খাওয়া-পরা ছাড়া নগদ ত্রিশটি করে টাকা মাসান্তে বামদেব পাঠিয়ে দিতেন নিয়মিত মনোহরকে।,
প্রকাণ্ড দোমহলা বাড়ি রত্নমঞ্জিল, প্রসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাড়ির সামনে ও পশ্চাতে এখন অবিশ্যি দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সেখানে বিষধরদের সর্পিল আনাগোনায় মধ্যে মধ্যে হঠাৎ কম্পন জাগে?
মনোহরের বয়স চল্লিশের মধ্যে। একা মানুষ, বিয়ে-থা করেনি। কালো কুচকুচে কষ্টিপাথরের মত গাত্রবর্ণ এবং বেঁটে গীটাগোটা চেহারা। প্রথম বয়সে মনোহর এক রাজপুত দারোয়ানের সঙ্গে দোক্তি পাতিয়ে লাঠি খেলা শিক্ষা করেছিল। এখনো তার সে রোগ যায়নি। রত্নমঞ্জিলের পশ্চাৎভাগে খানিকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে নিয়ে পাড়ার কয়েকটি উৎসাহী ছেলেকে যোগাড় করে লাঠি খেলা শেখায় ও কসরৎ করে প্রতিদিন বিকেলের দিকে। নিচের মহালের একটা ঘর পরিষ্কার করে নিয়ে সেখানেই থাকে।
নিজের হাতে দু’বেলা রান্নাবান্না করে আর পাঁচ হাত লম্বা তৈলমসৃণ লাঠিটা রাত্রে শিয়রের কাছে রেখে নিশ্চিন্তে নাক ডাকায়।
সপ্তাহের মধ্যে এক-আধাদিন ওপরের ও নীচের মহলের ঘরগুলি ঝাড়পোছ করে। নিচের মহলের খান দুই ঘর ও ওপরের মহলের দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে তালা দেওয়া। পুরাতন আমলের ভারী লোহার তালা প্রায় সৌর দেড়েক ওজনের হবে। কতকাল যে তালাগুলো খোলা হয় না—জং ধরে আছে। ঐ তিনটি বন্ধ ঘর ছাড়া অন্যান্য ঘরগুলোর তালার চাবি মনোহরের কাছেই থাকে।
গত ষোল-সতের বছর ধরে বামদেব অধিকারী রত্নমঞ্জিলে পা দেননি। মনোহরই এ বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা। মনোহর প্রায় বছর আঠারো-উনিশ হয়ে গেল এ বাড়িতে ‘কেয়ার টেকার’ হয়ে আছে। মনোহরের জানিত কালে বার তিনেকের জন্য মাত্র বামদেব অধিকারী রত্নমঞ্জিলে এসেছিলেন। একবার দুদিন, তার পরের বার আটদিন ও শেষবার দিনচারক থেকে গিয়েছিলেন এবং সে সময়েও ঐ তালাবন্ধ ঘর তিনিটি খোলা হয়নি, কারণ বামদেবের কাছেও ঐ তালার চাবি ছিল না।
বহুকালের পুরাতন বাড়ি। নিচের তলার ঘরের মেঝেতে ফাটল ধরেছে। আচমকা একদিন মনোহর যে ঘরে বাস করত নিচের তলায় তারই মেঝের ফাটলপথে দেখা দেয় এক বিষধর কালকেউটে। সন্ত্রস্ত মনোহর কেউটের বাসা ধ্বংস করতে গিয়ে ঘরের মেঝের খানিকটা খুঁড়ে ফেলে এবং মাটি খুঁড়তে গিয়ে পায় দুটি বাদশাহী মোহর!
