কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে দশজন কুলী চাপা পড়ে মারা গেছে!
কাল রাত্রে মানে? অর্থাৎ আপনি বলতে চান রাত্রিতে কাল কয়লাখনিতে কাজ হচ্ছিল?
আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না! তার মানে? এই তো বললেন কাল রাত্রে ১৩নং কাঁথিতে দশজন মারা গেছে!
আজ্ঞে তা তো গেছেই–
খনিতে কয়লা কাটার কাজ না থাকলে কেন তারা সেখানে গিয়েছিল? নিশ্চয়ই খনির মধ্যে লুকোচুরি খেলতে নয়? এ খনির নিয়ম কি? পাঁচটার মধ্যে খনির সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায় তো? রাত্রে কোন কাজ হয় না?
আজ্ঞে!
তবে তারা রাত্রে খনির মধ্যে কি করে গেল? চানক সন্ধ্যা পাঁচটার পর খাদে লোক নামায় না তো!
না, তা নামায় না। এবং রাত্রি সাতটা পর্যন্ত চানক ভোলা থাকে খাদের লোক শুধু ওঠাবার জন্য।
এমনও তো হতে পারে শঙ্করবাবু, সেই দশটি লোক গত রাত্রে খাদ থেকে মোটে ওঠেইনি, খাদেই ছিল? হঠাৎ সুব্রত বলে।
Impossible! খনির কুলিদের নামের একটা লিস্ট আছে। খাদে যারা নামে ও কাজশেষে খাদ থেকে উঠে আসে, নামের Registry-র সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয় তাদের নাম। এতে ভুলচুক হওয়া সম্ভব নয় সুব্রতবাবু!
কিন্তু আগে সব কিছুর খোঁজ নেওয়া দরকার শঙ্করবাবু। চলুন দেখা যাক খোঁজ নিয়ে আসলে ব্যাপারটা কি?
বেশ, চলুন।
তখনি দুজন রামলোচন ও টুইলাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পথ চলতে চলতে সুব্রত শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করল, নামের রেজিস্ট্রি খাতা কার কাছে থাকে শঙ্করবাবু?
সরকারবাবু—আমাদের বিমলবাবুর কাছে থাকে।
তিনি তো নাম মিলিয়ে নেন?
হ্যাঁ।
তবে আগে চলুন বিমলবাবুর খোঁজটা নেওয়া যাক, তিনি হয়তো এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
চলুন।
শীতের সকাল। পথের দুপাশের কচি দূর্বাদলগুলির গায়ে রাতের শিশিরবিন্দুগুলি সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই খনির সীমানা পড়ে। ট্রাম-লাইনের পাশে একটা শূন্য কয়লা গাড়ির চারদিকে একদল সাঁওতাল জটলা পাকাচ্ছে, সকলেরই মুখে একটা ভয়চকিত ভাব।
শঙ্করকে আসতে দেখে দলের মধ্যে একটা মৃদু গুনগুন ধ্বনি জেগে উঠল।
কুলীদের সর্দার রতন মাঝি এগিয়ে এল।
কি খবর মাঝি? কিছু বলবি?
আমরা আর ইখানে কাম করতে পারব বাবু!
কেন রে?
ই খনিতে ভূত আছে, বাবু।
ভূত? ওসব বাজে কথা, তাছাড়া কার ছেড়ে দিলে খাবি কি?
কিন্তক তুরাই বল কেনে বাবু, প্রাণটি হাতে নিয়ে এমনি করে কেমনে কাজ করি—
চন্দন সিং ও বিমলবাবু এসে হাজির হলেন।
এই যে বিমলবাবু, কাল রেজিস্ট্রি খাতা আপনি মিলিয়েছেন তো? শঙ্কর প্রশ্ন করল।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সকলে খাদ থেকে উঠে এসেছিল working hours-এর পরে–মানে যারা কাল দিনের বেলায় কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিল, তারা সকলে আবার খাদ থেকে ফিরে এসেছিল তো?
