষ্য করলে, প্রান্তরের শুকনো মাটির ওপরে তাজা রক্তের কয়েকটা ফোঁটা ইতস্তত দেখা যাচ্ছে।

রক্ত! তাজা রক্তের ফোঁটা!

তাহলে সত্যিই ভূত নয়, দৈত্য দানব বা পিশাচ নয়! সামান্য রক্তমাংসের দেহধারী মানুষ। কিন্তু জখম হয়নি। সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। কিন্তু পালাবে কোথায়?

এই যে মাটির ওপরে রক্তের ফোঁটা ফেলে গেল এইটাই তার নিশানা দেবে যেখানে যতদূর পালাক না কেন, হাওয়ায় উবে যেতে পারবে না।

একদিন না একদিন ধরা দিতেই হবে। কেননা আঘাত যত সমান্য হোক না কেন, আহত হয়েছে এ অবধারিত এবং সেইজন্যই বেশী দূর পালানো সম্ভব হবে না।

কিন্তু শার্দুলের ডাক! ব্যাপারটা কী? অবিকল শার্দুলের ডাক! সহসা সোঁ-সোঁ করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ সুব্রতর কানের পাশ দিয়ে যেন বিদ্যুতের মত চকিতে মিলিয়ে গেল।

সুব্রত চমকে উঠে একলাফে সরে দাঁড়াল। এবং সরে দাঁড়াতে গিয়েই পাশে অদূরে মাটি দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট তীরের ফলা অর্ধেক মাটির বুকে প্রোথিত হয়ে থিরথির করে কাঁপছে।

সুব্রত নীচু হয়ে হাত দিয়ে তীরটা ধরে এক টান দিয়ে মাটির বুক থেকে তুলে নিল।

তীরের তীক্ষ্ণ চেপ্টা অগ্রভাগে মাটি জড়িয়ে গেছে। এতক্ষণে সুব্রত বুঝতে পারলে, একটু আগে শালবনের মধ্যে অতর্কিতে যে শব্দ শুনেছিল সেও একটা তীর ছোটারই শব্দ এবংসেই তীরটাও তাকে মারবার জন্যই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বুঝতে আর কষ্ট হয় না।

শত্রুপক্ষ তাহলে সুব্রতর ওপরে বিশেষ নজর রেখেছে এবং তাকে মারবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে! তীরটা হাতে নিয়ে সুব্রত সটান বাংলোর দিকে পা চালিয়ে দিল।

সুব্রত এসে বাংলোয় যখন প্রবেশ করল, শঙ্কর তখন ঘরে টেবিলের ওপরে একরাশ কাগজপত্র ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে।

শঙ্করবাবু! সুব্রত ঘরের মধ্যে পা দিয়ে ডাকল।

কে? ও, সুব্রতবাবু! এত রাত করে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম ঐ নদীর দিকটায়।

সামনেই একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে সুব্রত পা দুটো টান করতে করতে বললে।

এতক্ষণ এই অন্ধকারে সেখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ।

কথাটা বলে সুব্রত হাতের তীরটা টেবিল-ল্যাম্পের অত্যুজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে  তুলে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।

সুব্রতর হাতে তীরটা দেখে শঙ্কর সবিস্ময়ে বললে, ওটা আবার কী? কোথায় পেলেন?

সুব্রত তীরটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে করতেই মৃদু স্বরে জবাব দিল, মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে।

মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে তীর পেলেন! তার মানে?

শঙ্কর বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল।

মানে আবার কী? কেন, মাঠের মধ্যে একটা তীর কুড়িয়ে পেতে নেই নাকি?

শঙ্কর এবারে হেসে ফেললে, তা তো আমি বলছি না, আসল ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

আমার কী মনে হয় জানেন? সুব্রত বললে শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ।

কী?

এই তীরের ফলায় নিশ্চয়ই কোনো তীব্র বিষ মাখানো আছে এবং সে বিষ সাধারণ কোনো সুস্থ মানুষের শরীরের রক্তে প্রবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু অবধারিত।

কি বলছেন সুব্রতবাবু?

শঙ্কর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

মনে হওয়ার কারণ আছে শঙ্করবাবু। সুব্রত গম্ভীর স্বরে বললে।

বুঝতে পারছি না ঠিক আপনার কথা সুব্রতবাবু!

কোনো এক হতভাগ্যের উদ্দেশ্যে এই বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে তার জীবনের ওপরে attempt করা হয়েছিল।

সর্বনাশ! বলেন কী?

হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে, অর্থাৎ বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব কিছু বলবার আগে এক কাপ চা। দীর্ঘ পথ হেঁটে গলাটা শুকিয়ে গেছে।

O Surely! এখুনি। বলতে বলতে শঙ্কর সামনের টেবিলের ওপরে রক্ষিত কলিং বেল টিপল।

ভৃত্য এসে খোলা দরজার ওপরে দাঁড়াল।—সাহেব আমাকে ডাকছেন?

এই, শীগগির সুব্রতবাবুকে এক কাপ গরম চা এনে দে!

আনছি সাহেব। ভৃত্য চলে গেল।

ভৃত্যকে চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর দেখলে, চেয়ারের ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সুব্রত গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।

১১. ময়না তদন্তের রিপোর্ট

টেবিলের ওপর সুব্রতর আনীত তীরটা পড়েছিল। শঙ্কর সেটা টেবিলের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে লাগল।

তীরটা ছুঁড়ে কোনো এক হতভাগ্যের life-এর ওপর নাকি attempt করা হয়েছিল? কে attempt করল? কার life-এর ওপরেই বা attempt করল? কেনই বা attempt করল? আশ্চর্য!

সহসা একসময় সুব্রত চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে শঙ্করের হাতে তীরটা দেখতে পেয়ে চমকে বলে উঠল, আরে সর্বনাশ! করছেন কী? তারপর কী একটা বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন! রাখুন রাখুন, তীরটা রেখে দিন। কে জানে কী ভয়ঙ্কর বিষ তীরের ফলায় মাখানো আছে!

শঙ্কর একপ্রকার থতমত খেয়ে তীরটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।

এমন সময় ভৃত্য গরম চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে কাপটা টেবিলের ওপরে সুব্রতর সামনে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। সুব্রত ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিল।

আঃ! একটা আরামের নিঃশ্বাস ছেড়ে সুব্রত শঙ্করের মুখের দিকে তাকাল। ওই যে তীরটা দেখছেন শঙ্করবাবু, একটু আগে কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী ওটা ছুঁড়ে আমাকে ভবপারাবারে পাঠাতে চেয়েছিল!

বলেন কি? শঙ্কর চমকে উঠল।

আর বলি কি! খুব বরাত, এযাত্রা বেঁচে যাওয়া গেছে। শুধু একবার নয়, দুবার তীর ছুঁড়ে আমার জীবনসংশয় ঘটানোর সাধু প্রচেষ্টা করেছিল।

তারপর?

আতঙ্কে শঙ্করের সর্বশরীর তখন রোমাঞ্চিত।

তারপর আর কী! দুটোর একটা attempt-ও successful হয়নি—প্রমাণ এখনও শ্রীমান সুব্রত রায় আপনার চোখের সামনেই স্ব-শরীরে বর্তমান।

তা যেন হল—কিন্তু এ যে ব্যাপার ভয়ানক হয়ে দাঁড়াচ্ছে ক্রমে সুব্রতবাবু! শেষকালে কি এলোপাথাড়ি হাতের সামনে যাকে পাবে তাকেই মারবে!

