আচ্ছা দিন, বিমলবাবু বলে, আপনার request, মানে অনুরোধ–
শঙ্কর বিমলবাবুকে এক কাপ চা ঢেলে দিল। চায়ের কাপে বেশ আরাম করে চুমুক দিতে দিতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিমলবাবু শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তা আপনার সে বন্ধুটির নাম কী?
নাম কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়! কোন্ কিরীটী রায়? বর্মার বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্রমর প্রভৃতির যিনি রহস্য ভেদ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের নাম হয়েছে বটে! কবে আসবেন তিনি?
আজই তো আসবার কথা ছিল, কিন্তু এল না তো দেখছি। কাল হয়ত আসবে।
এমন সময় বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
বাস এসে গেছে।
বাস মানে একটা কম্পার্টমেন্ট এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়।
চা-পান শেষ করে দাম চুকিয়ে দিয়ে দুজনে বাসে এসে উঠে বসল।
অল্পক্ষণ বাদেই বাস ছেড়ে দিল।
শীতের অন্ধকার রাত্রি কুয়াশার আবরণের নীচে যেন কুঁকড়ে জমাট বেঁধে আছে।
খোলা জানলাপথে শীতের হিমশীতল হাওয়া হু-হু করে এসে যেন সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়ে যায়। এতগুলো গরম জামাতেও যেন মানতে চায় না। দুজনে পাশাপাশি বসে চুপচাপ।
কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়া হল্টের মাঝামাঝি ওদের গন্তব্য স্থান। কাতরাসগড় স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে যেতে হয় বেশ খানিকটা পথ। রাত্রি প্রায় তিনটের সময় গাড়ি এসে কাতরাসগড় স্টেশনে থামল। অদূরে স্টেশন-ঘর থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। একটা সাঁওতাল কুলি এদের অপেক্ষায় বসে ছিল।
তার মাথায় সুটকেস ও বিছানা চাপিয়ে একটা বেবী পেট্রোমাক্স জ্বালিয়ে ওরা রওনা হয়ে পড়ল।
নিঝুম নিস্তব্ধ কনকনে শীতের রাত্রি।
আগে বিমলবাবু এগিয়ে চলেছে, হাতে তার আলো, চলার তালে তালে দুলছে।
আলোর একঘেয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধ প্রান্তরের মৌনতা ভঙ্গ করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা দমকা হাওয়া হু-হু করে বয়ে যায়।
মাঝখানে শঙ্কর। সবার পিছনে মোটঘাট মাথায় নিয়ে সাঁওতালটা।
একপ্রকার ঝোঁকের মাথায়ই শঙ্কর এই কাজে এগিয়ে এসেছে। চিরদিন বেপরোয়া জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। এ দুনিয়ায় ভয়ডর বলে কোন কিছু, কোন প্রকারে বিপদ-আপদ তাকে পিছনটান দিয়ে ধরে রাখতে পারে নি। সংসারে একমাত্র বুড়ী পিসীমা। আপনার বলতে আর কেউ নেই। কেই বা বাধা দেবে?
বিমলবাবুর মুখ থেকেই শোনে কলিয়ারীর ইতিহাসটা শঙ্কর। বছর-দুই আগে কাতরাসগড় ও তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে পূর্ববঙ্গের এক ধনীপুত্র কলিয়ারী করবার ইচ্ছায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু একমাস যেতে না যেতেই ম্যানেজার রামহরিবাবু একান্ত আশ্চর্যভাবে তাঁর কোয়ার্টারে এক রাত্রে নিহত হন। দ্বিতীয় ম্যানেজার বিনয়বাবু কিছুদিন বাদে কাজে বহাল হন। দিন পনের যেতে না যেতে তিনিও নিহত হন। তারপর এলেন সুশান্তবাবু, তাঁরও ঐ একই ভাবে মৃত্যু ঘটল। পুলিস ও অন্যান্য সবাই শত চেষ্টাতেও কে বা কারা। যে এঁদের এমন করে খুন করে গেছে তার সন্ধান করতে পারলে না। তিন-তিনবারই একটি কুলি বা কর্মচারী নিহত হয়নি, তিনবারই ম্যানেজার নিহত হল। মৃত্যুও ভয়ঙ্কর। কে যেন ভীষণভাবে গলা টিপে হতভাগ্য ম্যানেজারদের মৃত্যু ঘটিয়েছে, গলার দুপাশে দুটি মোটা দাগ এবং গলার পিছনের দিকে চারটি কালো গোল ছিদ্র।
শঙ্কর যেখানে কাজ করছিল সেখানকার বড়বাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনে একান্তকৌতূহলবশেই নিজে অ্যাপ্লিকেশন করে কাজটা সে নিয়েছে চারমাসের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে।
এখানে রওনা হবার আগের দিন কিরীটীকে একটা চিঠিতে আগাগোড়া সকল ব্যাপার জানিয়ে আসবার জন্য লিখে দিয়ে এসেছে।
কিন্তু এই নিষুতি রাতে নির্জন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়, কে জানে এমনি করে নিশ্চিত মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাল করল কি মন্দ করল!
অদূরে একটা কুকুর নৈশ স্তব্ধতাকে সজাগ করে ডেকে উঠল।
ওরা এগিয়ে চলে।
০২. ভয়ঙ্কর চারটি কালো ছিদ্র
শঙ্কর সেন কিরীটীর কলেজের বন্ধু, একই কলেজ থেকে ওরা বি.এস্-সি. পাস করেছিল।
রসায়নে এম. এস্-সি পাস করে শঙ্কর মামার বন্ধুর কলিয়ারীতে কাজ নিয়ে চলে যায়। সেও দীর্ঘ পাঁচ বছরের কথা। কিরীটী তার আগেই রহস্যভেদের জালে পাক খেতে খেতে এগিয়ে গেছে অনেকটা। বছর-দুই আগে কলকাতায় দুজনের একবার ইস্টারের ছুটিতে দেখা হয়েছিল।
তারপর কেউ কারও সংবাদ পায়নি। হঠাৎ শঙ্করের চিঠি পেয়ে কিরীটী বেশ খুশীই হল।
জংলীকে ডেকে সব গোছগাছ করতে বলে দিল।
পরের দিন তুফান মেলে যাবে সব ঠিক, এমন সময় সুব্রত এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল।
একতলার ঘরে জংলীকে সব গোছগাছ করতে দেখে প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কি জংলী?
বাবু কাতরাসগড় চলেছেন।
হঠাৎ?
কী জানি বাবু! আপনাদের কয় বন্ধুর কি মাথার ঠিক আছে? বর্মা, লঙ্কা, হিল্লী-দিল্লীতে আপনারা লাফালাফি করতেই আছেন।
সুব্রত হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানছিল। সুব্রতর পায়ের শব্দে মুদ্রিত চোখেই বললে:
কিবা প্রয়োজনে
এ অকিঞ্চনে
করিলে স্মরণ?
সুব্রত হাসতে হাসতে জবাব দিল :
আসি নাই সন্ধি হেতু,
ফাটাফাটি রক্তারক্তি
খুনোখুনি,
যাহা হয় কিছু!
পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি;
জংলীরে সাথে লয়ে
কোথায় চলেছ;
দিয়ে অভাগা আমারে ফাঁকি?