সোনার মোহর দুটি মনোহর সযত্নে তার প্যাটরার মধ্যেই রেখে দিয়েছিল, কারণ তার যথার্থ মূল্য সম্পর্কে মনোহর যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল তো না ই—এবং সে কোনদিন খুব বেশী অর্থ সম্পর্কে সচেতনও ছিল না বলেই আকস্মিকভাবে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া সোনার মোহর দুটি সম্পর্কেও বিশেষ কোন উত্তেজনা বোধ করেনি। কেবল যত্নের সঙ্গে প্যাটরার মধ্যে রেখে দিয়েছিল জামাকাপড়ের তলায় একফালি ন্যাকড়ায় বেঁধে।
ভুলেও গিয়েছিল বাদশাহী মোহর দুটোর কথা। তবে ইচ্ছা ছিল এবারে বাড়ির কর্তা এলে তার হাতে মোহর দুটি তুলে দেবে।
এমন সময় এলো কলকাতা হতে হরিহর! হরিহরেরও সংসারে এক মা-মরা বয়স্থ কন্যা ছাড়া কেউ ছিল না। তার বিয়েটা দিতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত। প্ৰভু রতনলালকেও সে কথা বলেছিল। রতনলাল তার মেয়ের বিবাহে সাধ্যমত সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।
হরিহরের এবারে ছুটি নিয়ে আসবার আরো একটা উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটিকে দেখেশুনে পাত্ৰস্থ করা। পাত্র একটি দেখা হল, কিন্তু টাকার খাঁকতি তার বড় বেশী। একদিন কথায় কথায় সেকথা মনোহরকে বলতে মনোহর তাকে আশ্বাস দিল তার হাতে জমানো যা আছে সে সব দেবে। এবং কথায় কথায় হঠাৎ সোনার মোহর দুটির কথা মনে পড়ায় সে দুটি প্যাটরা হতে বের করে হরিহরের হাতে দিয়ে বলে, মাটির তলায় মোহর দুটি সে পেয়েছে, সে ভেবেছিল বাড়ির মালিককেই মোহর দুটি দেবে—তা ঐ দুটোতে হরিহরের যদি কোন সাহায্য হয় তো সে নিতে পারে।
কলকাতায় শেঠের বাড়িতে চাকরি করে হরিহর, মোহর দুটি দেখেই সে বুঝেছিল তার মূল্য আছে এবং তার প্রভু শেঠকে মোহর দুটি দিলে বিনিময়ে সে বেশ মোটামত কিছু পাবে। সেই আশাতেই মোহর দুটি এনে সে মনিবের হাতে তুলে দেয়।
জহুরী রতনলাল মোহর দুটি পেয়ে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে হরিহরকে, কোথায় পেলি?
হরিহর মোহরের বৃত্তান্ত সব খুলে বলে।
হরিহরের মুখ থেকে মোহরের বৃত্তান্ত শুনে রতনলাল ব্যাপারটা গভীর ভাবে চিন্তা করে। পুরনো বাড়ির মেঝে খুঁড়ে মোহর পাওয়া গিয়েছে। ব্যাপারটার মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। আগেকার দিনে অমন অনেকেই তাদের ধনরত্ন ঘরের মেঝেতে—মাটির নীচে সংগোপনে লুকিয়ে রাখত, হয়তো ঐ রত্নমঞ্জিলের মাটির নীচেও তেমনি আছে!
সঙ্গে সঙ্গে একটা লোভের আগুন জ্বলে উঠে রতনলালের মনের মধ্যে।
রতনলাল হরিহর কে প্রশ্ন করে, এ মোহর দিয়ে তুই কি করবি?
কি করব আর বাবু—বিক্ৰী করে দেবো।
রতনলাল মোহর দুটি রেখে তখন হরিহরকে নগদ একশত টাকা দেয় হরিহর তাতেই খুশী।
দিন দুই বাদে কথা প্রসঙ্গে রাণী রতনলাল তার এক বাঙালী বন্ধুকে মোহরের কথা ঘলায় কৌতূহলী বন্ধু মোহর দুটো দেখতে চান।
০৫. মোহর প্রাপ্তির কাহিনী
মোহর দুটো দেখে এবং মোহর প্রাপ্তির কাহিনী রাণার মুখে শুনে বন্ধু বলেন, তাজ্জব ব্যাপার! শুনেছি আগেকার দিনে অনেক ধনীরা মাটির নীচে ঘড়া ঘড়া মোহর পুতে যখ করে রাখত। খবর নাও শেঠ, বাড়িটা কতদিনের পুরাতন এবং বর্তমানে মালিক কে!