তা এসেছিল বৈকি।
তবে এই রকম দুর্ঘটনা ঘটল কি করে? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই? চানক যে চালায় সে লোকটা কোথায়?
কে, আবদুল?
হ্যাঁ।
সে চানকের মেসিনের কাজেই আছে।
তাকে একবার ডেকে আনুন।
বিমলবাবু আবদুল ডাকতে চলে গেলেন।
রতন মাঝি আবার এগিয়ে এল, বাবু, আমরা কুলীকামিনরা আজ চলে যাবে রে!
তোদের কোন ভয় নেই। দুটো দিন সবুর কর, আমি সব ঠিক করে দেব। ভূতটুত ওসব যে একদম বাজে কথা, এ আমি ধরে দেব। যা তোরা যে যার কাজে যা!
কিন্তু দেখ গেল শঙ্করের আশ্বাসবাক্যেও কেউ কাজে যাবার কোন গরজই দেখাচ্ছে না।
তু কি বলছিস বাবু, আমি বোঙার নামে কিরা কেটে বলতে পারি এ খনিতে ভূত আছে!
এমন সময় বিমলবাবু আবদুল মিস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।
আবদুলকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত সন্ধ্যায় সে যথারীতি আটটার মধ্যেই চানক বন্ধ করে চলে গিয়েছিল এবং সে যতদূর জানে খাদে আর কেউ তখন ছিল না।
চানকের এঞ্জিনে চাবি দেওয়া থাকে না মিস্ত্রী?
জিজ্ঞাসা করল সুব্রত।
হ্যাঁ, সাবু।
চাবি কার কাছে থাকে?
আজ্ঞে আমার কাছেই তো।
আচ্ছা আজ সকালে চানকের এঞ্জিনের কাছে গিয়ে এঞ্জিনে চাবি দেওয়াই দেখতে পেয়েছিলে তো?
হ্যাঁ, সাব।
চলুন শঙ্করবাবু, খাদের যে কাঁথিতে পিলার ধসে গেছে সে জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসি।
বেশ, চলুন। আসুন বিমলবাবু, চল চন্দন সিং।
তখন সকলে মিলে খাদের দিকে রওনা হল।
০৭. নেকড়ার পুঁটলি
এক, দো, তিন!!!
কয়লা খাদের মুখে অসেটার ঘণ্টা বাজালে, এক, দো, তিন–
ঠং ঠং ঠং।…ঘণ্টার অদ্ভুত আওয়াজ, এক দো তিন বলবার সঙ্গে সঙ্গে গম্ গম্ ঝন্ ঝন্ করে চানকের গহ্বরের স্তরে স্তরে প্রতিধ্বনিত হল।
পাতালপুরীর অন্ধ গহ্বর থেকে যেন মরণের ডাক এল—আয়! আয়! আয়!
এ যেন এক অশরীরী শব্দমুখর হাতছানি।
রেজিংবাবু রামলোচন পোদ্দার চানকের মুখে আগে এসে দাঁড়াল।
তিন ঘণ্টার মানে মানুষ এবারে খাদে চানকের সাহায্যে নামবে তারই সংকেত।
চানকের রেলিং-ঘেরা খাঁচার মত দাঁড়াবার জায়গায় শঙ্কর, রেজিংবাবু, সুব্রত, রতন মাঝি ও আরও দুজন সদার গ্যাসল্যাম্প নিয়ে প্রবেশ করল।
অন্ধকার গহর-পথে ঘড়ঘড় শব্দে চানক নামতে শুরু করল।
বাইরের রৌদ্রতপ্ত পৃথিবী যেন সহসা সামনে থেকে ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
উপরের সুন্দর পৃথিবী যেন খাদের এই বীভৎস অন্ধকারের সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে দূরে সরে গেছে।
সকলে এসে খাদের মধ্যে নামল।
কঠিন স্তব্ধ অন্ধকার। কালো কয়লার দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মিশে এক হয়ে গেছে।