চলুন ম্যানেজারবাবু, ওদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। পুলিসে খবর দিতে হবে, লাশ ময়নাতদন্তে যাবে। যত সব হাঙ্গামা! পোষাবে না বাপু এখানে আর আমার চাকরি করা। ভূতের আড্ডা! কে জানে কবে হয়ত আবার আমার ওপরেই চড়াও হবে! বাপ মা ছেলেপিলে ছেড়ে এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণটা শেষে কি খোয়াব?
চলুন শঙ্করবাবু, কোয়াটারে ফেরা যাক। সুব্রত বলে।
সকলে কুলী-ধাওড়া ছেড়ে কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াল। সকলেই নীরবে পথ অতিবাহিত করে চলেছে, কারও মুখে কোন কথা নেই।
পথ চলতে চলতে একসময় বিমলবাবু বলল, বলছিলাম না, এই কোলফিল্ডটা একটা পরিপূর্ণ অভিশাপ! এখানে কারও মঙ্গল নেই। কিন্তু এবারে দেখছি আপনি স্যার বেঁচে গেলেন। এর আগের বারের আক্রোশগুলো ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়েই গেছে এবং আগেকার ঘটনা অনুযায়ী বিপদটা আপনার ঘাড়েই আসা উচিত ছিল। তা যাক, ভলই হল এক দিক দিয়ে।
তার মানে? সহসা সুব্রত প্রশ্ন করে বসল।
বিমলবাবু যেন সুব্রতর প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মানে—মানে আর কি! ওই কুলীগুলোর জীবনের আর কী দাম আছে বলুন? ওদের দু-দশটা মরলে কী এসে গেল!
সহসা স্তব্ধ রাতের মৌনতাকে ছিন্নভিন্ন করে সোহাগীর করুণ কান্নার আকুল রেশ কানে এসে বাজল সবার। ঝন্টু রে—তু ফিরে আয় রে! ওরে আমার ঝন্টু রে!
সুব্রতর পায়ের গতিটুকু যেন সহসা লোহার মত ভারী হয়ে অনড় হয়ে গেল। বিমলবাবুর দিকে ফিরে শ্লেষমাখা সুরে সে বলল, তা যা বলেছেন বিমলবাবু! দুনিয়ার আবর্জনা ওই গরীবগুলো। যাদের মরণ ছাড়া আর গতি নেই, এ সংসারে তারা মরবে বৈকি!
নিশ্চয়ই। আপনিই বলুন না, ওই জংলীগুলোর প্রাণের দাম কি-ই বা আছে? বিমল বলে ওঠে।
০৬. খাদে রহস্যময় মৃত্যু
বাকি রাতটুকু সুব্রতর চোখে আর ঘুম এল না। সে আবার অর্ধসমাপ্ত চিঠিখানা নিয়ে বসল।
কিরীটী, চিঠিটা তো শেষ করেই রেখেছিলাম, কিন্তু সেই রাত্রেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটা তোকে না লিখে পারলাম না। কুলী-ধাওড়ায় ঝন্টু নামে এক সাঁওতাল যুবক রাত্রে খুন হয়েছে। বিমলবাবু প্রমাণ করতে চান, ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভৌতিক। অর্থাৎ ভূতের কাণ্ড। তবে মৃতের গলার পিছনদিকে আগের মতই চারটি ভয়ঙ্কর কালো ছিদ্র আছে দেখলাম। আমার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন খুবই সহজ। জলের মতই সহজ।…তোর চিঠির প্রত্যুত্তরের আশায় রইলাম। চিঠি পেলেই ভাবছি শ্রীমানকে পুলিসের হাতে তুলে দেব। কেননা ওই ধরনের শয়তান খুনীদের এমন সহজভাবে দশজনের সঙ্গে চলে-ফিরে বেড়াতে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? আমার যতদূর মনে হয়, আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ব্যাপারটার একটা সহজ মীমাংসা করে দিতে পারব। তোর উপস্থিতির বোধ হয় আর প্রয়োজন হবে না। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা রইল। তোর সুব্রত।
চিঠিটা শেষ করে সুব্রত চেয়ার থেকে উঠে একটা আড়ামোড়া ভাঙল।
রাতের আকাশের বিদায়ী আঁধার দিগ্বলয়ের প্রান্তকে তখন ফিকে করে তুলেছে।
সুব্রত বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
শীতের হাওয়া ঝিরঝির করে সুব্রতর শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহমনকে যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
ঘুমোননি বুঝি সুব্রতবাবু!
শঙ্করের গলার স্বর শুনে সুব্রত ফিরে দাঁড়াল।
এই যে আপনিও উঠে পড়েছেন দেখছি। ঘুমোতে পারলেন না বুঝি?
না, ঘুম এল না। কিন্তু গতরাত্রের ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কি মনে হয় সুব্রতবাবু?
দেখুন শঙ্করবাবু, ব্যাপারটা যে খুব কঠিন বা জটিল তা কিছু নয়, তবে এটা ঠিক যে, এর আগে যে-সব খুন এখানে হয়েছে তার সমস্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে চট করে উপনীত হতে পারছি না। যতদূর মনে হয় এর পিছনে একটা দল আছে, অর্থাৎ একদল শয়তান এই ভয়ঙ্কর খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে।
বলেন কি?
হ্যাঁ, তাই। একজন লোকের ক্ষমতা নেই এত tactfully এতগুলো লোকের মধ্যে থেকে এমন পরিষ্কার ভাবে খুন করে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।
.
হাত-মুখ ধুয়ে চা পান করতে করতে শঙ্কর আর সুব্রত গতরাত্রের ঘটনারই আলোচনা করছিল, এমন সময় একটা কুলী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির, বাবু গো, সর্বনাশ হয়েছে!
কি হয়েছে?
তের নম্বর কাঁথিতে পিলার ধসে গিয়ে কাল রাত্রে দশজন সাঁওতাল কুলী মারা গেছে।
শঙ্কর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।
সর্বনাশ! এক রাত্রে দশ-দশটা লোকের একসঙ্গে মৃত্যু! কিন্তু রাত্রে তো এ মাইনে কাজ চালাবার কথা নয়? তবে—তবে কেমন করে এ দুর্ঘটনা ঘটল?
রেজিৎবাবু কোথায় রে টুইলা? শঙ্কর কুলীটাকে প্রশ্ন করল।
রেজিংবাবু তো ওধারপানেই আসতেছে দেখলুম বাবু। দেখা গেল সামনের অপ্রশস্ত কাঁচা কয়লার গুঁড়ো ছড়ানো রাস্তাটা ধরে একপ্রকার দৌড়তে দৌড়তে রামলোচন পোদ্দার আসছে। রামলোচনবাবু এসে শঙ্করের সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। মোটাসোটা চর্বিবহুল নাদুসনুদুস চেহারাখানি, পরনে খাকি হাফ প্যান্ট ও খাকি হাফ শার্ট। ঠোঁটের ওপরে বেশ একজোড়া পাকানো গোঁফ। মাথায় সুবিস্তীর্ণ টাক চক্ করে। বয়েস বোধ করি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে।
এ কি শুনছি রামলোচনবাবু?
সর্বনাশ হয়ে গেছে, ঠিকই শুনেছেন স্যার–একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই খনি বুঝি আর চালানো গেল না!
সব খুলে বলুন।