কিরীটী বললে:
করিয়াছি মন
সুদূর কাতরাসগড়।
বারেক আসিব ঘুরি
নে নে, থামা বাবা তোর কবিতা! সত্যি হঠাৎ কাতরাসগড় চলেছিস কেন?
কিরীটী সোফার ওপরে সোজা হয়ে বসে, হাতের প্রায়-নিভন্ত সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে বললে, হৈ-হৈ ব্যাপার, রৈরৈ কাণ্ড!
অর্থাৎ?
শোন। কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি একটা কোল্ফিল্ড আছে। সেটার মালিক পূর্ববঙ্গের কোন এক যুবক জমিদার-নন্দন।
তারপর?
কলিয়ারী স্টার্ট করা হয়েছে; অর্থাৎ তোমার কলিয়ারীর গোড়াপত্তন আরম্ভ করা হয়েছে মাস-দুই হল।
থামছিস কেন, বল না!
কিন্তু মাস-দুয়েকের মধ্যে তিন তিনটে ম্যানেজার খুন হয়েছেন।
তার মানে?
আরে সেই মানেই তো solve করতে হবে।
বুঝলাম। তা কী করে ম্যানেজার তিনজন মারা গেলেন?
ময়না-তদন্তে জানা গেছে তাঁদের গলা টিপে মারা হয়েছে এবং গলার পিছন দিকে মারাত্মক রকমের চারটি করে ছিদ্র দেখতে পাওয়া গেছে। তাছাড়া অন্য কোন দাগ বা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।
শরীরের অন্য কোন জায়গায়ও না?
না, তাও নেই।
আশ্চর্য!
তা আশ্চর্যই বটে! সত্যিই আশ্চর্য সেই চারটি কালো ছিদ্র! এবারকার নতুন ম্যানেজার হচ্ছে আমারই কলেজ-ফ্রেণ্ড শঙ্কর সেন। সেও তোমার মতই গোঁইয়ার-গোবিন্দ ও একজন পাকা অ্যাথলেট। সে সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে আমায় সেখানে যেতে লিখেছে।
দেখ কিরীটী, সুব্রত বললে, একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে!
যথা?
এবারকার রহস্যের কিনারার ভারটা আমার ওপরে ছেড়ে দে। এতদিন তোমার সাকরেদি করলাম, দেখি পারি কিংবা হারি-হরি।
বেশ তো। আমার সঙ্গেই চল না।
না, তা হবে না। পুরোপুরি আমার হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে তুই মাথা দিতে পারবি না!
পুরাতন কলেজ-ফ্রেণ্ড, যদি অসন্তুষ্ট হয়?
কেন, অসন্তুষ্ট হবে কেন? আমি হালে পানি না পাই, তবে না-হয় তুই অবতীর্ণ হবি!
কিন্তু তখন যদি সময় আর না থাকে, বিশেষ করে একজনের জীবনমরণ যেখানে নির্ভর করছে!
সব বুঝি কিরীটী। তার নিয়তি যদি ঐ কলিয়ারীতেই থাকে তবে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। তুই আমি তো কোন্ কথা, স্বয়ং ভগবানও পারবে না।
তা বটে। তা বেশ, তুই তাহলে কাল রওনা হয়ে হ্যাঁ। শঙ্করকে একটা চিঠি ড্রপ করে দেব সমস্ত ব্যাপার খুলে লিখে।
হ্যাঁ, তাই দে। ভয় নেই কিরীটী, সুব্রত রায়কে তুই এটুকু বিশ্বাস করতে পারিস, বুদ্ধির খেলায় না পারি দেহের সবটুকু শক্তি দিয়েও তাকে প্রাণপণে আগলাবই।
দেহের শক্তিতে সেও কম যায় না সুব্রত। একটু গোলমাল ঠেকলেই কিন্তু তুই আমায় খবর দিস ভাই। অবিশ্যি চিঠি থেকে যতটুকু ধরতে পেরেছি তাতে ব্যাপারটা যে খুব জটিল তা মনে হয় না। এক কাজ করিস তুই, বরং প্রত্যেক দিন কতদূর এগুলি বিশদভাবে আমায় চিঠি লিখে জানাস, কেমন?
বেশ, সেই কথাই রইল।
০৩. মানুষ না ভূত
কোল্ফিল্ডটা প্রায় উনিশ-কুড়ি বিঘে জমি নিয়ে।
ধূ-ধূ প্রান্তর। তার মাঝে একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে কুলিবস্তি বসানো হয়েছে। টেমপোরারি সব টালি ও টিনের সে তুলে ছোট ছোট খুপরী তোলা হয়েছে। কোন-কোনটার ভিতর থেকে আলোর কম্পিত শিখার মৃদু আভাস পাওয়া যায়। অল্প দূরে পাকা গাঁথনি ও উপরে টালির সে দিয়ে ম্যানেজারের ঘর তোলা হয়েছে এবং প্রায় একই ধরনের আর দুটি কুঠি ঠিকাদার ও সরকারের জন্য করা হয়েছে। ম্যানেজারের কোয়াটার এতদিন তালাবন্ধই ছিল। বিমলবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দেয়।
কোয়ার্টারের মধ্যে সর্বসমেত তিনখানি ঘর, একখানি রান্নাঘর ও বাথরুম।
মাঝখানে ছোট একটি উঠোন। দক্ষিণের দিকে বড় ঘরটায় একটা কুলি একটা ছাপর খাটের ওপরে শঙ্করের শয্যা খুলে বিছিয়ে দিল।
আচ্ছা আপনি তা হলে হাতমুখ ধুয়ে নিন স্যার। ঠাকুরকে দিয়ে আপনার জন্য লুচি ভাজিয়ে রেখে দিয়েছি, পাঠিয়ে দিচ্ছি গিয়ে। বংশী এখানে রইল।
বিমলবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
শঙ্কর শয্যার ওপরে গা ঢেলে দিল।
রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল।
কিন্তু কুয়াশার আবছায়ায় কিছু বোঝবার জো নেই।
একটু বাদে বিমলবাবুর ঠাকুর লুচি ও গরম দুধ দিয়ে গেল। দু-চারটে লুচি খেয়ে দুধটুকু এক ঢোকে শেষ করে শঙ্কর ভাল করে পালকের লেপটা গায়ে চাপিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন বিমলবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে শঙ্কর দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের অরুণ রাগ তখন ঝিলিক হানছে।
সারাটা দিন কাজকর্ম দেখেশুনে নিতেই চলে গেল।
বিকেলের দিকে সুব্রত এসে পৌঁছল।
কিরীটী তার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল।
সুব্রতর সঙ্গে পরিচিত হয়ে শঙ্কর বেশ খুশীই হল।
তারও দিন দুই পরের কথা।
এ দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবশ্যকীয় কয়েকটা কাগজপত্র শঙ্কর টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় বসে দেখছে।
সুব্রত বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
শঙ্কর উৎকীর্ণ হয়ে উঠল, কে?
আমি স্যার, চন্দন সিং।
ভিতরে এস চন্দন।
চন্দন সিং অল্পবয়েসের পাঞ্জাবী যুবক।
এই কলিয়ারীতে ম্যানেজারের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে কাজে বহাল হয়েছে।
কি খবর চন্দন সিং?
আপনি আমায় ডেকেছিলেন?
কই না! কে বললে? কতকটা আশ্চর্য হয়েই শঙ্কর প্রশ্ন করলে।
বিমলবাবু অর্থাৎ সরকার মশাই বললেন।