মারতে পারুক ছাই না পারুক সাধু প্রচেষ্টার অভাব হবে না, এ-কথা কিন্তু হলফ করে বলতে পারি মিঃ সেন। সুব্রত বললে।

কিন্তু এভাবে একদল ভয়ঙ্কর অদৃশ্য খুনেদের সঙ্গে কারবার করাও তো বিপজ্জনক। মুখোমুখি এসে দাঁড়লেও না হয় এদের শক্তি পরীক্ষা করা যেত, কিন্তু এ যে গরিলা যুদ্ধের মত।

মেঘনাদ যিনি তিনি হয়তো সামনাসামনি দাঁড়িয়েই কল টিপছেন; আর কতকগুলো পুতুলকে কোমরে দড়ি বেঁধে যখন যেমন যেদিকে নাচাচ্ছেন তেমনি নাচছে; সুব্রত বলে।

কিন্তু মেঘনাদটি কে? শঙ্কর সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।

আরে মশাই, সেটাই যদি জানা যাবে তবে এত হাঙ্গামাই বা আমাদের পোহাতে হবে কেন? সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল।

তারপর সহসা হাসি থামিয়ে যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে সুব্রত বললে, আজ আবার একটি হতভাগ্য প্রাণ নিতে এসে প্রাণ দিয়েছে।

সে কি!

হ্যাঁ। বেচারা আমাকে মারতে এসে নিজে প্রাণ দিয়েছে; সুব্রত বললে।

বলেন কী! তা কেমন করে জানলেন?

হতভাগ্যের মৃতদেহ এখনও শালবনের মধ্যে পড়ে আছে।

পুলিসে একটা খবর দেওয়া তো তবে দরকার। শঙ্কর বললে।

তা দরকার বইকি। পুলিস জাতটা বড় সুবিধের নয়। আগে থেকে সংবাদ একটা দিয়ে রাখাই আমার মতে ভাল, কেননা নয় কে হয় ও হয় কে নয় করতে তাদের জোড়া আর কেউ নেই।

কিন্তু এত রাত্রে কাকে থানায় পাঠানো যায় বলুন তো? বাস তো সেই রাত দেড়টায়। ধারে-কাছে তো থানা নেই; সেই একদম কাতরাসগড়, নয় তেতঁলিয়া হল্টে। তাছাড়া ব্যাপার ক্রমে যা দাঁড়াচ্ছে, কোনো চেষ্টাকেই যেন আর বিশ্বাস করা যায় না।

কিন্তু থানায় লোক পাঠাতে আর হল না, ভৃত্য এসে সংবাদ দিলে থানার দারোগাবাবুর কাছ থেকে একজন লোক এসেছে, সুব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমার সঙ্গে? সুব্রত উঠে দাঁড়াল।

বাইরে এসে দেখলে একজন চৌকিদার অপেক্ষা করছে।

তুমি? সুব্রত প্রশ্ন করলে।

আজ্ঞে, দারোগাবাবু আপনার নামে একটা চিঠি দিয়েছেন।

একটা মোটা মুখবন্ধ On his Majestys Service খাম লোকটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরল।

সুব্রত খামটা হাতে করে ঘরে ঢুকতেই শঙ্কর বললে, কী ব্যাপার সুব্রতবাবু?

দারোগাবাবু একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। ভাল কথা, দেখুন তো লোকটা চলে গেল নাকি?

কেন?

তাড়াতাড়ি চাকরটাকে জিজ্ঞাসা করুন।

এই ঝুমন! শঙ্কর ডাকল।

বাবু! ঝুমন দরজার ওপরে এসে দাঁড়াল।

চৌকিদার কি চলে গেছে?

আজ্ঞে না। চুটিয়া খাচ্ছে।

তাকে একটু দাঁড়াতে বল্।

ঝুমন চলে গেল।

ব্যাপার কি? শঙ্কর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

এই লোকটার হাতেই দারোগাবাবুকে শালবনের খুন সম্পর্কে একটা খবর দিয়ে দিন না। তাহলে আর লোক পাঠাতে হয় না।

ঠিক বলেছেন।

শঙ্কর তাড়াতাড়ি একটা চিঠির কাগজে সংক্ষেপে শালবনের খুন সম্পর্কে যতটা সুব্রতর কাছে শুনেছিল লিখে চৌকিদারের হাতে দিয়ে দিল দারোগাবাবুকে গিয়ে দেবার জন্য।

চৌকিদার চলে গেল।

সুব্রত খামটা খুলে দেখলে গোটা তিন-চার পুলিশ মর্গের রিপোর্ট ও তার সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট।

সুব্রতবাবু, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাঠালাম। কাজ হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি পারেন ফেরত দিলে সুখী হব। আর দয়া করে কিরীটীবাবু এলে একটা সংবাদ দেবেন। কতদূর এগুলো?

নমস্কার।

কিসের চিঠি সুব্রতবাবু? শঙ্কর প্রশ্ন করল।

এখানে ইতিপূর্বে যেসব ম্যানেজার মারা গেছেন তাঁদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট।

ঠাকুর এসে বললে, খাবার প্রস্তুত।

দুজনে উঠে পড়লো।

.

খাওয়াদাওয়ার পর সুব্রত মাথার ধারে একটা টুলের ওপরে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কম্বলে গা ঢেকে শুয়ে পড়ল।

তারপর আলোর সামনে রিপোটগুলো খুলে এক এক করে পড়তে লাগল।

মৃত্যুর কারণ প্রত্যেকবারই এক; প্রত্যেকরই শরীরে তীব্র বিষের ক্রিয়ায় রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যু হয়েছে এবং প্রত্যেকেরই গলার পিছনদিকে যে ক্ষত পাওয়া গেছে, সেখানকার টিসু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানকার টিসুতেই সেই বিষ ছিল। সিভিল সার্জনের মতে সেই ক্ষতই বিষ প্রবেশের পথ।…তাহলে বোঝা যাচ্ছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে যে, নিছক গলা টিপেই খুনগুলো করা হয়নি। ময়নাতন্তের রিপোটের সঙ্গে Chemical Examinar-দের কোনো report নেই। তাহলে জানা যেত কী ধরনের বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে এটুকু বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়, বিষ অত্যন্ত তীব্র শ্রেণীর।

কিন্তু প্রত্যেক মৃত ব্যাক্তির গলার পিছনদিকে যে চারটি করে কালো কালো ছিদ্র বা ক্ষত পাওয়া গেছে, সেগুলোর তাৎপর্য কি? কি ভাবে সেগুলো হল? কেনই বা হল? সুব্রত চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল।

 ১২. আরও বিস্ময়

একসময় সুব্রতর মনে হল, এমনও তো হতে পারে কোনো একটা গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে এইভাবে পর পর খুন করা হচ্ছে। কিন্তু তা হলেই বা সে উদ্দেশ্যটা কি?

সুব্রত চিঠির কাগজের প্যাডটা টেনে নিয়ে কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল।

কিরীটী

গত কালকের সমস্ত সংবাদ দিয়ে তোকে একখানা চিঠি দিয়েছি।

ভেবেছিলাম আজ আর বুঝি তোকে চিঠি দেওয়ার মত কোনো প্রয়োজনই থাকবে না; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কতকগুলো ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ আবার অতর্কিতভাবে এক হতভাগ্য সাঁওতাল কুলি আমাকে খুন করতে এসে নিজে অদৃশ্য এক আততায়ীর হস্তে প্রাণ দিয়েছে।

এই শত্রুর দেশে কে আমার এমন বন্ধু আছেন বুঝলাম না, যিনি অলক্ষ্যে থেকে এভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়ে গেলেন।

এ ব্যাপারটার যে explanation আমি আমার মনে মনে খাড়া করেছি, আসলে হয়তো মোটেই তা নাও হতে পারে; হয়তো এটা আগাগোড়াই সবটা আমার উর্বর মস্তিষ্কের নিছক একটা অনুমান মাত্র। কিংবা হয়ত এমনও হতে পারে তাদেরই দলের কেউ তার উপরে হিংসা পোষণ করে বা অন্য কোনো গৃঢ় কারণবশত তাকে খুন করে গেছে অলক্ষ্যে থেকে। তবে ময়নাতদন্তের একটা রিপোর্ট আজ কিছুক্ষণ আগে দারোগাবাবু দয়া করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাতে দেখলাম, হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যুর কারণ বিষ….

