- বইয়ের নামঃ রহস্যভেদী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
রহস্যভেদী – ০১
কিরীটী তখন পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। প্রাচুর্য থাকলেও বিলাসিতাকে কোন দিনই প্রশ্রয় দেয়নি। শিয়ালদহের এই অন্ধকার গলিতে অখ্যাতনামা এক ছাত্রাবাস ‘বাণীভবন’–মাসিক সাত টাকা খাওয়া-থাকা দিয়ে তারই তেতলার এক অন্ধকার খুপরির মধ্যে থাকত।
কলেজের বন্ধুর মধ্যে একজনই ছিল তার বিশেষ অন্তরঙ্গ–সলিল সরকার। সলিল সরকারের বাবা মধুসূদন সরকার ছিলেন কলকাতার একজন বিখ্যাত ধনী। পাট ও ধানচালের কারবার লক্ষ লক্ষ টাকা খাটত। সলিল তাঁর একমাত্র পুত্র। অত বড় অর্থশালী পিতার পুত্র হয়েও সলিলের মনে এতটুকুও অহঙ্কার ছিল না। বাড়িতে চার-পাঁচখানা গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সে ট্রামে-বাসে ছাড়া কোনদিনও কলেজে আসেনি।
সেদিন রবিবার, কিরীটী সারাদিন কোথাও বের হয়নি।
শীতকাল। এর মধ্যেই কুয়াশার তমিস্রা কলিকাতা মহানগরীর বুকে ঘন হয়ে এসেছে। ঘরের মধ্যেও অন্ধকার চাপ বেঁধে উঠেছে একটু একটু করে। সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।
আগন্তুক দরজার কাছে আসতেই কিরীটী আহ্বান জানাল, এস সলিল, কি খবর?
আলো জ্বালাসনি এখনও?
না, কুঁড়েমিতে ধরেছে, বোস্। তারপর, আর তো আসবার কথা ছিল না সলিল!
মনটা ভালো নেই–তাই ভাবলাম তোর কাছে একটু ঘুরে যাই।
কি হয়েছে রে?
আশ্চর্য ঘটনা! বাবার ঘরের সিন্দুকের মধ্যে একটা দলিল ছিল। কয়েকদিন ধরে হাইকোর্টে একটা মামলা চলছে। দলিলটা সেই মামলা সংক্রান্ত। পরশুও বাবা সন্ধ্যার দিকে দলিলটা সিন্দুকেই দেখেছেন। আজ সকালবেলা সিন্দুক খুলে দলিলটা উকিলকে দিতে গিয়ে বাবা দেখেন, দলিলটা নেই! সিন্দুকের টাকাকড়ি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু সবই ঠিক আছে, কেবল দলিলটা নেই সিন্দুকে।
সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে?
বাবার কোমরেই সর্বদা থাকে। চাবির বিষয়ে বাবা বিশেষ সাবধান চিরদিনই।
ভৃত্য এসে ঘরে হ্যারিকেন বাতিটা জ্বালিয়ে দিল।
দু কাল চা দিয়ে যেন নন্দু। কিরীটী বললে। নন্দু চলে গেল।
হঠাৎ একসময় কিরীটী প্রশ্ন করে সলিলকে, তোর বাবার ঠিক মনে আছে, গত পরশু সন্ধ্যায় দলিলটা সিন্দুকেই তিনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ, তাই তো বাবা বললেন।
এ ব্যাপারে কাউরে তিনি সন্দেহ করেন বলে জানিস কিছু?
বাড়ির লোকজনের মধ্যে বাবা, আমার এক কাকা, আমার তিনটে বোন, মা, পিসিমা, ম্যানেজার বনবিহারীবাবু, আর চাকরবাকর।
চাকরবাকরগুলো নিশ্চয়ই সবাই বিশ্বাসী?
হ্যাঁ। সকলেই অনেকদিন ধরে আমাদের কাজ করছে।
মামলাটা কার সঙ্গে হচ্ছে?
মামলাটার একটু ইতিহাস আছে কিরীটী।–মৃদু স্বরে সলিল বলে।
ইতিহাস! সবিস্ময়ে কিরীটী বন্ধুর মুখের দিকে তাকায়।
এমন সময় নন্দু দু হাতে দু কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটী বলল, নন্দু, ঠাকুরকে বলে দিস সলিলবাবু আজ এখানেই খাবেন।
যে আজ্ঞে–নন্দু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চায়ের কাপ দুটো রেখে চলে গেল।
সলিল বলতে লাগল, সে আজ প্রায় ২৪/২৫ বছর আগেকার কথা। আমি তখন বোধ হয় সবে হয়েছি। চব্বিশ-পরগণার সোনারপুরে একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যায়। বাগানবাড়িটা ছিল রাজা ত্রিদিবেশ্বর রায়ের। এককালে রাজা ত্রিদিবেশ্বর রায়ের অবস্থা খুবই ভাল ছিল। রাজা ত্রিদিবেশ্বর ছিলেন যেমন শিক্ষিত উদারচেতা, তেমনি প্রচণ্ড খেয়ালী। ব্যবসার দিকে তাঁর একটা প্রবল ঝোঁক ছিল। ত্রিদিবেশ্বরের পিতামহ যজ্ঞেশ্বর রায় তাঁর নিচের চেষ্টায় ও অধ্যবসায়ে ব্যবসা করে মস্ত জমিদারি গড়ে তোলেন এবং গর্ভনমেণ্টের কাছ থেকে রাজা খেতাব পান। যজ্ঞেশ্বরের ছেলে রাজ্যেশ্বর পিতার উপার্জিত জমিদারি বাড়াতে না পারলেও টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার ছেলে ত্রিদিবেশ্বর পিতার মত চুপটি করে পূর্বপুরুষের উপার্জিত অর্থ কেবলমাত্র আঁকড়ে না থেকে সেটা আরো বাড়িয়ে কি করে দ্বিগুন তিনগুন করা যায় সেই চেষ্টায় উঠে-পড়ে লাগলেন। কিন্তু চঞ্চলা লক্ষ্মীর সিংহাসন উঠল টলে। নানা দিক দিয়ে ঘরের অর্থ জলের মত বেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু মদের নেশার মতই ত্রিদিবেশ্বরকে তখন ব্যবসার নেশায় পেয়ে বসেছে। সংসারে তাঁর আপনার বলতে এক স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের অবিশ্যি সংখ্যা কম ছিল না। স্ত্রীর নিষেধ, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সতর্কবাণী কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না। চোদ্দ-পনের বছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারী নিঃশেষে কোথায় মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। অবশেষে দেনার দায়ে একদিন তাঁর শেষ বসতবাটি সোনারপুরের বাগানবাড়িটাও বিক্রি করতে হল। বাবা সাত হাজার টাকায় সেই বাগানবাড়িটা কিনেছিলেন। বাগানবাড়িটা বাবা কতকটা ঝোঁকের মাথায়ই কিনেছিলেন এবং তার কোন সংস্কারও করেননি। হঠাৎ বছরখানে আগে অনিল চৌধুরী নামে একজন ভদ্রলোক বাবার কাছে এসে অনুরোধ জানান, বাগানবাড়িটা তিনি কিনতে চান। বাবাও রাজী হয়ে যান। অনিল চৌধুরী বলেছিলেন, বাগানবাড়িটা কিনে সেখানে তিনি একটা স্কুল স্থাপন করবেন। উদ্দেশ্য খুবই ভালো। লেখাপড়া হবে, সব ঠিকঠাক, এমন সময় হঠাৎ বাবা একটা বেনামী চিঠি পেলেন, চিঠিতে লেখা ছিলঃ