কিন্তু থামিয়ে দেয়। রাণী। বলে, আইনের কারবারী আপনি দোত্তবাবু, এ কেমন বাত করছেন? হামি যদি বলি, যে বাবুটি এখোন বাড়িটা কিনতে চাইছেন তিনিই বা কিনতে চান কেন? বোলেন—জবাব দেন। বলতে বলতে হা-হা করে রতনলাল হেসে ওঠে।
হাসির উচ্ছাসে তার মেদ ও চর্বিবহুল বিরাট শরীরটা দুলতে থাকে।
যতীন বুঝতে পারে রতনলালকে অত সহজে ঘায়েল করা যাবে না। সে গভীর জলের কাতলা। এবং তার অফিসের সুভাস দত্তর মুখ থেকে শোনা কহিনীটা আবার আগাগোড়া তার মনে পড়ে।
সুবৰ্ণকিঙ্কন আর রত্নমঞ্জিল এই দুটোর মধ্যে যে একটা রহস্য জড়িয়ে আছে এবং একে অন্যের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সে সম্পের্কেও আর সন্দেহের অবকাশ মাত্রও থাকে না।
আচ্ছা দোত্তবাবু, হামি এবারে উঠবে। আর হ্যাঁ, রূপেয়ার আউর জরুরৎ হোয় তো গদিতে একটা ফোন কোরে দেবেন, হামি রূপেয়া ভেজ দেবো। রাম রাম বাবু!
রতনলাল গাত্ৰোখান করল এবং ধীরপদে একবার আড়চোখে অদূরে চেয়ারে উপবিষ্ট যতীনের দিকে তাকিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সুইং-ডোরটা ফাঁক হয়ে আবার স্বস্থানে ফিরে এল।
তাহলে এখন উপায়? প্রশ্নটা করে যতীন দত্তকে এবারে।
রেজিস্ট্রির দিনটা মাসখানেক পিছিয়ে দেওয়া ভিন্ন তো আর কোন উপায় দেখছি না! চিন্তিতভাবে দত্ত বলে।
বেশ, তবে অন্তত তাই করুন।
আরো মিনিট পনের পরে যতীন দত্ত-সাহার অফিস হতে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে জীপগাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে স্টার্ট দিতে বললে।
০৪. ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট
ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট তখন অসংখ্য প্রাইভেট গাড়ি ও মানুষের ভিড়ে সরগরম।
একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে লম্বা ঢাঙা মত একজন লোক মুখে একটা সিগারেট, আড়চোখে পুলিসের জীপগাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। যতীন দত্তকে গাড়ীতে উঠে চলে যেতে দেখে সেও চট্ করে একটা ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বললে অগ্রবর্তী জীপগাড়িটা দেখিয়ে সেটাকে অনুসরণ করতে।
এদিকে দত্ত অ্যাণ্ড সাহা অ্যাটর্নির ফার্ম থেকে বের হয়ে রতনলাল সোজা নেমে এসে রাস্তায় অপেক্ষামান তার নিউ মডেলের ঝকঝকে সন্টুডিবেকার গড়িটার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার কিষেণ হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল।
গড়ির মধ্যে অত্যন্ত ঢ্যাঙ ও রোগা একটি লোক, পরিধানে পায়জামা ও পাঞ্জাবি, তার উপরে সার্জের সেরওয়ানী, মাথায় একটা সালের টুপি, হাতে ধরা মাকোভিচের একটা টিন, নিঃশব্দে বসে ধূমপান করছিল।
রতনলালকে গাড়ির মধ্যে উঠে বসতেই সেই ঢাঙা লোকটি প্রশ্ন করলে, তোমার অ্যাটনি কেন ডেকেছিল হে?