মাইনের মধ্যেকার ব্যাপারটা এখনও জানা যায়নি। তবে রিপোর্ট দেখে মনে হয় দশজনই খুন হয়েছে।

বুঝতে পারি না এরকম নৃশংশভাবে একটার পর একটা খুন করে কী লাভ থাকতে পারে খুনীর! আর ম্যানেজারগুলো তো তৃতীয় পক্ষ। তাদের নিজস্ব কী এমন interest খনি সম্পর্কে থাকতে পারে যাতে করে তাদের এভাবে খুন হওয়ার ব্যাপারটাকে explain করা যেতে পারে।

তবে কি আসল ব্যাপারটা আগাগোড়াই একটা হুমকি বা চাল?

যা হোক এখন পর্যন্ত তোর বন্ধুটি নির্বিঘ্নে সুস্থ ও বহাল তবিয়তে খোসমেজাজেই আছেন। তোর খবর কী? রাজুর খবর কী? মা কেমন আছেন?

তোদের সুব্রত

পরদিন সকালে সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙল, চারিদিকে একটা ঘন কুয়াশার যমনিকা দুলছে।

শঙ্কর খানিক আগেই শয্যা থেকে উঠে মাইনের দিকে চলে গেছে, কেননা আজ থেকে আবার মাইনের কাজ শুরু হবার কথা।

ঝুমন চায়ের জল চাপিয়ে দু-দুবার সুব্রতর ঘরের কাছে এসে ফিরে গেছে সুব্রতকে নিদ্রিত দেখে।

শয়নঘর থেকে বের হয়ে সুব্রত ডাকল, ঝুমন!

সাক্-ঝুমন সামনে এসে দাঁড়াল।

কি রে, তোর চা ready তো?

ঝুমন হাসতে হাসতে জবাব দিল, জি সাব।

ম্যানেজারবাবু কোথায়?

খাদে গেছেন হুজুর।

চা খেয়ে গেছে?

আজ্ঞে না। বলে গেছেন আপনি ঘুমিয়ে উঠলে তিনি এর মধ্যে ফিরে আসবেন, তারপর একসঙ্গে দুজনে চা খাবেন।

বেশ। তবে তুই চায়ের সব যোগাড় কর। আমি ততক্ষণ চটপটু হাত পা ধুয়ে নিই, কি বলিস?

জি সাব—

ঝুমন নিজের কাজে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

সুব্রত বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে গরম ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে চায়ের টেবিলের কাছে এসে দেখে শঙ্কর এর মধ্যে কখন মাইন থেকে ফিরে চায়ের টেবিলের সামনে এসে বসে আছে।

তাহলে শঙ্করবাবু মাইনের কাজ শুরু করে দিয়ে এলেন?

অ্যাঁ! কে? সুব্রতবাবু! কী বলছিলেন?

মাইনের কাজ শুরু হবার আজ সকাল থেকে order ছিল না? কাজ শুরু হল?

হ্যাঁ, হয়েছে। কিন্তু একটা বিচিত্র আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটেছে। মনে হচ্ছে এটা যেন ভেীবাজির খনি।

ব্যাপার কী? সুব্রতর দৃষ্টিটা প্রখর হয়ে উঠল।

ঝুমন গরম চা, রুটি, মাখন, ডিমসেদ্ধ ও কেক সাজিয়ে দিয়ে গেল সামনের টেবিলের ওপরে।

একটা সেদ্ধ ডিমের অর্ধেকটা কাঁটা দিয়ে ভেঙে নিয়ে সেটা গালে পুরে চিবোতে চিবোতে শঙ্কর বলল, তাছাড়া আর কি বলব বলুন? ১৩নং কাঁথিতে মরল দশজন। কয়লার চাংড়া সরিয়ে মৃতদেহ পাওয়া গেল মোটে একটা!

তার মানে? সুব্রত বিস্মিত দৃষ্টিতে শঙ্করের মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ মশাই, এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন? ১৩নং কাঁথিতে মৃতদেহ মাত্র একটিই পাওয়া গেছে।

তবে যে শুনেছিলাম দশজন মারা গেছে? সুব্রত রুদ্ধনিশ্বাসে বললে।

তাই তো শোনা গিয়েছিল এবং লিস্টমত দশজনকে পাওয়াও যায়নি—কিন্তু কয়লা সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করবার পর দেখা যাচ্ছে মাত্র একটিই।

বলেন কি! ভাল করে খুঁজে দেখা হয়েছিল তো? সুব্রত প্রশ্ন করলে।

আমি নিচে পর্যন্ত দেখে এসেছি। মানুষ তো দূরের কথা, একগাছি চুলও দেখতে পেলাম না।

আশ্চর্য!

তারপর, আবার সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, ১৩নং কাঁথিতে কাজ চলছে নাকি?

না। ১৩নং কাঁথিতে কাজ একদম বন্ধ করে রেখে এসেছি।

বেশ করেছেন। চলুন, চা খেয়ে আমি একবার সেই ১৩নং কাঁথিটা ঘুরে দেখে আসব।

বেশ তো, চলুন। উদাসভাবে শঙ্কর জবাব দিল।

.

চা পান শেষ করে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে দুজনে বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াল।…এমন সময় দেখা গেল বিমলবাবুর সঙ্গে অদূরে দারোগাবাবু আসছেন।

দারোগাবাবুই আগে হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার সুব্রতবাবু। নমস্কার মিঃ সেন।

ওরা দুজনেই প্রতি নমস্কার জানাল।

দারোগাবাবুই প্রশ্ন করলেন, কোথায় মশাই আপনাদের শালবনে খুন হয়েছে?

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খবরটা পেলেন কি করে? সুব্রত শুধায়।

এদিকে আসছিলাম—পথেই চিঠিটা পেলাম। কিন্তু—

কি?

এতক্ষণ প্রায় আধঘণ্টা ধরে আমি বিমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তন্নতন্ন করে শালবন, নদীর ধার পর্যন্ত খুঁজে এলাম, কিন্তু কোথাও তো মশাই লাশের টিকিটিরও দর্শন পেলাম না। অন্ধকারে ভুল দেখেন নি তো?

সুব্রত চমকে উঠল, আপনি বলছেন কী স্যার? আমার চোখের সামনে ব্যাটা ছটফট করে মরল, আর আমি ভুল দেখলাম!

তবে বোধ হয় ব্যাটা মরে ভূত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সুব্রতবাবু। হাসতে হাসতে দারোগাবাবু বললেন।

দেখুন দারোগাবাবু, নেশা-ভাঙের অভ্যাস আমার জীবনে নেই, তাছাড়া চোখের দৃষ্টি এখনও আমার খুবই প্রখর ও সজাগ।

কিন্তু লাশটা তাহলে কোথায়ই বা যাবে বলুন? কথাটা বললেন বিমলবাবু।

কোথায় যাবে তা কী করে বলব! পাওয়া যখন যাচ্ছে না তখন নিশ্চয়ই কেউ রাতারাতি লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে।

কিন্তু ওই শালবনে অত রাত্রে যে একটা লোক খুন হয়েছে, সে-কথা লোকে জানাই বা কেমন করে যে সরিয়ে নেবে রাতারাতি? দারোগাবাবু বললেন।

এবার সুব্রত আর না হেসে থাকতে পারলে না। হাসতে হাসতে বললে, তা যা বলেছেন। তবে যে খুনী সে তো জানতই লোকটা মারা গেছে, বিশেষ করে বন্দুকের গুলি খেয়ে যে বাঁচা চলে না এবং সে গুলি যখন পাঁজরা ভেদ করে গেছে।

তবে কি আপনি বলতে চান সুব্রতবাবু, খুনীই লাশ সরিয়েছে?

