ভৃত্য চা দিয়ে গেল। শঙ্কর চায়ের কাপটা টেনে নিল।
তারপর মিঃ সেন, আপনাদের কাজকর্ম চলছে কেমন?
মন্দ না। তবে পর পর এমনভাবে খুন হওয়ায় এখানকার কুলিকামিনদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কাল রাত্রে আমাদের সরকার মশাই বিমলবাবু অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।
কে নিহত হয়েছে?
বিমলবাবু।
The villain! Rightly served. I hated him most amongst my employees, but I am also determined to give up my shares. I am really fed-up with all this. ঝুনঝুনওয়ালাও আজই বিকেলের দিকে এসে পৌঁছচ্ছেন। শুনলাম তিনিও বেচে দেবেন তাঁর share।
মনিবকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম দেখে, শঙ্করের বাংলোয় ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো বেজে গেল।
.
সন্ধ্যার ধূসর ছায়া ধরিত্রীর বুকে যেন রহস্যের যবনিকার মত নেমে এসেছে।
শঙ্করের ডাকবাংলোয় সকলে একত্রিত হয়েছে। খনির দুই অংশীদার সুধাময় চৌধুরী ও হনুমানপ্রসাদ ঝুনঝুনওয়ালা, সুব্রত, কিরীটী, দারোগাবাবু ছদ্মবেশে ও শঙ্কর নিজে। কিরীটী বলেছে আজ অপরাধী কে সকলের সামনে প্রকাশ করে বলবে এবং হাতে হাতে দারোগাবাবুর জিম্মায় দিয়ে দেবে। সুধাময়বাবু ও ঝুনঝুনওয়ালা দুজনেই বলেছেন, অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পারলে দুজনেই পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা কিরীটীকে পুরস্কার দেবেন।
কিরীটী বলতে লাগল : BeforeImention the name let me have my reward first of all with the promise that if I fail I will return the same.
সুধাময়বাবু ও ঝুনঝুনওয়ালা দুজনেই হাসতে হাসতে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকার দুখানা চেক লিখে দিলেন, এই নিন।
তাহলে আপনারা সকলে শুনুন।
এই খনি অভিশপ্ত নয়, ভূতের আস্তানাও নয়; প্রচুর লাভের খনি। এবং আজ পর্যন্ত। এই খনিতে যতগুলো খুন হয়েছে তার জন্যে সর্বাংশে দায়ী খনির অন্যতম অংশীদার স্বয়ং সুধাময় চৌধুরী।…
ঘরের মধ্যে বজ্ৰত হলেও বোধ হয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।
প্রবল ব্যঙ্গমিশ্রিত স্বরে সুধাময়বাবু প্রচণ্ড হাসির তুফান তুলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর এক হাত প্যান্টের পকেটে। সহসা পিস্তলের গর্জন শোনা গেল।
গুড়ুম!
উঃ! একটা বেদনার্ত চিৎকার করে সুধাময়বাবু একপাশে টলে পড়লেন এক হাত দিয়ে ডানদিকের পাঁজরা চেপে ধরে, অন্য হাত থেকে একটা রিভলবার ছিটকে পড়ল।
শয়তান! কুকুর! তোকে কুকুরের মতই গুলি করতে বাধ্য হলাম—দারোগা সাহেব গর্জন করে উঠল, না হলে তুই-ই হয়ত এখনি আমায় গুলি করতিস। জীবনে হয়ত আজ এই প্রথম সত্যিকারের গুলি করতে বাধ্য হলাম, কিন্তু তার জন্য আমার এতটুকু অনুশোচনা হচ্ছে না। যে নৃশংস এতগুলো খুন পর পর করতে পারে তার একমাত্র শাস্তিই পাগলা কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরা।
উঃ কিরীটীবাবু, আপনার কথাই ঠিক। অতি লোভ সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমার মৃত্যুর কারণ হল। হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি—আমিই সব খুন করেছি। উঃ!
ধীরে ধীরে হতভাগ্য সুধাময় চৌধুরীর প্রাণবায়ু বাতাসে মিশে গেল।
সহসা যেন নাটকের যবনিকাপাত ঘটল।
ঘরের সব কটি প্রাণীই স্তব্ধ।
কারও মুখে কোনো কথা নেই।
কিরীটী এতক্ষণে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল, এবারে আমি আমার বক্তব্য সব সংক্ষেপে শেষ করব। কেননা আজকের রাত্রের Bus-ই আমায় ধরতে হবে। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের কাছে খুলে না বললে আমার এই ব্যাপারে explanation-টা সহজবোধ্য হবে না। বর্তমানে এই যে এখানকার কলিয়ারীটা দেখছেন, পঞ্চাশ বছর আগে এই কলিয়ারীর পাশের ঐ একটা কলিয়ারী হঠাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কোনো অজ্ঞাত কারণবশত ধসে যায় এরূপ কিংবদন্তী আছে। তারপর থেকেই এখানকার আশেপাশের লোকেরা এ জায়গাটা সম্পর্কে নানাপ্রকার মনগড়া বিভীষিকার কথা তুলে এটাকে অভিশপ্ত করে তোল। এমনি করে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর কেটে যায়।
কেউ এর পাশে ঘেঁষে না।
এমন সময় কলিয়ারী শুরু করবার ইচ্ছায় মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা ও সুধাময় চৌধুরী এদিকে ঘুরতে ঘুরতে এই অভিশপ্ত ফিল্ডটার সন্ধান পান এবং অচিরে এটার লিজ নেন নব্বই বছরের জন্য খুব সামান্য টাকায়।
কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে আরও বছর চারেক কেটে যায়।
তারপর কাজ শুরু হল।
কাজ বেশ এগুচ্ছে এবং ফিল্ড থেকে প্রচুর কয়লা উঠছে।
এই সময় শয়তান সুধাময়ের মনে কু-মতলব জাগল। তিনি মনে মনে বদ্ধপরিকর হলেন ঝুনঝুনওয়ালাকে ফাঁকি দিতে। কিন্তু কেমন করে ঝুনঝুনওয়ালাকে সরানো যায় সেই চিন্তা করতে লাগলেন।
একদিন খনির কাজ পরিদর্শন করতে এসে সামান্য অজুহাতে খনির সরকার বিকাশবাবু ও ম্যানেজারের অ্যাসিস্টেন্ট সত্যকিংকরবাবুকে বরখাস্ত করে নিজের লোক বিমলবাবু ও চন্দনসিংকে নিযুক্ত করে গেলেন।
চন্দনসিং ও বিমলবাবু ছিল সুধাময়ের ডান ও বাঁ হাত, অপকর্মের প্রধান সঙ্গী বা সহায়ক। বিমলবাবু ও চন্দনসিং সুধাময়বাবুকে সকল সংবাদ সরবরাহ করত ও খনিটা ভৌতিক এই কিংবদন্তীকে আরও সুদৃঢ় করবার জন্য প্রোপাগাণ্ডা চালাত দিবারাত্র নানা ভাবে।
সুধাময়বাবুর রং ছিল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নিজে বহুকাল সাঁওতাল পরগণায় ঘুরে ঘুরে সাঁওতালদের সামাজিক রীতিনীতি আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তাও পুরোপুরি ভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন, এবং যাতে করে তিনি অনায়াসেই সাঁওতাল কুলিদের মধ্যে তাদের একজন সেজে দিব্যি খোসমেজাজে একের পর এক খুন করে চলেছিলেন। অথচ কেউ কোনোদিন সন্দেহ করবার অবকাশ পায়নি।