প্রশ্নকারীর জবাব কোন কিছু না বলে রতনলাল ড্রাইভার কিষেণের দিকে তাকিয়ে বলল, অফিস চল। জোরে চালাও।
গাড়ি চলতে শুরু করে।
কোর্ট ভেঙেছে, এই সময়—ঐ রাস্তায় বেজায় ভিড়, তা সত্ত্বেও কিষেণ দক্ষ চালনায় অনায়াসেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে গাড়ি বেশ জোরেই চালিয়ে নিয়ে যায়।
রতনলাল গাড়ির নরম গদিতে বেশ আরাম করে হেলান দিয়ে বসে জামার পকেট থেকে সুদৃশ্য একটা রূপার কোটা বের করে, কোটা হতে দু-আঙুলের সাহায্যে খানিকটা সুগন্ধি মিষ্টি সুপারি বের করে মুখগহ্বরে ফেলে কৌটোটা আবার যথাস্থানে রেখে দিল।
আরাম করে সুপুরি চিবুতে চিবুতে এতক্ষণে রতনলাল কথা বললে, পিয়ারীলাল, আজ রাত্রেই তুমি একবার বামনদেব অধিকারীর সঙ্গে দেখা কেরবে। তোমার হাতে হামি কিছু নগদ টাকা দেবে—চেষ্টা কোরবে যাতে কোরে রত্নমঞ্জিলের বিক্রয়-কোবালাটা দু’তিনদিনের মধ্যেই রেজিষ্ট্রি করিয়ে নেওয়া যায়। দরকার। যেমন বুঝবে-পঞ্চান্ন হাজার টাকা ছাড়াও দু-চার হাজার যদি বেশীও দিতে হয়, কবুল করে আসবে। মোট কথা মনে রাখবে, রেজিস্ট্রিটা দু-তিন দিনের মধ্যেই করিয়ে নিতে চাই।
পঞ্চান্ন হাজার টাকার উপরেও আরো দু-চার হাজার!
হ্যাঁ, দরকার হলে আরো দশ-বিশ হাজার—
কিন্তু ব্যাপারটা কি শেঠ?
ও বাড়ির আরো খরিদ্দার জুটেছে। বল কি শেঠ।
হ্যাঁ—
কিন্তু অধিকারীকে তো আগাম দশ হাজার টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন অন্য পার্টির কথা আসে কোথা থেকে?
সে যদি এখন খেসারত দিয়ে বায়না ফিরিয়ে দেয়, বলে বিক্রি করব না—আটকাবে কি কোরে? তাই ভেবেছি চাদির জুতি দিয়ে বেটার মুখ বন্ধ করব। আমিও রতনলাল রাণা। একবার যখন হাত বাড়িয়েছি, এত সহজে হাত গুটিবো না।
কিন্তু শেঠ, তুমি কি সত্যিই মনে কর সেই বেটা মালীর কথা সত্যি?
কিন্তু সোনার মোহরটা তো সত্যি! একেবারে খাঁটি বাদশাহী মোহর!
পিয়ারীলাল বললে, বহরমপুর এককালে নবাবদের লীলানিকেতন ছিল! সেখানকার মাটিতে এক-আধটা বাদশাহী মোহর কুড়িয়ে পাওয়া এমন কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। স্রেফ একটি দুটি সোনার মোহর পাওয়ার ওপরে এতগুলো টাকা নিয়ে এমনি বাজি খেলাটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে শেঠ?
আরে জীবনটাই তো একটা বাজি খেলা! বাজি খেলায় হারজিত আছেই—জীবনে বহু বাজিতে জিতেছি, না হয় এ বাজিতে হারলামই। রতনলাল তার জন্য পরোয়া করে না!
সত্যি স্রেফ একটা বাজি খেলাই বটে।
রতনলাল রাণা বাজি খেলতেই নেমেছে!
মাস দেড়েক আগেকার কথা।
ব্যাপারটা প্রথম হতেই একটা দৈবাৎ ঘটনাচক্ৰ বলেই মনে হয়।
মাসখানেকের ছুটি নিয়ে হরিহর গিয়েছিল তার দেশে বহরমপুরে। অনেকদিনের বিশ্বাসী এবং প্রিয় ভৃত্য হরিহর রতনলালের। বহরমপুরে বামদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষদের বাড়ী রত্নমঞ্জিল এমনি খালিই বহুদিন হতে পড়ে আছে। হরিহরের এক ভাই মনোহর রত্নমঞ্জিল থাকে কেয়ার টেকার’ হিসাবে।