বিমলবাবু বললেন! তারপর সহসা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। বসো ঐ চেয়ারটায়। তোমার সঙ্গে গোটাকতক কথা আছে।
চন্দন সিং একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল।
এখানকার চাকরি তোমার কেমন লাগছে চন্দন?
পেটের ধান্ধায় চাকরি করতে এসেছি স্যার, আমাদের পেট ভরলেই হল স্যার।
না, তা ঠিক বলছি না। এই যে পর পর দুজন ম্যানেজার এমনিভাবে নিহত হলেন—
সহসা চন্দন সিংয়ের মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়তে শঙ্কর চমকে উঠল। চন্দনের সমগ্র মুখখানি ব্যেপে যেন একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিন্তু চন্দন সিং সেটা সামলে নিল।
শঙ্কর বলতে লাগল, তোমার কী মনে হয় সে সম্পর্কে?
চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হয় যেন কী একটা কিছু বেচারী প্রাণপণে এড়িয়ে যেতে চায়।
তুমি কিছু বলবে চন্দন?
সোৎসুকভাবে শঙ্কর চন্দন সিংয়ের মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা যদি বলি, অসন্তুষ্ট হবেন না তো স্যার?
না, না–বল কি কথা?
আপনি চলে যান স্যার। এ চাকরি করবেন না।
কেন? হঠাৎ এ-কথা বলছ কেন?
না স্যার, চলে যান আপনি। এখানে কারও ভালো হতে পারে না।
ব্যাপার কি চন্দন? এ বিষয়ে তুমি কি কিছু জান? টের পেয়েছ কিছু?
ভূত!…আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ভূত!
হ্যাঁ। অত বড় দেহ কোন মানুষের হতে পারে না।
আমাকে সব কথা খুলে বল চন্দন সিং!
আপনার আগের ম্যানেজার সুশান্তবাবুমারা যাবার দিন-দুই আগে বেড়াতেবেড়াতে পশ্চিমের মাঠের দিকে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিকে অস্পষ্ট আঁধার, হঠাৎ মনে হল পাশ দিয়ে যেন ঝড়ের মত কী একটা সন্ন্ করে হেঁটে চলে গেল। চেয়ে দেখি লম্বায় প্রায় হাত পাঁচ-ছয় হবে। আগাগোড়া সর্বাঙ্গ বাদামী রংয়ের আলখাল্লায় ঢাকা।
সেই অস্বাভাবিক লম্বা মূর্তিটা কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একটা পৈশাচিক অট্টহাসি শুনতে পেলাম। উঃ,সে হাসি মানুষের হতে পারে না।
তারপর?
তার পরের দিনই সুশান্তবাবুও মারা যান। শুধু আমিই নয়, সুশান্তবাবুও মরবার আগের দিন সেই ভয়ঙ্কর মৃর্তি নিজেও দেখেছিলেন।
কি রকম?
রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সে রাতে কুয়াশার মাঝে পরিষ্কার না হলেও অল্প অল্প চাঁদের আলো ছিল–রাত্রে বাথরুম যাবার জন্য উঠেছিলেন, হঠাৎ ঘরের পিছনে একটা খুকখুক কাশির শব্দ পেয়ে কৌতূহলবশে জানালা খুলতেই দেখলেন, সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝড়ের মত হেঁটে যাচ্ছে।
সে মৃর্তি আমি আজ স্বচক্ষে দেখলাম শঙ্করবাবু! দুজনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বক্তা সুব্রত। সে এর মধ্যে কখন একসময়ে ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
০৪. আঁধারে বাঘের ডাক
কী দেখেছেন?
ভূত! চন্দনবাবুর ভূত! সুব্রত একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললে। তারপর চন্দন সিংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি আমাদের শঙ্করবাবুর অ্যাসিটেন্ট?
চন্দন সিং সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় হেলাল।
এখানকার ঠিকাদার কে, চন্দনবাবু?
ছট্টু লাল।
তার সঙ্গে একটিবার আলাপ করতে চাই। কাল একটিবার দয়া করে যদি পাঠিয়ে দেন তাকে সন্ধ্যার দিকে!
দেব, নিশ্চয়ই দেব।
আচ্ছা চন্দনবাবু, আপনাকে কটা কথা যদি জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন না?
সে কি কথা! নিশ্চয়ই না। বলুন কি কথা?
আমি শঙ্করবাবুর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছি, জানেন তো?
জানি।
কিন্তু এখানে পৌঁছে ওঁর আগেকার ম্যানেজারের সম্পর্কে যে কথা শুনলাম, তাতে বেশ ভয়ই হয়েছে আমার।
নিশ্চয়ই, এ তো স্বাভাবিক। আমি ওঁকে বলছিলাম এখানকার কাজে ইস্তফা দিতে। আমার মনে হয় ওঁর পক্ষে এ জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।
আমারও তাই মত। সুব্রত চিন্তিতভাবে বললে।
কি বলছেন সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ—ঠিকই বলছি—
কিন্তু স্রেফ একটা গাঁজাখুরি কথার ওপরে ভিত্তি করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমার মন কিন্তু মোটেই সায় দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দেখে তবে এ জায়গা থেকে নড়ব–তাই আমার ইচ্ছে সুব্রতবাবু। শঙ্কর বললে।
বড় রকমের একটা বিপদ-আপদ যদি ঘটে এর মধ্যে শঙ্করবাবু?…অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপার, কখন কি হয় বলা তো যায় না।
যে বিপদ এখনও আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে, তার ভয়ে লেজ গুটিয়ে থাকব এই বা কোন দেশী যুক্তি আপনাদের? শঙ্কর বললে।
যুক্তি হয়ত নেই শঙ্করবাবু, কিন্তু অ-যুক্তিটাই বা কোথায় পাচ্ছেন এর মধ্যে! সুব্রত বলে!
কিন্তু, চন্দন সিং বলে, শুনুন, শুধু যে ঐ ভীষণ মূর্তি দেখেছি তাই নয় স্যার, মাঝে মাঝে গভীর রাতে কী অদ্ভুত শব্দ, কান্নার আওয়াজ মাঠের দিক থেকে শোনা যায়। এ ফিল্ডটা অভিশাপে ভরা।…কেউ বাঁচতে পারেনা। বাঁচা অসম্ভব। এর আগে তিনবার আক্রমণটা ম্যানেজারবাবুদের ওপর দিয়ে গেছে-কে বলতে পারে এর পরের বার অন্য সকলের ওপর দিয়ে যাবে না!
সে রাত্রে বহুক্ষণ তিনজনে নানা কথাবার্তা হল।
চন্দন সিং যখন বিদায় নিয়ে চলে গেল, রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে।
শঙ্কর একই ঘরে দুপাশে দুটো খাট পেতে নিজের ও সুব্রতর শোবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।
শঙ্করের ঘুমটা চিরদিনই একটু বেশী। শয্যায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে নাক ডাকতে শুরু করে দেয়।
আজও সে শয্যায় শোরার সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে শুরু করে দিল। সুব্রত বেশ করে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে টেবিলল্যাম্পটা বসিয়ে তার আলোয় কিরীটীকে চিঠি লিখতে বসল। কিরীটী