অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা যেন হঠাৎ চাপ বেঁধে ওঠে।
লালবাজারে এল কিরীটী তার বিশেষ পরিচিত ইন্সপেক্টর সুভাষ দত্তর ঘরে গিয়ে ঢুকল।
সুভাষ দত্ত বললেন, কি ব্যাপার কিরীটীবাবু?
কিরীটী বলল, অ্যাটর্নি রমেশ দত্ত তো আপনার পরিচিত, না?
হ্যাঁ।
তার পার্টনার রাঘব সাহা লোকটা তেমন জানেন?
যেমন মোটা তেমনি কালো ও তেমনি কুটচক্রী। দত্ত অ্যাণ্ড সাহা অ্যাটর্নি ফর্মের ইদানীং যে দুর্নাম রটেছে বাজারে তা তো ঐ রাঘব সাহার জন্যেই শুনেছি। সুভাষ দত্ত বললেন।
আজ একবার দত্ত-সাহার ওখানে একজন কাউকে এখান থেকে পাঠাতে পারবেন?
কেন পারবে না! কিন্তু ব্যাপারটা কি?
শুনুন বহরমপুরে আমার এক বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোক বামদেব অধিকারীর রত্নমঞ্জিল নামে একটা বাড়ি বিক্রি হচ্ছে—কথাটা আরো একটু পরিষ্কার করে বলি, কে এক রাণা বাড়িটা কিনবার জন্য দশ হাজার টাকা ইতিমধ্যে অগ্রিমও দিয়েছে। দাম ঠিক হয়েছে পঞ্চান্ন হাজার টাকা। সামনের মাসের পনেরই বিক্রয়-কোবালা-রেজিস্ট্রি হবার কথা।
বুঝলাম।
রাঘবকে সে বলবে তার হাতে একজন খদ্দের আছে। সে ষাট হাজার টাকা দাম দেবে। এবং কমিশন হিসাবে তাকে দেবে পাঁচ হাজার।
বাড়িটা যাতে রাণা কিনতে না পারে, এই তো?
না, ঠিক তা নয়—আসলে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা মাসখানেক পিছিয়ে দিতে চাই। এমনিতে দত্ত রাজী হলেও তার পার্টনার রাজী হবে না, তাই ঐ টোপ আর কি!
বেশ। কিন্তু ব্যাপারটা কি কিরীটীবাবু?
আসলে ঐ রত্নমঞ্জিলের সঙ্গে একটি অপহৃত সুবর্ণ-কিঙ্কন-রহস্য জড়িয়ে আছে।
সুবৰ্ণকিঙ্কন!
হ্যাঁ। পরে আপনাকে সব বলব। কিরীটী আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে একটা ফাইল টেনে নেয়।
ঐদিনই অ্যাটর্নি দত্ত-সাহার নিভৃত চেম্বারে সুভাষবাবু-প্রেরিত লোক যতীন ঘোষ ও রাঘব মুখোমুখি বসে দ্বিপ্রহরে কথা হচ্ছিল। পাশে দত্তও ছিল।
কিরীটীর অনুমান ভুল হয়নি।
রাঘব সাহা নির্বিবাদেই তার টোপ গিলেছে। কিন্তু আপত্তি তুলেছে তার পার্টনার দত্ত। দত্ত যতীন ঘোষকে বললে, এখন তা কি করে সম্ভব যতীনবাবু। দশ হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়ে গিয়েছে—এতে ব্রিচ অফ কনট্রাক্টের মামলায় পড়তে হবে যে!
চেষ্টা করলে আপনি ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবেন না-এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মিঃ দত্ত। এতে করে যদি দু-চার হাজার খরচও হয় আমার পার্টি দিতে রাজী আছে।
রাঘব সায় দেয়, চেষ্টা করে দেখতে একবার ক্ষতিটা কি দত্ত? পাঁচ হাজার টাকাও তো কম নয়!
কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কি বলুন তো মিঃ ঘোষ? ঐপুরাতন বাড়িটার প্রতিই বা আপনার ক্লায়েন্টের লোভ হল কেন? দত্ত যতীন ঘোষকে প্রশ্ন করে।
যতীন ঘোষ বললেন, আমার ক্লায়েন্ট কেন ঐ বাড়িটা কিনতে চান তা তো বলতে পারব না। তবে ডিলটা করে দিতে পারলে আমিও কিছু পাব।
রাণার তো এখনই আসবার কথা—তাকে আসতে বলেছি। দশ হাজার টাকা সুদ-সমেত দিলে যদি রাজী হয়ে যায়! রাঘব বলে ওঠে।
তা হলে অবিশ্যি কোন ঝামেলাই থাকে না। তবে ব্যাপার যা বুঝেছি তাতে অত সহজে সে রাজী হবে বলে মনে হচ্ছে না।
এমন সময় বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।
কি রে?
আজ্ঞে, রাণা সাহেব এসেছেন।
ভেতরে পাঠিয়ে দে। দত্ত বলে।
একটু পরে রাণা এসে ঘর প্রবেশ করল চেম্বারের সুইংডোর ঠেলে, রাম রাম! দোত্তবাবু, কি ব্যাপার? এত জরুরী তোলব কেন?
বসুন—বসুন রানা সাহেব!
যতীন ঘোষ চেয়ে দেখছিলেন আগন্তুককে। মোটাসোটা ভূড়িয়াল চেহারা। গায়ে দামী সার্জের সেরওয়ানী, পরনে মিহি নয়নসুখের ধুতি।
চোখ দুটো ছোট, কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি। অতি মাত্রায় সজাগ।
খানিকটা ভণিতা করে অবশেষে সোজাসুজি দত্তই ব্যাপারটা রাণাকে বললে, একটা কথা ভাবছিলাম রাণা সাহেব, মিথ্যে কেন অতগুলো টাকা ঐ পুরাতন বাড়িটার পেছনে ঢালবেন! তার চাইতে আশে পাশে অন্য কোন বাড়ি—
মৃদু হাসিতে রতনলাল রাণার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে বাত তো হাপনি ঠিকই বলিয়েছেন দোত্তবাবু—লেকেন একবার যখন টাকা হামি আগাম দিয়েসে, কন্ট্রাকটু ভি হইয়েসে, তোখন ও তো বিক্রিই হয়ে গিয়েসে—কি বোলেন অ্যাঁ!
তা অবিশ্যি বলতে পারেন। তবে যদি আপনাকে সুদের উপরেও কিছু বেশী ধরে দেওয়া যায়! কথাটা বললে রাঘব।
রতনলাল রাণাকে টাকা দেখলাবেন না দোত্তসাহেব। টাকার বাৎ থোড়াই আছে, চান তো আরো কিছু আগাম ভি হামি দিতে পারি। লেকেন ও বাড়িটা হামার চাই-ই।
কিন্তু কেন বলুন তো রাণা সাহেব? রাঘব সাহা প্রশ্ন করে।
সে কি দোত্তবাবু, হাপনাকে তো হামি বলিয়েসে কেন বাড়িটার হামার প্রয়োজন।
ফ্যাক্টরী করবেন তো? তা ওর চাইতে যদি ভাল একটা বাড়ি পাওয়া যায়— মানে আত পুরনো নয়।
না, ওহি বাড়ি হামি লিবে।
শুনুন তবে, আর একজন খরিদ্দার আছে—বলেন তো মাঝখান থেকে কিছু মোটা মতন পেতে পারেন–
না।
তাহলে আপনি ঐ বাড়িটাই নেবেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি বলছিলাম কি–
দেখেন দোত্তবাবু, হামি রতনলাল। —সিধা বাতের লোক আছে। সিধা বাতই হামি পসন্দ কোরে। হাপনাদের কাছে ভি সিধা বাতই চাই দোত্তবাবু। রূপেয়া দেখলাচ্ছেন রতনলালকে-ও তো হাতের মোয়ালা আছে, আনা-যানা তো রূপেয়াকে দস্তুর আছে!
মিঃ রাণা, আপনি ঠিক আমাদের কথা ধরতে পারেননি—ও কথা আমি বলিনি। বলিছলাম একটা সেকেলে পুরাতন বাড়ির পিছনে মিথ্যে কেন অতগুলো টাকা ঢালবেন! তাছাড়া-বিনীত হাস্যের সঙ্গে রাঘব সাহা আরো বলবার চেষ্টা করে।