টর্চ! এটা বোধ হয় অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এইসব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধসাতে? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু ধসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে, তবে এগুলো সেখানে ফেলে এল কেন? তবে কি ধসায়নি? না। ধসিয়ে চলে এসেছিল? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, আরও ডিনামাইট আরও পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেতে এটার আর কোন দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে। কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢোকবার তো মাত্র একটিই পথ! চানকের সাহায্যে? চানকের চাবি কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রী বললে তার কাছেই থাকে। চাবিটা এমন কোন মূল্যবান চাবি নয়; টাকাকড়ির সিন্দুকের চাবি নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবি নয়, সামান্য চানকের চাবি। চাবিটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয় এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবিটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়—মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি—সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু রুমালটা! রুমালটা কার? সুব্রত রুমালখানি সোজা দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুত্থানুরূপে পরীক্ষা করতে লাগল।
রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংক্লথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালের একধারে ছোট অক্ষরে লাল সুতোয় লেখা ইংরাজী অক্ষর S. c.
এক কোণে ধোপর চিহু রয়েছে…।
সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জট পাকাতে লাগল। কার রুমাল! কার রুমাল! S.C. নামের initial যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শঙ্কর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশী, শচীন, কিংবা শৈলেশ, কিংবা সনং, সুকুমার, সমীর, সুধাময়! কে, কে? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, অন্য কারও রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল! তবে?
সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক আসতেই হবে। সে আসবে! আসবে!
অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।
সুব্রত চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে। বাইরে গোলমাল শোনা গেল।
পুলিসের লোক এসে গেছে অদূরবর্তী কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।
চঞ্চল পদে পুঁটলিয়া আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দি নিয়ে, ধাওড়ার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাশগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শঙ্করবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।
সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল, এখানে ইতিপূর্বে যেসব ম্যনেজার খুন হয়েছেন তাঁদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলি সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান তবে তার বড় উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, এ-কথা বলতে! আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হয়ে কত যে সুখী হলাম! কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।
সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিসের লোক হয়েও যে আপনি এতখানি উদার, সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। কিরীটী যদি এখানে আসে তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাব। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা নমস্কার।
০৯. আঁধার রাতের পাগল
সুব্রত শঙ্করবাবুর সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে অলক্ষ্যে চানকের ওপরে দুজন সাঁওতালকে সর্বক্ষণ পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করল।
বিকেলের দিকে সুধাময়বাবুর সেক্রেটারী কলকাতা থেকে তার করে জবাব দিলেন: কর্তা বর্তমানে কলকাতায় নেই। তিনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন। কর্তা কলকাতায় ফিরে এলেই তাঁকে সংবাদ দেওয়া হবে। তবে কতার হুকুম আছে, কোন কারণেই যেন, যত গুরুতরই হোক, খনির কাজ না বন্ধ রাখা হয়।
রাতে শঙ্কর সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল, কী করা যায় বলুন, সুব্রতবাবু? কাল থেকে তাহলে আবার খনির কাজ শুরু করে দিই?
হ্যাঁ, দিন। দু-চারদিনের মধ্যে আমার তো মনে হয় আর খুনটুন হবে না।
শঙ্কর হাসতে হাসতে বললে, আপনি শুনতে পারেন নাকি সুব্রতবাবু?
না, গুনতে-ফুনতে জানি না মশাই। তবে চারদিককার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি মাত্র। বলতে পারেন স্রেফ অনুমান।
যাহোক, শঙ্কর খনির কাজ আবার পরদিন থেকে শুরু করাই ঠিক করলে এবং বিমলবাবুকে ডেকে যাতে আগামীকাল ঠিক সময় থেকেই নিত্যকার মত খনির কাজ শুরু হয় সেই আদেশ দিয়ে দিল।
বিমলবাবু কাঁচুমাচু ভাবে বললে, আবার ঐ ভূতপ্রেতগুলোকে চটাবেন স্যার! আমি আপনার most obedient servent, যা order দেবেন—with life তাই করব। তবে আমার মতে এ খনির কাজ চিরদিনের মত একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু ভাল ছিল স্যার।
ভূতপ্রেতের ব্যাপার! কখন কি ঘটে যায়!
শঙ্কর হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ভূতেরও ওঝা আছে বিমলবাবু। অতএব মা ভৈষী। এখন যান, সব ব্যবস্থা করুন গে, যাতে কাল থেকে আবার কাজ শুরু হতে পারে।