রক্ত! তাজা রক্তের ফোঁটা!
তাহলে সত্যিই ভূত নয়, দৈত্য দানব বা পিশাচ নয়! সামান্য রক্তমাংসের দেহধারী মানুষ। কিন্তু জখম হয়নি। সামান্য আঘাত লেগেছে মাত্র। কিন্তু পালাবে কোথায়?
এই যে মাটির ওপরে রক্তের ফোঁটা ফেলে গেল এইটাই তার নিশানা দেবে যেখানে যতদূর পালাক না কেন, হাওয়ায় উবে যেতে পারবে না।
একদিন না একদিন ধরা দিতেই হবে। কেননা আঘাত যত সমান্য হোক না কেন, আহত হয়েছে এ অবধারিত এবং সেইজন্যই বেশী দূর পালানো সম্ভব হবে না।
কিন্তু শার্দুলের ডাক! ব্যাপারটা কী? অবিকল শার্দুলের ডাক! সহসা সোঁ-সোঁ করে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ সুব্রতর কানের পাশ দিয়ে যেন বিদ্যুতের মত চকিতে মিলিয়ে গেল।
সুব্রত চমকে উঠে একলাফে সরে দাঁড়াল। এবং সরে দাঁড়াতে গিয়েই পাশে অদূরে মাটি দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট তীরের ফলা অর্ধেক মাটির বুকে প্রোথিত হয়ে থিরথির করে কাঁপছে।
সুব্রত নীচু হয়ে হাত দিয়ে তীরটা ধরে এক টান দিয়ে মাটির বুক থেকে তুলে নিল।
তীরের তীক্ষ্ণ চেপ্টা অগ্রভাগে মাটি জড়িয়ে গেছে। এতক্ষণে সুব্রত বুঝতে পারলে, একটু আগে শালবনের মধ্যে অতর্কিতে যে শব্দ শুনেছিল সেও একটা তীর ছোটারই শব্দ এবংসেই তীরটাও তাকে মারবার জন্যই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বুঝতে আর কষ্ট হয় না।
শত্রুপক্ষ তাহলে সুব্রতর ওপরে বিশেষ নজর রেখেছে এবং তাকে মারবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে! তীরটা হাতে নিয়ে সুব্রত সটান বাংলোর দিকে পা চালিয়ে দিল।
সুব্রত এসে বাংলোয় যখন প্রবেশ করল, শঙ্কর তখন ঘরে টেবিলের ওপরে একরাশ কাগজপত্র ছড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন দেখছে।
শঙ্করবাবু! সুব্রত ঘরের মধ্যে পা দিয়ে ডাকল।
কে? ও, সুব্রতবাবু! এত রাত করে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম ঐ নদীর দিকটায়।
সামনেই একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়ে সুব্রত পা দুটো টান করতে করতে বললে।
এতক্ষণ এই অন্ধকারে সেখানেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
কথাটা বলে সুব্রত হাতের তীরটা টেবিল-ল্যাম্পের অত্যুজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে তুলে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।
সুব্রতর হাতে তীরটা দেখে শঙ্কর সবিস্ময়ে বললে, ওটা আবার কী? কোথায় পেলেন?
সুব্রত তীরটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে করতেই মৃদু স্বরে জবাব দিল, মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে।
মাঠের মধ্যে কুড়িয়ে তীর পেলেন! তার মানে?
শঙ্কর বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করল।
মানে আবার কী? কেন, মাঠের মধ্যে একটা তীর কুড়িয়ে পেতে নেই নাকি?
শঙ্কর এবারে হেসে ফেললে, তা তো আমি বলছি না, আসল ব্যাপারটা কী তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার কী মনে হয় জানেন? সুব্রত বললে শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ।
কী?
এই তীরের ফলায় নিশ্চয়ই কোনো তীব্র বিষ মাখানো আছে এবং সে বিষ সাধারণ কোনো সুস্থ মানুষের শরীরের রক্তে প্রবেশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু অবধারিত।
কি বলছেন সুব্রতবাবু?
শঙ্কর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
মনে হওয়ার কারণ আছে শঙ্করবাবু। সুব্রত গম্ভীর স্বরে বললে।
বুঝতে পারছি না ঠিক আপনার কথা সুব্রতবাবু!
কোনো এক হতভাগ্যের উদ্দেশ্যে এই বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করে তার জীবনের ওপরে attempt করা হয়েছিল।
সর্বনাশ! বলেন কী?
হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে, অর্থাৎ বিস্তারিত ভাবে আপনাকে সব কিছু বলবার আগে এক কাপ চা। দীর্ঘ পথ হেঁটে গলাটা শুকিয়ে গেছে।
O Surely! এখুনি। বলতে বলতে শঙ্কর সামনের টেবিলের ওপরে রক্ষিত কলিং বেল টিপল।
ভৃত্য এসে খোলা দরজার ওপরে দাঁড়াল।—সাহেব আমাকে ডাকছেন?
এই, শীগগির সুব্রতবাবুকে এক কাপ গরম চা এনে দে!
আনছি সাহেব। ভৃত্য চলে গেল।
ভৃত্যকে চায়ের আদেশ দিয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে শঙ্কর দেখলে, চেয়ারের ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সুব্রত গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে।
১১. ময়না তদন্তের রিপোর্ট
টেবিলের ওপর সুব্রতর আনীত তীরটা পড়েছিল। শঙ্কর সেটা টেবিলের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে লাগল।
তীরটা ছুঁড়ে কোনো এক হতভাগ্যের life-এর ওপর নাকি attempt করা হয়েছিল? কে attempt করল? কার life-এর ওপরেই বা attempt করল? কেনই বা attempt করল? আশ্চর্য!
সহসা একসময় সুব্রত চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে শঙ্করের হাতে তীরটা দেখতে পেয়ে চমকে বলে উঠল, আরে সর্বনাশ! করছেন কী? তারপর কী একটা বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন! রাখুন রাখুন, তীরটা রেখে দিন। কে জানে কী ভয়ঙ্কর বিষ তীরের ফলায় মাখানো আছে!
শঙ্কর একপ্রকার থতমত খেয়ে তীরটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখল।
এমন সময় ভৃত্য গরম চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে কাপটা টেবিলের ওপরে সুব্রতর সামনে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। সুব্রত ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিল।
আঃ! একটা আরামের নিঃশ্বাস ছেড়ে সুব্রত শঙ্করের মুখের দিকে তাকাল। ওই যে তীরটা দেখছেন শঙ্করবাবু, একটু আগে কোনো এক অদৃশ্য আততায়ী ওটা ছুঁড়ে আমাকে ভবপারাবারে পাঠাতে চেয়েছিল!
বলেন কি? শঙ্কর চমকে উঠল।
আর বলি কি! খুব বরাত, এযাত্রা বেঁচে যাওয়া গেছে। শুধু একবার নয়, দুবার তীর ছুঁড়ে আমার জীবনসংশয় ঘটানোর সাধু প্রচেষ্টা করেছিল।