কাল তোকে এসে পৌঁছানোর সংবাদ দিয়েছি। আজ এখানকার আশপাশ অনেকটা ঘুরে এলাম। ধূ-ধূ মাঠ, যেদিকে তাকাও জনহীন নিস্তব্ধতা, যেন চারিদিকের প্রকৃতির কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে।
বহুদূরে কালো কালো পাহাড়ের ইশারা, প্রকৃতির বুক ছুঁয়ে যেন মাটির ঠাণ্ডা পরশ নিচ্ছে। বর্তমানে যেখানে এদের কোল্ফিল্ড বসেছে, তারই মাইলখানেক দূরে বহুকাল আগে একসময় একটা কোল্ফিল্ড ছিল। আকস্মিকভাবে এক রাত্রে সে খনিটা নাকি ধ্বসে মাটির বুকে বসে যায়। এখনও মাঝে মাঝে বড় বড় গর্তমত আছে। রাতের অন্ধকারে সেই গর্তের মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়।
অভিশপ্ত খনির বুকে দুর্জয় আক্রোশ এখনও যেন লেলিহান অগ্নিশিখায় আত্মপ্রকাশ করে। আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে ফিরছি, অন্ধকার চারিদিকে বেশ ঘনিয়ে এসেছে, সহসা পিছনে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছনপানে ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য, কেউ যে এত লম্বা হতে পারে ইতিপূর্বে আমার ধারণা ছিল না!
লম্মায় প্রায় ছ হাত হবে। যেমন উঁচু লম্বা, তেমনি মনে হয় যেন বলিষ্ঠ গঠন। আগাগোড়া একটা ধূসর কাপড় মুড়ি দিয়ে হনহন করে যেন একটা ঝড়ো হাওয়ার মত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মাঠের অপর প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
আমি নির্বাক হয়ে সেই অপস্রিয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা অদ্ভুত বাঘের ডাক কানে এসে বাজল।
এত কাছাকাছি মনে হল–যেন আশেপাশে কোথায় রাঘটা ওৎ পেতে শিকারের আশায় বসে আছে।
তুই হয়ত বলবি আমার শোনবার ভুল, কিন্তু পর পর তিনবার স্পষ্ট বাঘের ডাক আমি শুনেছি।
তাছাড়া তুই তো জানিস, সাহস আমার নেহাৎ কম নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ প্রান্তরের মাঝে গুরুগম্ভীর সেই শার্দুলের ডাকে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন অকস্মাৎ সিরসির করে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম বাসায় ফেরবার জন্য।
চিঠিটা এই পর্যন্ত লেখা হয়েছে, এমন সময় রাতের নিস্তব্ধ আঁধারের বুকখানা ছিন্নভিন্ন করে এক ক্ষুধিত শার্দুলের ডাক জেগে উঠল।
একবার, দুবার, তিনবার।
সুব্রত চমকে শয্যা থেকে লাফিয়ে নীচে নামল।
তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেবিল-ল্যাম্পটা মাটিতে ছিটকে পড়ে চুরমার হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
আলোর চিমনিটা ভাঙার ঝনঝন শব্দে ততক্ষণে শঙ্করের ঘুমটাও ভেঙে গেছে।
ত্রস্তে শয্যার ওপরে বসে চকিত স্বরে প্রশ্ন করলে, কে?
শঙ্করবাবু, আমি সুব্রত।
সুব্রতবাবু!
হ্যাঁ। ধাক্কা লেগে আলোটা ছিটকে পড়ে ভেঙে নিভে গেল।
বাইরে একটা চাপা অস্পষ্ট গোলমালের শব্দ কানে এসে বাজে।
অনেকগুলো লোকের মিলিত এলোমেলো কণ্ঠস্বর রাতের নিস্তব্ধতায় যেন একটা শব্দের ঘূণাবর্ত তুলেছে।
বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা যাচ্ছে না, সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ।
কিসের গোলমাল?
বুঝতে পারছি না, তবে যতদূর মনে হয়, গোলমালটা কুলিবস্তির দিক থেকে আসছে। সুব্রত বললে, চলুন একবার খবর নেওয়া যাক।
বেশ চলুন।
দুজনে দুটো লং কোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় উলের নাইট-ক্যাপ পরে দুটো টর্চ হাতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হল।
গোলমালটা ক্রমে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘরের দরজা খুলে সুব্রত বেরুতে যাবে, এমন সময় আকাশ-পাতাল-ফাটানো একটা বাঘের কুদ্ধ গর্জন রাত্রির আঁধারকে যেন ফালি ফালি করে জেগে উঠল আবার অকস্মাৎ।
এবং এবারেও একবার, দুবার, তিনবার।
সুব্রতর সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত ও কঠিন, মনের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীগুলি সজাগ হয়ে উঠেছে।
শঙ্কর ঘরের মাঝখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেছে। যেন সহসা একটা তীব্ৰ বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় ও পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। প্রথমটা কারও মুখে কোন কথাই নেই। কিন্তু সহসা সুব্রত যেন ভিতর থেকে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে সজাগ হয়ে উঠে এক ঝটকায় ঘরের খিল খুলে ফেলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় টচটা জ্বেলে লাফিয়ে পড়ল।
আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা বোধ হয় ঘটতে কুড়ি সেকেণ্ডও লাগেনি।
সুব্রতকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে প্রথমটা শঙ্কর বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই সেও সুব্রতকে অনুসরণ করলে।
বাইরের অন্ধকার বেশ ঘন ও জমাট। সুব্রতর হাতে টর্চের তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মি, অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে ঘুরে এল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
বাঘ তো দূরের কথা, একটা পাখি পর্যন্ত নেই।
ততক্ষণে শঙ্করও সুব্রতর পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাঘের ডাক তো স্পষ্ট শোনা গেছে!
তবে?
বুঝতে পারিছ না, সত্যি সত্যিই এ কি তবে ভৌতিক ব্যাপার!
বলতে বলতে শঙ্কর আবার হাতের টর্চের বোতামটা টেপে। মাঠের মাঝখানে কুলিবস্তি ও কলিয়ারীতে যাবার পথে কতকগুলি কাজঁই ও বাবলা গাছ পড়ে। সেইদিকে শঙ্করের হাতের অনুসন্ধানী বৈদ্যুতিক বাতির রশ্মি পড়তেই দুজনে চমকে উঠল, কে? কে ওখানে?
একটা কালো মৃর্তি। তার গায়ে সাদা সাদা ডোরা কাটা।
চকিতে সুব্রত কোমরবন্ধ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা টেনে বের করলে এবং চাপা গলায় বললে, ওই দেখুন বাঘ! সরে যান, গুলি করি!
শেষের কথাগুলো উত্তেজনায় যেন বেশ তীক্ষ্ণ সজোরে সুব্রতর কণ্ঠে ফুটে বের হয়ে এল।
স্যার আমি! গুলি করবেন না স্যার! ইয়োর মোস্ট ফেথফুল অ্যাণ্ড ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট!