সুব্রত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কে তুই? বল শীগগির, কে তুই?
সহসা একটা উচ্চরোলের হাসির প্রচণ্ড উচ্ছাসে সমগ্র ঘরখানি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
পাগলটা হাসছে।
সকলেই স্তম্ভিত, বাক্যহারা।
হঠাৎ পাগলটা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় ডাকল, সুব্রত!
সুব্রত চমকে উঠল।
কে?
ভয় নেই, আমি কিরীটী।
অ্যাঁ! কিরীটী, তুই! একি বিস্ময়!
সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও বলে উঠল, কিরীটী তুই!
হ্যাঁ। কেন, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি শ্রীহীন কিরীটী রায়!
কিন্তু ব্যাপার কী? মাটিতে পড়ে লোকটা কে?
সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
বিমলবাবুর মৃতদেহ।
কার? কার মৃতদেহ? অস্ফুট কণ্ঠে সুব্রত চিৎকার করে উঠল।
কলিয়ারীর সরকার বিমলবাবু। যাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য তোমাদের আজকের রাত্রের এই দুঃসাহসিক অভিযান বন্ধু! চল বন্ধু, এবারে বাসায় চল। দারোগাবাবু, আপনার সঙ্গে যে কনেস্টবল দুটি এনেছেন, তাদের এই মৃতদেহের জিম্মায় আজকের রাতের মত রেখে চলুন শঙ্করের বাংলোয় ফেরা যাক। চল সুব্রত, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? গাম ইলাস্টিক দিয়ে একমুখ দাড়ি করে চুলকে চুলকে প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত হবার যোগাড় হল!
কিন্তু—সুব্রত আমতা আমতা করে বললে।
এর মধ্যে আবার কিন্তু কী হে ছোরা! চল, চল্। রাত কত হল তার খবর রেখেছিস? বাড়িতে চল, ধীরেসুস্থে বলব।
তাহলে বিমলবাবু…
সুব্রতর কথা শেষ হল না, কিরীটী বলে উঠল, আজ্ঞে না। You are mistaken, বিমলবাবু খুনী নন।
তবে?
তবে আবার কী? অন্য লোক খুনী।
কে খুনী?
কাল সকালে বলব। এখন চল বাংলোয় ফেরা যাক।
কিন্তু আমার যে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কিরীটী! সুব্রত বললে।
অর্থাৎ তুমি একটি হস্তীমূখ। শোন, কানে কানে একটা কথা বলি।
সুব্রতর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে কিরীটী কি যেন ফিসফিস করে বলতেই সুব্রত লাফিয়ে উঠল, অ্যাঁ, বলিস কি আশ্চর্য, আশ্চর্য!
কিন্তু তার একটি ডান ও একটি বাঁ হাত ছিল যন্ত্রস্বরূপ। কিরীটী বললে, এই হতভাগ্য বিমলবাবু হচ্ছে বাঁ হাত।
সে রাত্রে বাংলোয় ফিরে গরম জল করিয়ে কিরীটী ছদ্মবেশ ছেড়ে স্থির হতে হতে প্রায় রাত্রি আড়াইটে বেজে গেল।
১৫. রহস্যের মীমাংসা
ঝুমনকে ডেকে শঙ্কর কিছু লুচি ও তরকারী করবার জন্য আদেশ দিতেই কিরীটী বাধা দিলে, আরে ক্ষেপেছিস শঙ্কর, এই রাত্রে মিথ্যে কেন ও বেচারীকে কষ্ট দিবি! তার চাইতে বল্ এক কাপ গরম গরম চা বানিয়ে দিক। আর তার সঙ্গে ঘরে যদি কেক বিসকি কিছু থাকে তবে তাই দু-চারটে দে, তাতেই হয়ে যাবে।
ঘরে কেক ছিল। ঝুমন একটা প্লেটে করে কয়েকটা plum cake ও এক কাপ চা এনে কিরীটীর সামনে টিপয়ে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললে, দিই না সাহেব কয়েকটা লুচি ভেজে, কতক্ষণ বা লাগবে!