বলতে আমি কিছুই চাই না। লাশ কেউ সরিয়েছে বা সরায়নি এ সম্পর্কে কোনো তর্কাতর্কি করারই আমার ইচ্ছা নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্তে ইচ্ছা উপনীত হতে পারেন এবং যেমন খুশি further proceed করতে পারেন। তবে এটা ঠিকই জানবেন,কাল একজন কুলি শালবনে বন্দুকের গুলিতে খুন হয়েছিল।

আপনার কথাই যদি ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ খুনীই লাশ সরিয়ে থাকে, তবে কোথায় সরালে? দারোগাবাবু সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।

কেমন করে বলব বলুন! আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর লাশ সরায়নি!

তাও তো ঠিক, তাও তো ঠিক। দারোগাবাবু মাথা দোলাতে লাগলেন পরম বিজ্ঞের মত।

১৩. মৃতদেহ

দারোগাবাবুরও যেন অতঃপর কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, চলুন না সুব্রতবাবুআমার সঙ্গে একটিবারসেইশালবনে; কোথায় আপনি মৃতদেহ দেখে এসেছিলেন, exact location-টা দেখাবেন।

নিশ্চয়ই, চলুন।

সকলে নদী পার হয়ে শালবনের দিকে এগিয়ে চলল।

.

প্রভাতের সোনালী রোদ শালবনের গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত উঁকি দিচ্ছে।

শীতের প্রভাতের ঝিরঝিরে হাওয়া শালবনের গাছে সবুজ কচি পাতাগুলিকে মৃদু মৃদু শিহরণ দিয়ে বয়ে যায়।

সকলে এসে শালবনের মধ্যে প্রবেশ করল।

কোথায় দেখেছিলেন কাল রাত্রে সেই মৃতদেহ সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু প্রশ্ন করলেন।

ওই শালবনের দক্ষিণদিকে।

গতরাত্রের সেই জায়গায় সকলে সুব্রতর নির্দেশমত এসে দাঁড়াল।

আশেপাশে কয়েকটা বড় বড় শালগাছ ছোট একটা জায়গাকে যেন আরও ছায়াচ্ছন্ন ও নির্জনতর করে ঘিরে রেখেছে।

এই সেই জায়গা দারোগাবাবু, সুব্রত বললে।

সেই জায়গার মাটিতে তখনও রক্তের দাগ জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে দেখা গেল।

সুব্রত সেই জমাটবাঁধা রক্তের দাগগুলোর দিকে আঙুল তুলে বলল, এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমি যে গত রাত্রে স্বপ্ন দেখিনি বা আমার চোখের দৃষ্টিভ্রম ঘটেনি তার প্রমাণ। এই মাটির বুকে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে।

সকলে তখন এক এক করে রক্তের দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখল এবং সুব্রতর কথা যে মিথ্যা নয় এরপর সেটাই সকলে মেনে নিতে বাধ্য হল।

তাই তো স্যার, এ যে তাজ্জব ব্যাপার! দারোগাবাবু বলতে লাগলেন, কিন্তু মৃতদেহটা তবে কোথায় গেল?

সুব্রত তখন চারিদিকে ইতস্তত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়ে কি যেন দেখছিল, দারোগাবাবুর কথার কোনো জবাবই দিল না।

এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে দেখতে সহসা একসময় সুব্রতর চোখের দৃষ্টিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সহসা সে চিৎকার করে বলে উঠল, ইউরেকা! ইউরেকা! সম্ভবত আপনার লাশ পাওয়া গেছে দারোগা সাহেব। কিন্তু একটা শাবলের যে দরকার।

সুব্রতর উৎফুল্ল চিৎকারে সকলেই সুব্রতর দিকে ফিরে তাকাল।

ব্যাপার কী সুব্রতবাবু? শঙ্কর বললে।

লাশ পাওয়া গেছে শঙ্করবাবু। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।

লাশ পাওয়া গেছে? আপনার মাথা খারাপ হল নাকি সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু বললেন।

দয়া করে একটা শাবল আনিয়ে দিন। আমি এখনই প্রমাণ করে দিচ্ছি।

তখনি বিমলবাবুকে খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল একটা শাবল নিয়ে আসবার জন্য।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমলবাবু ছোট একটা মাটি-খখাঁড়া শাবল নিয়ে ফিরে এলেন।

এই নিন স্যার শাবল।

সুব্রত বিমলবাবুর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে একটা বড় শালগাছের গোড়া থেকে একটা ছোট শালগাছের চারা এক টান দিয়ে অনায়াসেই শিকড়সুদ্ধ তুলে ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশী মাটি খুঁড়তে হল না, খানিকটা মাটি উঠে আসবার পরই একটা মানুষের হাত দেখা গেল।

এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমার কথা ঠিক কিনা! এই দেখুন লাশ। সুব্রতর সমগ্র শরীর ও কণ্ঠস্বর প্রবল একটা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে।

তারপর অল্প আয়াসেই মাটি থেকে মৃতদেহ খুঁড়ে বের করা হল। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, সুব্রত যা বলেছিল ঠিক তাই। মৃতদেহের পাঁজারায় গুলির ক্ষতও রয়েছে।

দারোগাবাবু এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি, যেন বোকা বনে গেছেন। এমন ব্যাপার যে একটা ঘটতে পারে এ যেন ইতিপূর্বে তাঁর ধারণার অতীত ছিল। তিনি একজন দারোগা। এক-আধ বছর নয়, প্রায় দীর্ঘ এগার বছর এই লাইনে চুল পাকাচ্ছেন অথচ এই সামান্য সম্ভাবনাটা তাঁর মাথায় খেলেনি! খেলল কিনা সামান্য একজন শখের গোয়েন্দার সহচরের মাথায়!

দারোগাবাবু একটু গম্ভীরই হয়ে গেলেন।

আমার কথায় এবার বিশ্বাস হয়েছে তো স্যার পুরোপুরি? সুব্রত দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।

এখনও আর না বিশ্বাস করে কেউ পারে নাকি সুব্রতবাবু? বললে শঙ্কর। কিন্তু আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না সুব্রতবাবু।

বুদ্ধির কিছু নয়—common sense,শঙ্করবাবু; বুদ্ধি যদি বলেন সে আমার বন্ধু ও শিক্ষাগুরু কিরীটী রায়ের আছে, সুব্রত বললে। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় যেন রুদ্ধ হয়ে এল।

কিন্তু কেমন করে বুঝলেন বলুন তো সুব্রতবাবু যে লাশ এখানে লুকনো আছে?

বললাম তো common sense! এই গাছটা লক্ষ্য করে দেখুন। গাছের পাতাগুলো যেন নেতিয়ে গেছে। এটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকিটা আমার অনুমান-চারদিকে চেয়ে দেখুন, চারাগাছ আরও দেখতে পাবেন, কিন্তু কোনো গাছেরই পাতা এমন নেতানো নয়। প্রথমেই আমার মনে হল, ঐ গাছের পাতাগুলো অমন নেতিয়ে গেছে কেন? তখনি গাছটার পাশে ভাল করে চাইতেই মাটির দিকে নজর পড়ল। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেই বোঝা যায় পাশের মাটিগুলো যেন কেমন আলগা। মনে হয় কে যেন চারপাশের মাটি খুঁড়ে আবার ঠিক করে রেখেছে। যেই এ কাজ করে থাকুক না কেন, লোকটার যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বলতেই হবে। মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ পুঁতে এই গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে যাতে করে কারও নজরে না পড়ে এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে আনার ফলে এক রাত্রেই নেতিয়ে উঠেছে। আরও ভেবে দেখুন এক রাত্রের মধ্যে যেখানে গাড়ি মোটর বা ট্রেনের তেমন কোনো ভাল বন্দোবস্ত নেই সেখানে একটা লাশকে সরিয়ে ফেলা কত কণ্ঠসাধ্য! তাছাড়া একটা মৃতদেহ অন্য জায়গায় সরানোও বিপদসঙ্কুল ব্যাপার। একে তো সকলের নজর এড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার ওপর ধরা পড়বার খুবই সম্ভাবনা। অথচ মৃতদেহটা এভাবে ফেলে রাখাও চলে না—তাই সরানোই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ এবং আশেপাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে পারলে সব দিকই রক্ষা হয় এবং ব্যাপারটাও সহজ সাধ্যকর হয়ে যায়।

যা হোক, সকলেই তখন লাশের একটা বন্দোবস্ত করে বাংলোর দিকে ফিরল। কারও মুখেই কোনো কথা নেই। সকলে নির্বকভাবে পথ অতিক্রম করছে।

সকলে এসে বাংলোয় প্রবেশ করল।

বিমলবাবু বাংলো পর্যন্ত আসেননি, খনির দিকে চলে গেছেন মাঝপথ থেকে বিদায় নিয়ে।

বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার পাতা ছিল। তিনজনে তিনটে চেয়ার টেনে বসল। দারোগাবাবুই প্রথমে কথা বললেন, সুব্রতবাবু, ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলো পড়েছেন নাকি?

