আমার কথায় এবার বিশ্বাস হয়েছে তো স্যার পুরোপুরি? সুব্রত দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।
এখনও আর না বিশ্বাস করে কেউ পারে নাকি সুব্রতবাবু? বললে শঙ্কর। কিন্তু আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না সুব্রতবাবু।
বুদ্ধির কিছু নয়—common sense,শঙ্করবাবু; বুদ্ধি যদি বলেন সে আমার বন্ধু ও শিক্ষাগুরু কিরীটী রায়ের আছে, সুব্রত বললে। শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় যেন রুদ্ধ হয়ে এল।
কিন্তু কেমন করে বুঝলেন বলুন তো সুব্রতবাবু যে লাশ এখানে লুকনো আছে?
বললাম তো common sense! এই গাছটা লক্ষ্য করে দেখুন। গাছের পাতাগুলো যেন নেতিয়ে গেছে। এটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকিটা আমার অনুমান-চারদিকে চেয়ে দেখুন, চারাগাছ আরও দেখতে পাবেন, কিন্তু কোনো গাছেরই পাতা এমন নেতানো নয়। প্রথমেই আমার মনে হল, ঐ গাছের পাতাগুলো অমন নেতিয়ে গেছে কেন? তখনি গাছটার পাশে ভাল করে চাইতেই মাটির দিকে নজর পড়ল। একটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেই বোঝা যায় পাশের মাটিগুলো যেন কেমন আলগা। মনে হয় কে যেন চারপাশের মাটি খুঁড়ে আবার ঠিক করে রেখেছে। যেই এ কাজ করে থাকুক না কেন, লোকটার যথেষ্ট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আছে বলতেই হবে। মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ পুঁতে এই গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে যাতে করে কারও নজরে না পড়ে এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিন্তু গাছটি অন্য জায়গা থেকে উপড়ে আনার ফলে এক রাত্রেই নেতিয়ে উঠেছে। আরও ভেবে দেখুন এক রাত্রের মধ্যে যেখানে গাড়ি মোটর বা ট্রেনের তেমন কোনো ভাল বন্দোবস্ত নেই সেখানে একটা লাশকে সরিয়ে ফেলা কত কণ্ঠসাধ্য! তাছাড়া একটা মৃতদেহ অন্য জায়গায় সরানোও বিপদসঙ্কুল ব্যাপার। একে তো সকলের নজর এড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, তার ওপর ধরা পড়বার খুবই সম্ভাবনা। অথচ মৃতদেহটা এভাবে ফেলে রাখাও চলে না—তাই সরানোই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ এবং আশেপাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে পারলে সব দিকই রক্ষা হয় এবং ব্যাপারটাও সহজ সাধ্যকর হয়ে যায়।
যা হোক, সকলেই তখন লাশের একটা বন্দোবস্ত করে বাংলোর দিকে ফিরল। কারও মুখেই কোনো কথা নেই। সকলে নির্বকভাবে পথ অতিক্রম করছে।
সকলে এসে বাংলোয় প্রবেশ করল।
বিমলবাবু বাংলো পর্যন্ত আসেননি, খনির দিকে চলে গেছেন মাঝপথ থেকে বিদায় নিয়ে।
বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার পাতা ছিল। তিনজনে তিনটে চেয়ার টেনে বসল। দারোগাবাবুই প্রথমে কথা বললেন, সুব্রতবাবু, ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলো পড়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, কাল রাত্রেই পড়ে ফেলেছি।
কি বুঝলেন?
সামান্যই। তার থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া চলে না। আচ্ছা দারোগা সাহেব, এই case-গুলোর chemical examination-এর report-গুলো আপনার কাছে আছে নাকি?
না। তবে বলেন তো চেষ্টা করে আনিয়ে দিতে পারি কোয়ার্টার থেকে; দরকার আছে নাকি?
হ্যাঁ পেলে ভাল হত। একটা কাজ করতে পারবেন দারোগাসাহেব?
বলুন।
একটু অপেক্ষা করুন। সুব্রত ঘরের মধ্যে চলে গেল এবং পরক্ষণেইকাগজে মোড়া গতরাত্রের সেই তীরটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
ব্যাপার কী? ওটা কি আপনার হাতে? দারোগাবাবু সুব্রতর হাতের কাগজে মোড়া তীরটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন।
কাগজের মোড়কটা খুলতে খুলতে সুব্রত বললে, এটা একটা তীর। এর ফলায় আমার মনে হয় কোনো মারাত্মক রকমের বিষ মাখানো আছে, দয়া করে এটা ধানবাদের কোনো কেমিস্টের কাছ থেকে একটু এগজামিন করে কী বিষ আছে জেনে আমায় জানাতে পারেন?
চেষ্টা করতে পারি, তবে কতদূর সফল হব, বলতে পারি না। তার চেয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিই না কেন! এক হপ্তার মধ্যেই chemical examiner-এর report পেয়ে যাবেন।
দেখুন যদি ধানবাদে সুবিধা না হয়, তবে কলকাতায়ই পাঠাবেন।
তখনকার মত চা ও জলখাবার খেয়ে দারোগাবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
শঙ্কর খাদের দিকে রওনা হল।
সুব্রত চেয়ারটার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল।
১৪. রাত্রি যখন গভীর হয়
প্রতি রাতের মত আজও রাত্রির অন্ধকার ধূসর কুয়াশার ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে শ্রান্ত ক্লান্ত ধরণীর বুকে নেমে এল। পাখির দল কুলায় গেল ফিরে। সারাদিন খনিতে খেটে ক্লান্ত সাঁওতাল কুলিকামিনরা যে যার ধাওড়ায় ফিরে এসেছে। সুব্রত চুপটি করে বারান্দায় একটা বেতের ডেকচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
কাল হয়ত কিরীটীর চিঠি পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের রাতটা?
এ কি নির্বিঘ্নে কাটবে?
রাতের অন্ধকারে কি আজ আর বিভীষিকাময় মৃত্যুর কঠিন হিমপরশ কোনো হতভাগ্যের ওপরে নেমে আসবে না?
দূর থেকে সাঁওতালী বাঁশি ও মাদলের সুর ভেসে আসে।
জীবনের কোনো মূল্যই ওদের কাছে নেই। প্রকৃতির স্নেহের দুলাল ওরা। মাটির ঘরে অযত্নে বর্ধিত মাটি-মাখা সহজ ও সরল শিশুর দল। প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনের পাত্র ওদের কানায় কানায় পূর্ণ।
শঙ্কর এখনও খাদ থেকে ফেরেনি।
ঝুমন গরম চা, কেক ও ফল প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেল।
সুব্রত একটুকরো কেক মুখে পুরে চায়ের কাপটা তুলে নিল। বাইরে আজ ঠাণ্ডাটা যেন একটু চেপেই এসেছে।