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, ওরে না না। তুই শুতে হ্যাঁ। এতেই আমার হবে, কাল যদি এখানে থাকি তো বেশ করে পেট ভরে খাওয়াস।
ঝুমন চলে গেল।
কিরীটী জামার পকেট থেকে চুবোট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে মৃদু টান দিতে লাগল।…
কিছুক্ষণ ধূমপান করবার পর প্রায়-ঠাণ্ডা চায়ের কাপটা তুলে নিতে নিতে বললে, cold tea with a Burma cigar, is a joy for ever.
সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল কিরীটীর নিজস্ব কবিতা শুনে।
কিন্তু আমার শরীর যে ঘুমে ভেঙে আসছে শঙ্কর, শীঘ্র কোথায় শুতে দিবি বল? কিরীটী শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
শঙ্কর নিজের ঘরেরই এক পাশে একটা ক্যাম্প খাটে কিরীটীর শোয়ার বন্দোবস্ত করে দিল।
কিরীটী শয্যার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে নিল।
.
পরের দিন সকালে শঙ্কর ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
এমন সময় একজন সাঁওতাল কুলি ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। বাবু, হুজুর মালিক এসেছেন গো–
মালিক? কখন এলেন তিনি?
কাল রাতে বাবু।
কে কাল রাতে এসেছেন শঙ্কর?
চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে কিরীটী।
খনির মালিক সুধাময়বাবু কাল রাত্রে এসেছেন।
যা, তাড়াতাড়ি মনিবের সঙ্গে একবার মোলাকাত করে আয়।
হ্যাঁ, যাই।
হাত মুখ ধুয়ে শঙ্কর তখুনি মনিবের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল।
খনির অল্প দূরে মাঠের মধ্যে একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। খনির দুজন অংশীদার হনুমানপ্রসাদ ঝুনঝুনওয়ালা আর সুধাময় চৌধুরী। অংশীদারের মধ্যে কেউ কখনো এলে ঐ বাংলো বাড়িতেই ওঠেন। অন্য সময় বাংলো তালা-চাবি দেওয়াই থাকে।
শঙ্কর যখন এসে বাংলো বাড়িতে প্রবেশ করল, সুধাময়বাবু তখন ঘুম ভেঙে উঠে বসে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে গরম গরম লুচির সদ্ব্যবহার করছেন।
ভৃত্যকে দিয়ে সংবাদ পাঠাতেই শঙ্করের ভিতরে ডাক এল। বহুমূল্য আসবাবপত্রে সাজানো কখানি গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
একটা বেতের চেয়ারে বসে সুধাময়বাবু প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন।
শঙ্কর ঘরে ঢুকে হাত তুলে নমস্কার জানাল, নমস্কার স্যার।
নমস্কার। বসুন। আপনিই এখানকার নতুন ম্যানেজার শঙ্কর সেন?
আজ্ঞে।
বেশ, বেশ।
শঙ্কর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
ওরে কে আছিস, ম্যানেজারবাবুকে চা দিয়ে হ্যাঁ। সুধাময়বাবু হাঁক দিলেন।
না, না। ব্যস্ত হবেন না। এই মাত্র বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরুচ্ছি।
তাতে আর কী Add a cup more, কোনো harm নেই।
শঙ্কর সুধাময়বাবুর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।
উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা। মাথার মাঝখানে সিঁথি। চোখা নাক। চোখ দুটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ লালচে। শিকারী বিড়ালের মত সদাচঞ্চল, অস্থির ও সজাগ। গায়ের রং আলুশ কাঠের মত কালো। ভদ্র বেশ না হলেও সাঁওতালদেরই একজন বলে ধরা যেতে পারে অনায়াসেই। গায়ে বাদামী রংয়ের দামী সার্জের গরম সুট।