হ্যাঁ, কাল রাত্রেই পড়ে ফেলেছি।

কি বুঝলেন?

সামান্যই। তার থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া চলে না। আচ্ছা দারোগা সাহেব, এই case-গুলোর chemical examination-এর report-গুলো আপনার কাছে আছে নাকি?

না। তবে বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?

হ্যাঁ পেলে ভাল হত। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?

বলুন।

একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেইকাগজে মোড়া গতরাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

ব্যাপার কী? ওটা কি আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।

কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোনো মারাত্মক রকমের বিষ মাখানো আছে, দয়া করে এটা ধানবাদের কোনো কেমিস্টের কাছ থেকে একটু এগজামিন করে কী বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?

চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হব, বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন! এক হপ্তার মধ্যেই chemical examiner-এর report পেয়ে যাবেন।

দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।

তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

শঙ্কর খাদের দিকে রওনা হল।

সুব্রত চেয়ারটার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।

 ১৪. রাত্রি যখন গভীর হয়

প্রতি রাতের মত আজও রাত্রির অন্ধকার ধূসর কুয়াশার ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে শ্রান্ত ক্লান্ত ধরণীর বুকে নেমে এল। পাখির দল কুলায় গেল ফিরে। সারাদিন খনিতে খেটে ক্লান্ত সাঁওতাল কুলিকামিনরা যে যার ধাওড়ায় ফিরে এসেছে। সুব্রত চুপটি করে বারান্দায় একটা বেতের ডেকচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল।

কাল হয়ত কিরীটীর চিঠি পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের রাতটা?

এ কি নির্বিঘ্নে কাটবে?

রাতের অন্ধকারে কি আজ আর বিভীষিকাময় মৃত্যুর কঠিন হিমপরশ কোনো হতভাগ্যের ওপরে নেমে আসবে না?

দূর থেকে সাঁওতালী বাঁশি ও মাদলের সুর ভেসে আসে।

জীবনের কোনো মূল্যই ওদের কাছে নেই। প্রকৃতির স্নেহের দুলাল ওরা। মাটির ঘরে অযত্নে বর্ধিত মাটি-মাখা সহজ ও সরল শিশুর দল। প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনের পাত্র ওদের কানায় কানায় পূর্ণ।

শঙ্কর এখনও খাদ থেকে ফেরেনি।

ঝুমন গরম চা, কেক ও ফল প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেল।

সুব্রত একটুকরো কেক মুখে পুরে চায়ের কাপটা তুলে নিল। বাইরে আজ ঠাণ্ডাটা যেন একটু চেপেই এসেছে।

মাঝে মাঝে খোলা প্রান্তর থেকে আসন্ন রাতের স্তব্ধতা যেন বহন করে আনে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা।

একসময় চায়ের পাত্র নিঃশেষ করে সুব্রত পাশের টিপয়ে সেটা নামিয়ে রেখে দিল। কত রকম চিন্তা একটার পর একটা মাথার মধ্যে এল মাকড়সার জালের মত।

এবং সেই জালের সূক্ষ্ম তন্তুগুলি বেয়ে বেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারটি দাগের মত কী যেন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

কী ওগুলো?

ভূতের মত একাকী চুপ করে এই বারান্দায় ঠাণ্ডায় বসে বসে কি ভাবছেন?

চোখ তুলে তাকায় সুব্রত।

কে? শঙ্করবাবু? সুব্রত ধীরকণ্ঠে বলে।

কী এত ভাবছেন বলুন তো? এখানে এসে আপনার এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তবুও টের পাননি?

হাসতে হাসতে শঙ্কর জিজ্ঞাসা করে।

এবেলা খাদের অবস্থা কেমন? Peacefully work চলছে তো?

কতকটা, যদি কিছু দুর্ঘটনা না আচমকা এসে পড়ে।

হঠাৎ এ কথা কেন শঙ্করবাবু?

বলা তো যায় না। শঙ্কর মৃদুকণ্ঠে বলে, বিমলবাবুর ভাষায় বলতে গেলে এই ভৌতিক ফিল্ড-এ যখন-তখনই যে কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাপারই তো ঘটা সম্ভব সুব্রতবাবু! তাছাড়া নতুন ম্যানেজারবাবু এখনও ভূতের হাতে আক্রান্ত হননি যখন!

সুব্রত কোনো কথা বলে না।

তারপর আপনার কাজ কতদূর এগুলো সুব্রতবাবু? How far you have proceeded?

অনেকটা।

বলেন কী? শঙ্করের কণ্ঠস্বর উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ। কিন্তু এখনও আমাদের দারোগাবাবু এসে পৌঁছলেন না!

দারোগাবাবু এখন আসবার কথা আছে নাকি?

শঙ্কর উৎকণ্ঠিতভাবে প্রশ্ন করে।

তাঁকে সন্ধ্যার পরই যে বাসটা থামে, তাতে দুজন কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলাম।

কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলেছিলেন! কেন? হঠাৎ কনেস্টবল নিয়ে আসবেন কেন? কাউকে গ্রেপ্তার করবেন নাকি?

শঙ্কর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর দিকে তাকাল। কিন্তু চারদিককার অন্ধকারে কিছু দেখা গেল। আবার শঙ্কর প্রশ্ন করে, আমি যে অন্ধকারেই থাকছি সুব্রতবাবু। Please খুলে বলুন। কাকে গ্রেপ্তার করবেন?

খুনীকে। এ রহস্যের হোতাকে।

পেরেছেন বুঝতে তাহলে সত্যিই? পেরেছেন জানতে হত্যাকারী কে?

একরাশ উৎকণ্ঠা শঙ্করের গলার স্বরে ফুটে রেরুল।

হ্যাঁ। সুব্রত জবাব দেয়।

কে সুব্রতবাবু?

আপনিই বলুন কে? সুব্রত স্মিতভাবে শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

আগে বলুন, এই খনির area-র মধ্যে সেই লোকটি আছে কিনা? তারপর বলছি।

শঙ্কর সুব্রতর মুখের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

যদি বলি আছে! সুব্রত মৃদুস্বরে জবাব দেয়।

তাহলে বলব, আমিও একজনকে সন্দেহ করেছি সুব্রতবাবু।

কে? বিমলবাবু—এই খনির সরকার?

হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, how could you guess! আপনারা দেখছি সর্বজ্ঞ। Am I right সুব্রতবাবু?

