তবে বোধ হয় ব্যাটা মরে ভূত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সুব্রতবাবু। হাসতে হাসতে দারোগাবাবু বললেন।
দেখুন দারোগাবাবু, নেশা-ভাঙের অভ্যাস আমার জীবনে নেই, তাছাড়া চোখের দৃষ্টি এখনও আমার খুবই প্রখর ও সজাগ।
কিন্তু লাশটা তাহলে কোথায়ই বা যাবে বলুন? কথাটা বললেন বিমলবাবু।
কোথায় যাবে তা কী করে বলব! পাওয়া যখন যাচ্ছে না তখন নিশ্চয়ই কেউ রাতারাতি লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু ওই শালবনে অত রাত্রে যে একটা লোক খুন হয়েছে, সে-কথা লোকে জানাই বা কেমন করে যে সরিয়ে নেবে রাতারাতি? দারোগাবাবু বললেন।
এবার সুব্রত আর না হেসে থাকতে পারলে না। হাসতে হাসতে বললে, তা যা বলেছেন। তবে যে খুনী সে তো জানতই লোকটা মারা গেছে, বিশেষ করে বন্দুকের গুলি খেয়ে যে বাঁচা চলে না এবং সে গুলি যখন পাঁজরা ভেদ করে গেছে।
তবে কি আপনি বলতে চান সুব্রতবাবু, খুনীই লাশ সরিয়েছে?
বলতে আমি কিছুই চাই না। লাশ কেউ সরিয়েছে বা সরায়নি এ সম্পর্কে কোনো তর্কাতর্কি করারই আমার ইচ্ছা নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্তে ইচ্ছা উপনীত হতে পারেন এবং যেমন খুশি further proceed করতে পারেন। তবে এটা ঠিকই জানবেন,কাল একজন কুলি শালবনে বন্দুকের গুলিতে খুন হয়েছিল।
আপনার কথাই যদি ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ খুনীই লাশ সরিয়ে থাকে, তবে কোথায় সরালে? দারোগাবাবু সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
কেমন করে বলব বলুন! আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তো আর লাশ সরায়নি!
তাও তো ঠিক, তাও তো ঠিক। দারোগাবাবু মাথা দোলাতে লাগলেন পরম বিজ্ঞের মত।
১৩. মৃতদেহ
দারোগাবাবুরও যেন অতঃপর কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, চলুন না সুব্রতবাবুআমার সঙ্গে একটিবারসেইশালবনে; কোথায় আপনি মৃতদেহ দেখে এসেছিলেন, exact location-টা দেখাবেন।
নিশ্চয়ই, চলুন।
সকলে নদী পার হয়ে শালবনের দিকে এগিয়ে চলল।
.
প্রভাতের সোনালী রোদ শালবনের গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত উঁকি দিচ্ছে।
শীতের প্রভাতের ঝিরঝিরে হাওয়া শালবনের গাছে সবুজ কচি পাতাগুলিকে মৃদু মৃদু শিহরণ দিয়ে বয়ে যায়।
সকলে এসে শালবনের মধ্যে প্রবেশ করল।
কোথায় দেখেছিলেন কাল রাত্রে সেই মৃতদেহ সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু প্রশ্ন করলেন।
ওই শালবনের দক্ষিণদিকে।
গতরাত্রের সেই জায়গায় সকলে সুব্রতর নির্দেশমত এসে দাঁড়াল।
আশেপাশে কয়েকটা বড় বড় শালগাছ ছোট একটা জায়গাকে যেন আরও ছায়াচ্ছন্ন ও নির্জনতর করে ঘিরে রেখেছে।
এই সেই জায়গা দারোগাবাবু, সুব্রত বললে।
সেই জায়গার মাটিতে তখনও রক্তের দাগ জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে দেখা গেল।
সুব্রত সেই জমাটবাঁধা রক্তের দাগগুলোর দিকে আঙুল তুলে বলল, এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমি যে গত রাত্রে স্বপ্ন দেখিনি বা আমার চোখের দৃষ্টিভ্রম ঘটেনি তার প্রমাণ। এই মাটির বুকে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে।
সকলে তখন এক এক করে রক্তের দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখল এবং সুব্রতর কথা যে মিথ্যা নয় এরপর সেটাই সকলে মেনে নিতে বাধ্য হল।
তাই তো স্যার, এ যে তাজ্জব ব্যাপার! দারোগাবাবু বলতে লাগলেন, কিন্তু মৃতদেহটা তবে কোথায় গেল?
সুব্রত তখন চারিদিকে ইতস্তত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে চেয়ে কি যেন দেখছিল, দারোগাবাবুর কথার কোনো জবাবই দিল না।
এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে দেখতে সহসা একসময় সুব্রতর চোখের দৃষ্টিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সহসা সে চিৎকার করে বলে উঠল, ইউরেকা! ইউরেকা! সম্ভবত আপনার লাশ পাওয়া গেছে দারোগা সাহেব। কিন্তু একটা শাবলের যে দরকার।
সুব্রতর উৎফুল্ল চিৎকারে সকলেই সুব্রতর দিকে ফিরে তাকাল।
ব্যাপার কী সুব্রতবাবু? শঙ্কর বললে।
লাশ পাওয়া গেছে শঙ্করবাবু। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
লাশ পাওয়া গেছে? আপনার মাথা খারাপ হল নাকি সুব্রতবাবু? দারোগাবাবু বললেন।
দয়া করে একটা শাবল আনিয়ে দিন। আমি এখনই প্রমাণ করে দিচ্ছি।
তখনি বিমলবাবুকে খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল একটা শাবল নিয়ে আসবার জন্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমলবাবু ছোট একটা মাটি-খখাঁড়া শাবল নিয়ে ফিরে এলেন।
এই নিন স্যার শাবল।
সুব্রত বিমলবাবুর হাত থেকে শাবলটা নিয়ে একটা বড় শালগাছের গোড়া থেকে একটা ছোট শালগাছের চারা এক টান দিয়ে অনায়াসেই শিকড়সুদ্ধ তুলে ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশী মাটি খুঁড়তে হল না, খানিকটা মাটি উঠে আসবার পরই একটা মানুষের হাত দেখা গেল।
এই দেখুন দারোগা সাহেব, আমার কথা ঠিক কিনা! এই দেখুন লাশ। সুব্রতর সমগ্র শরীর ও কণ্ঠস্বর প্রবল একটা উত্তেজনায় যেন কাঁপছে।
তারপর অল্প আয়াসেই মাটি থেকে মৃতদেহ খুঁড়ে বের করা হল। মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, সুব্রত যা বলেছিল ঠিক তাই। মৃতদেহের পাঁজারায় গুলির ক্ষতও রয়েছে।
দারোগাবাবু এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি, যেন বোকা বনে গেছেন। এমন ব্যাপার যে একটা ঘটতে পারে এ যেন ইতিপূর্বে তাঁর ধারণার অতীত ছিল। তিনি একজন দারোগা। এক-আধ বছর নয়, প্রায় দীর্ঘ এগার বছর এই লাইনে চুল পাকাচ্ছেন অথচ এই সামান্য সম্ভাবনাটা তাঁর মাথায় খেলেনি! খেলল কিনা সামান্য একজন শখের গোয়েন্দার সহচরের মাথায়!
দারোগাবাবু একটু গম্ভীরই হয়ে গেলেন।