অধীরভাবে শঙ্কর সুব্রতকে প্রশ্ন করে।

You are right শঙ্করবাবু। ধীরভাবে সুব্রত জবাব দেয়।

আজ তাহলে বিমলবাবুকে গ্রেপ্তার করছেন বলুন? শঙ্কর আবার জিজ্ঞাসা করে।

এমন সময় দারোগাবাবু দুজন কনেস্টবল সমভিব্যাহারে এসে হাজির হলেন। বাংলোর বারান্দায় উঠতে উঠতে দারোগাবাবু বললেন, আমরা এসে গেছি সুব্রতবাবু।

Many thanks, আসুন আসুন। Everything O. K.! একটু চাপা গলায় বলে ওঠে।

Yes, everything 0. K.দারোগাবাবু জবাব দিলেন।

আপনারা তাহলে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা চট্ করে খাওয়াদাওয়া সেরে ready হয়ে নিচ্ছি। উঠুন শঙ্করবাবু, রাত হয়ে গেছে, চলুন খেতে যাওয়া যাক।

চলুন।

সুব্রত ও শঙ্কর দুজনে উঠে পড়ল।

.

রাত্রি গভীর হয়েছে।

সুব্রত, শঙ্কর, দারোগাবাবু তিনজনে নিঃশব্দে কালো কয়লার গুঁড়ো কাঁকরঢালা অপ্রশস্ত রাস্তাটা, যেটা বরাবর অফিসারদের কোয়ার্টারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে প্রেতের মত এগিয়ে চলে। সকলেরই পায়ে রবার সু। কাঁকর কয়লা বিছানো রাস্তা দিয়ে চললেও কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।

সকলে এসে বরাবর বিমলবাবুর কোয়াটারের সামনে দাঁড়াল।

এর মধ্যেই চারিদিকে কুয়াশা জমেছে।

আশেপাশের সব কিছু আবছা অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিমলবাবুর কোয়াটারটা কুয়াশার ওড়না জড়িয়ে যেন আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আগে সুব্রত ও তার পিছনে দারোগাবাবু ও শঙ্কর পা টিপে টিপে বিড়ালের মত সন্তর্পণে বারান্দা অতিক্রম করে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

ওকি! সুব্রত সবিস্ময়ে দেখল, দরজার দুপাশের দুটো ভেজানো কবাটের ফাঁক দিয়ে ঈষৎ স্রিয়মাণ একটা আলোকরশ্মি যেন অতি সন্তর্পণে বাইরে উঁকি দিচ্ছে ভয়ে ভয়ে।

সুব্রত একবার চেষ্টা করলে দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখা যায় কিনা দেখবার। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না।

আঙুলের চাপ দিতেই ভেজানো দরজা আরও ফাঁক হয়ে গেল। ঘরের এক কোণে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে।

প্রচুর ধূম উদগিরণ করে হ্যারিকেনের চিমনিটা কালো হয়ে ওঠায় আলো অত্যন্ত মলিন বলে মনে হয়।

প্রথমটায় সেই মলিন আলোয় সুব্রত কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু পরক্ষণেই ভাল করে দৃষ্টিপাত করতেই সুব্রত ভয়ঙ্কর রকম চমকে উঠল।

ওকি! সেই শালবনে দেখা পাগলটা না?

কে একজন উপুড় হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। পাগলটা সেই ভূপতিত দেহের উপরে ঝুঁকে অত্যন্ত নীচু হয়ে কি যেন করছে।

ডান হাতের পিস্তলটা বাগিয়ে, বাঁ হাতে টচটা ধরে বোম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত আচমকা দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।

টর্চের তীব্র আলোর ঝাপটা মুখের ওপরে পড়তেই পাগলটা চমকে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু ওকি! পাগলটার হাতে একটা উদ্যত পিস্তল!

সুব্রত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

কে তুই? বল শীগগির, কে তুই?

সহসা একটা উচ্চরোলের হাসির প্রচণ্ড উচ্ছাসে সমগ্র ঘরখানি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

পাগলটা হাসছে।

সকলেই স্তম্ভিত, বাক্যহারা।

হঠাৎ পাগলটা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় ডাকল, সুব্রত!

সুব্রত চমকে উঠল।

কে?

ভয় নেই, আমি কিরীটী।

অ্যাঁ! কিরীটী, তুই! একি বিস্ময়!

সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও বলে উঠল, কিরীটী তুই!

হ্যাঁ। কেন, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি শ্রীহীন কিরীটী রায়!

কিন্তু ব্যাপার কী? মাটিতে পড়ে লোকটা কে?

সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

বিমলবাবুর মৃতদেহ।

কার? কার মৃতদেহ? অস্ফুট কণ্ঠে সুব্রত চিৎকার করে উঠল।

কলিয়ারীর সরকার বিমলবাবু। যাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য তোমাদের আজকের রাত্রের এই দুঃসাহসিক অভিযান বন্ধু! চল বন্ধু, এবারে বাসায় চল। দারোগাবাবু, আপনার সঙ্গে যে কনেস্টবল দুটি এনেছেন, তাদের এই মৃতদেহের জিম্মায় আজকের রাতের মত রেখে চলুন শঙ্করের বাংলোয় ফেরা যাক। চল সুব্রত, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? গাম ইলাস্টিক দিয়ে একমুখ দাড়ি করে চুলকে চুলকে প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত হবার যোগাড় হল!

কিন্তু—সুব্রত আমতা আমতা করে বললে।

এর মধ্যে আবার কিন্তু কী হে ছোরা! চল, চল্। রাত কত হল তার খবর রেখেছিস? বাড়িতে চল, ধীরেসুস্থে বলব।

তাহলে বিমলবাবু…

সুব্রতর কথা শেষ হল না, কিরীটী বলে উঠল, আজ্ঞে না। You are mistaken, বিমলবাবু খুনী নন।

তবে?

তবে আবার কী? অন্য লোক খুনী।

কে খুনী?

কাল সকালে বলব। এখন চল বাংলোয় ফেরা যাক।

কিন্তু আমার যে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কিরীটী! সুব্রত বললে।

অর্থাৎ তুমি একটি হস্তীমূখ। শোন, কানে কানে একটা কথা বলি।

সুব্রতর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে কিরীটী কি যেন ফিসফিস করে বলতেই সুব্রত লাফিয়ে উঠল, অ্যাঁ, বলিস কি আশ্চর্য, আশ্চর্য!

কিন্তু তার একটি ডান ও একটি বাঁ হাত ছিল যন্ত্রস্বরূপ। কিরীটী বললে, এই হতভাগ্য বিমলবাবু হচ্ছে বাঁ হাত।

সে রাত্রে বাংলোয় ফিরে গরম জল করিয়ে কিরীটী ছদ্মবেশ ছেড়ে স্থির হতে হতে প্রায় রাত্রি আড়াইটে বেজে গেল।

১৫. রহস্যের মীমাংসা

ঝুমনকে ডেকে শঙ্কর কিছু লুচি ও তরকারী করবার জন্য আদেশ দিতেই কিরীটী বাধা দিলে, আরে ক্ষেপেছিস শঙ্কর, এই রাত্রে মিথ্যে কেন ও বেচারীকে কষ্ট দিবি! তার চাইতে বল্ এক কাপ গরম গরম চা বানিয়ে দিক। আর তার সঙ্গে ঘরে যদি কেক বিসকি কিছু থাকে তবে তাই দু-চারটে দে, তাতেই হয়ে যাবে।

ঘরে কেক ছিল। ঝুমন একটা প্লেটে করে কয়েকটা plum cake ও এক কাপ চা এনে কিরীটীর সামনে টিপয়ে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললে, দিই না সাহেব কয়েকটা লুচি ভেজে, কতক্ষণ বা লাগবে!

কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, ওরে না না। তুই শুতে হ্যাঁ। এতেই আমার হবে, কাল যদি এখানে থাকি তো বেশ করে পেট ভরে খাওয়াস।

ঝুমন চলে গেল।

কিরীটী জামার পকেট থেকে চুবোট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে মৃদু টান দিতে লাগল।…

কিছুক্ষণ ধূমপান করবার পর প্রায়-ঠাণ্ডা চায়ের কাপটা তুলে নিতে নিতে বললে, cold tea with a Burma cigar, is a joy for ever.

সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল কিরীটীর নিজস্ব কবিতা শুনে।

কিন্তু আমার শরীর যে ঘুমে ভেঙে আসছে শঙ্কর, শীঘ্র কোথায় শুতে দিবি বল? কিরীটী শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

শঙ্কর নিজের ঘরেরই এক পাশে একটা ক্যাম্প খাটে কিরীটীর শোয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।

কিরীটী শয্যার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে নিল।

.

পরের দিন সকালে শঙ্কর ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।

এমন সময় একজন সাঁওতাল কুলি ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বাবু, হুজুর মালিক এসেছেন গো–

মালিক? কখন এলেন তিনি?

কাল রাতে বাবু।

কে কাল রাতে এসেছেন শঙ্কর?

চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে কিরীটী।

খনির মালিক সুধাময়বাবু কাল রাত্রে এসেছেন।

যা, তাড়াতাড়ি মনিবের সঙ্গে একবার মোলাকাত করে আয়।

হ্যাঁ, যাই।

হাত মুখ ধুয়ে শঙ্কর তখুনি মনিবের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল।

খনির অল্প দূরে মাঠের মধ্যে একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। খনির দুজন অংশীদার হনুমানপ্রসাদ ঝুনঝুনওয়ালা আর সুধাময় চৌধুরী। অংশীদারের মধ্যে কেউ কখনো এলে ঐ বাংলো বাড়িতেই ওঠেন। অন্য সময় বাংলো তালা-চাবি দেওয়াই থাকে।

শঙ্কর যখন এসে বাংলো বাড়িতে প্রবেশ করল, সুধাময়বাবু তখন ঘুম ভেঙে উঠে বসে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচির সদ্ব্যবহার করছেন।

ভৃত্যকে দিয়ে সংবাদ পাঠাতেই শঙ্করের ভিতরে ডাক এল। বহুমূল্য আসবাবপত্রে সাজানো কখানি গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।

একটা বেতের চেয়ারে বসে সুধাময়বাবু প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন।

শঙ্কর ঘরে ঢুকে হাত তুলে নমস্কার জানাল, নমস্কার স্যার।

নমস্কার। বসুন। আপনিই এখানকার নতুন ম্যানেজার শঙ্কর সেন?

আজ্ঞে।

বেশ, বেশ।

শঙ্কর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

ওরে কে আছিস, ম্যানেজারবাবুকে চা দিয়ে হ্যাঁ। সুধাময়বাবু হাঁক দিলেন।

না, না। ব্যস্ত হবেন না। এই মাত্র বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরুচ্ছি।

তাতে আর কী Add a cup more, কোনো harm নেই।

শঙ্কর সুধাময়বাবুর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।

উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। মাথার মাঝখানে সিঁথি। চোখা নাক। চোখ দুটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ লালচে। শিকারী বিড়ালের মত সদাচঞ্চল, অস্থির ও সজাগ। গায়ের রং আলুশ কাঠের মত কালো। ভদ্র বেশ না হলেও সাঁওতালদেরই একজন বলে ধরা যেতে পারে অনায়াসেই। গায়ে বাদামী রংয়ের দামী সার্জের গরম সুট।

ভৃত্য চা দিয়ে গেল। শঙ্কর চায়ের কাপটা টেনে নিল।

তারপর মিঃ সেন, আপনাদের কাজকর্ম চলছে কেমন?

মন্দ না। তবে পর পর এমনভাবে খুন হওয়ায় এখানকার কুলিকামিনদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কাল রাত্রে আমাদের সরকার মশাই বিমলবাবু অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।

কে নিহত হয়েছে?

বিমলবাবু।

The villain! Rightly served. I hated him most amongst my employees, but I am also determined to give up my shares. I am really fed-up with all this. ঝুনঝুনওয়ালাও আজই বিকেলের দিকে এসে পৌঁছচ্ছেন। শুনলাম তিনিও বেচে দেবেন তাঁর share।

মনিবকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম দেখে, শঙ্করের বাংলোয় ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো বেজে গেল।

.

সন্ধ্যার ধূসর ছায়া ধরিত্রীর বুকে যেন রহস্যের যবনিকার মত নেমে এসেছে।

শঙ্করের ডাকবাংলোয় সকলে একত্রিত হয়েছে। খনির দুই অংশীদার সুধাময় চৌধুরী ও হনুমানপ্রসাদ ঝুনঝুনওয়ালা, সুব্রত, কিরীটী, দারোগাবাবু ছদ্মবেশে ও শঙ্কর নিজে। কিরীটী বলেছে আজ অপরাধী কে সকলের সামনে প্রকাশ করে বলবে এবং হাতে হাতে দারোগাবাবুর জিম্মায় দিয়ে দেবে। সুধাময়বাবু ও ঝুনঝুনওয়ালা দুজনেই বলেছেন, অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারলে দুজনেই পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা কিরীটীকে পুরস্কার দেবেন।

কিরীটী বলতে লাগল : BeforeImention the name let me have my reward first of all with the promise that if I fail I will return the same.

সুধাময়বাবু ও ঝুনঝুনওয়ালা দুজনেই হাসতে হাসতে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকার দুখানা চেক লিখে দিলেন, এই নিন।

তাহলে আপনারা সকলে শুনুন।

এই খনি অভিশপ্ত নয়, ভূতের আস্তানাও নয়; প্রচুর লাভের খনি। এবং আজ পর্যন্ত। এই খনিতে যতগুলো খুন হয়েছে তার জন্যে সর্বাংশে দায়ী খনির অন্যতম অংশীদার স্বয়ং সুধাময় চৌধুরী।…

ঘরের মধ্যে বজ্ৰত হলেও বোধ হয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।

প্রবল ব্যঙ্গমিশ্রিত স্বরে সুধাময়বাবু প্রচণ্ড হাসির তুফান তুলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর এক হাত প্যান্টের পকেটে। সহসা পিস্তলের গর্জন শোনা গেল।

গুড়ুম!

উঃ! একটা বেদনার্ত চিৎকার করে সুধাময়বাবু একপাশে টলে পড়লেন এক হাত দিয়ে ডানদিকের পাঁজরা চেপে ধরে, অন্য হাত থেকে একটা রিভলবার ছিটকে পড়ল।

শয়তান! কুকুর! তোকে কুকুরের মতই গুলি করতে বাধ্য হলাম—দারোগা সাহেব গর্জন করে উঠল, না হলে তুই-ই হয়ত এখনি আমায় গুলি করতিস। জীবনে হয়ত আজ এই প্রথম সত্যিকারের গুলি করতে বাধ্য হলাম, কিন্তু তার জন্য আমার এতটুকু অনুশোচনা হচ্ছে না। যে নৃশংস এতগুলো খুন পর পর করতে পারে তার একমাত্র শাস্তিই পাগলা কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরা।

উঃ কিরীটীবাবু, আপনার কথাই ঠিক। অতি লোভ সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমার মৃত্যুর কারণ হল। হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি—আমিই সব খুন করেছি। উঃ!

ধীরে ধীরে হতভাগ্য সুধাময় চৌধুরীর প্রাণবায়ু বাতাসে মিশে গেল।

সহসা যেন নাটকের যবনিকাপাত ঘটল।

ঘরের সব কটি প্রাণীই স্তব্ধ।

কারও মুখে কোনো কথা নেই।

কিরীটী এতক্ষণে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল, এবারে আমি আমার বক্তব্য সব সংক্ষেপে শেষ করব। কেননা আজকের রাত্রের Bus-ই আমায় ধরতে হবে। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের কাছে খুলে না বললে আমার এই ব্যাপারে explanation-টা সহজবোধ্য হবে না। বর্তমানে এই যে এখানকার কলিয়ারীটা দেখছেন, পঞ্চাশ বছর আগে এই কলিয়ারীর পাশের ঐ একটা কলিয়ারী হঠাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কোনো অজ্ঞাত কারণবশত ধসে যায় এরূপ কিংবদন্তী আছে। তারপর থেকেই এখানকার আশেপাশের লোকেরা এ জায়গাটা সম্পর্কে নানাপ্রকার মনগড়া বিভীষিকার কথা তুলে এটাকে অভিশপ্ত করে তোল। এমনি করে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর কেটে যায়।

কেউ এর পাশে ঘেঁষে না।

এমন সময় কলিয়ারী শুরু করবার ইচ্ছায় মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা ও সুধাময় চৌধুরী এদিকে ঘুরতে ঘুরতে এই অভিশপ্ত ফিল্ডটার সন্ধান পান এবং অচিরে এটার লিজ নেন নব্বই বছরের জন্য খুব সামান্য টাকায়।

কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে আরও বছর চারেক কেটে যায়।

তারপর কাজ শুরু হল।

কাজ বেশ এগুচ্ছে এবং ফিল্ড থেকে প্রচুর কয়লা উঠছে।

এই সময় শয়তান সুধাময়ের মনে কু-মতলব জাগল। তিনি মনে মনে বদ্ধপরিকর হলেন ঝুনঝুনওয়ালাকে ফাঁকি দিতে। কিন্তু কেমন করে ঝুনঝুনওয়ালাকে সরানো যায় সেই চিন্তা করতে লাগলেন।

একদিন খনির কাজ পরিদর্শন করতে এসে সামান্য অজুহাতে খনির সরকার বিকাশবাবু ও ম্যানেজারের অ্যাসিস্টেন্ট সত্যকিংকরবাবুকে বরখাস্ত করে নিজের লোক বিমলবাবু ও চন্দনসিংকে নিযুক্ত করে গেলেন।

চন্দনসিং ও বিমলবাবু ছিল সুধাময়ের ডান ও বাঁ হাত, অপকর্মের প্রধান সঙ্গী বা সহায়ক। বিমলবাবু ও চন্দনসিং সুধাময়বাবুকে সকল সংবাদ সরবরাহ করত ও খনিটা ভৌতিক এই কিংবদন্তীকে আরও সুদৃঢ় করবার জন্য প্রোপাগাণ্ডা চালাত দিবারাত্র নানা ভাবে।

সুধাময়বাবুর রং ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নিজে বহুকাল সাঁওতাল পরগণায় ঘুরে ঘুরে সাঁওতালদের সামাজিক রীতিনীতি আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তাও পুরোপুরি ভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন, এবং যাতে করে তিনি অনায়াসেই সাঁওতাল কুলিদের মধ্যে তাদের একজন সেজে দিব্যি খোসমেজাজে একের পর এক খুন করে চলেছিলেন। অথচ কেউ কোনোদিন সন্দেহ করবার অবকাশ পায়নি।

সুব্রতকে পাঠিয়ে দিয়েই আমি গোপনে পরের দিন সকালেই পাগলের ছদ্মবেশে এখানে চলে আসি এবং চারিদিকে নজর রেখে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করি।

আমার কেন যেন মনে হয়, যে খুন করেছে এইভাবে পর পর ম্যানেজারদের, সে এখানে সর্বদা উপস্থিত থাকে। কিন্তু কি ভাবে সে এখানে থাকতে পারে? কর্মচারীদের মধ্যে একজন হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা তাতে চট করে ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুব বেশী। তবে কেমন করে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে? অথচ এ কথা যখন অবধারিত, এখানে সর্বদা উপস্থিত না থাকলে চারিদিকে দেখেশুনে তার পক্ষে মানুষ খুন করা সম্ভব হয় না, তখন নিশ্চয়ই কুলিদের মধ্যেই তাদের একজন হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।

সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করে দিই।

এবং এখানে আসবার দিন রাত্রে যখন কুলিদের মধ্যে একজন খুন হল, সে-সময় আমি কুলিদের ধাওড়ার মধ্যেই কুলি সেজে উপস্থিত ছিলাম; কুলিটাকে খুন করে সুধাময় কুলির ছদ্মবেশে যখন পালায় তখন আমি অন্ধকারে অনুসরণ করে তার ঘরটা দেখে আসি।

বিমলবাবু ও চন্দনসিংয়ের সাহায্যে নজন কুলিকে রাতারাতি ধানবাদে কাজের অছিলায় হাঁটাপথে রেল লাইন ধরে প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে বিদায় করে মাত্র একজন কুলি নিয়ে বিমলবাবুর সাহায্যে রামলোচনের জামার পকেট থেকে চাবি চুরি করে, খনির মধ্যে নেমে ডিনামাইট দিয়ে পিলার ধসিয়ে ১৩নং কাঁথি ভাঙা হয় তাও আমার নজর এড়ায় না। সুব্রত, তুমি রুমালে বাঁধা পলতে ও ডিনামাইট পেয়েছ!

পরের দিন সকলে জানল দশজন লোক মারা গেছে। যদিও মারা গেল একজন মাত্র। এটা শুধু কুলিদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করবার জন্য সাজিয়ে করা হয়েছিল।

ম্যানেজারদের মারা হয় চারিদিকে সকলের মনে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক জাগাবার জন্য, যাতে করে খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং খনির কাজ বন্ধ হয়ে গেলে নিজে শেয়ার ছেড়ে দেবার ভান দেখিয়ে ঝুনঝুনওয়ালাকে দিয়ে তার শেয়ারও বিক্রি করিয়ে বেনামীতে সমগ্র খনিটা কিনে নিলেই কাজ হাসিল হয়ে যায়।

সব কিছু প্রায় হয়ে এল, সুধাময় ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে চিঠিপত্র লিখে যখন সব ঠিক করে ফেললে, তখন তার অপকর্মের সহায়ক বিমলবাবু ও চন্দনসিংকে সরাবার মতলব করল।

গতকাল বিমলকে মারলেও চন্দনসিং নাগালের বাইরে পালিয়ে গেল। কেননা প্রভুর মনোগত ইচ্ছাটা সে আগেই টের পেয়েছিল। Metallic nails পরে তাতে বিষ মাখিয়ে হাতের আঙুলে পরে, তার সাহায্যে গলা টিপে সুধাময় কাজ হাসিল করত। Strangle করবার সময় সেই metallic nails গলার মাংসে বসে গিয়ে বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটাত। এখন কথা হচ্ছে, শার্দুলের ডাক যেটা শোনা যেত সেটা আর কিছুই নয় সুধাময় নিজেই মুখ দিয়ে বাঘের হুবহু অনুকরণ করতে পারত। তোমরা হয়ত শুনে থাকবে এক-একজন অবিকল পশুপক্ষীর ডাক মুখ দিয়ে অনুকরণ করতে পারে। এটা একটা মানুষকে ভয় দেখাবার ফন্দি। তাছাড়া খুব উঁচু হিলওয়ালা একপ্রকার কাঠের জুতো পরে গায়ে একটা ধূসরবর্ণের ওড়না চাপিয়ে সুধাময় মাঠের মধ্যে দিয়ে দ্রুতবেগে চলত। একে সে একটু বেশিরকম লম্বা ছিল, তার ওপরে কাঠের জুতো পরাতে তাকে বেশ অস্বাভাবিক রকম বলে মনে হত। কাঠের জুতো ব্যবহার করবার মধ্যে আর একটা মতলব তার ছিল; পায়ের ছাপ পড়ত না। সুব্রতকে মারবার জন্য একটা সাঁওতাল কুলিকে সুধাময়বাবুই engage করেছিলেন; কুলিটা বিষাক্ত তীর ছুঁড়ল, কিন্তু unsuccessfull হল। কিন্তু সুব্রতকে তীর ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুধাময়ও লোকটাকে গুলি করে মারে। আমি সেই সময় ওদের পেছনেfollow করতে করতে উপস্থিত ছিলাম বলে সব ব্যাপারটা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। এই হল এখানকার খনির মৃত্যুরহস্য।

কিরীটী চুপ করল।

আমাদের গল্পও এইখানেই শেষ হল।

Exit mobile version