এক-আধটা টাকা নয় তো–পঞ্চান্ন হাজার টাকা!
টাকাটাও অবশ্য এখনো সম্পূর্ণ পেমেন্ট হয়নি—হাজার দশেক বায়না নিয়েছে বামদেব এবং সামনের পনের তারিখে বাকি পেমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়-কোবালা রেজিস্ট্রি হবে। আগাম দশ হাজার টাকা নিয়েছে এবং কথাবাতাঁর যখন সব ঠিক-ঠাক, কেবল বিক্রয়কোবালা রেজিষ্ট্র করা বাকী, তখন একপ্রকার বিক্রয়ই হয়ে গিয়েছে ধরে নিতে হবে।
হঠাৎ কিরীটীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়লো।
গাড়ির মধ্যস্থিত দর্পনে বার দুই একটা গাড়ির সাইড হেডলাইটের আলো ওর সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী ড্রাইভারকে বলে গাড়ির গতি আর একটু কমিয়ে দিতে। ট্যাক্সির স্পীড কমতেই কিরীটী সন্তপণে পিছনের দিকে তাকাল। সামান্য ব্যবধানে সাইডলাইট জ্বালিয়ে একখানা গাড়ি ট্যাক্সির পিছনে পিছনেই আসছে সমগতিতে।
কিরীটী তার সহজ বিচারবুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পেরেছিল, সাধারণ কোন গাড়ি নিশ্চয়ই নয়, তাই ট্যাক্সির গতি কখনো একটু কমিয়ে কখনো একটু বাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ পরীক্ষা করে দেখল এবং বুঝতে দেরি হয় না। ওর পাশ্চাতের গাড়িখানা ওকে অনুসরণ করছে।
সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী হয়ে ওঠে কিরীটী। এবং আরো কিছুটা পথ চলে কিরীটী সুস্পষ্টই লক্ষ্য করে পাশ্চাতের গাড়িটা ঠিক একই ভাবে তার ট্যাক্সিকে অনুসরণ করে আসছে। ব্যাপারটায় ও একটু বিস্মিতই হয়।
নিতান্ত বামদেব কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েই কিরীটী বামদেবের ওখানে রাত্রের ডিনারে গিয়েছিল এবং বামদেবও প্রথমটায় আসল উদ্দেশ্যটা তার কিরীটীকে খুলে বলেনি। খাওয়াদাওয়ার পর সব বলল।
এ ক্ষেত্রে বাইরের কোন তৃতীয় পক্ষের তো ব্যাপারটা আঁচ করাও সম্ভব নয়। তবে?
এখন স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে বামদেবের ওখানে যাওয়াটা তার কারো-না-কারো শ্যেন সতর্ক দৃষ্টিকে এড়ায়নি। বামদেবের ওপরে কারো-না-কারো লক্ষ্যও আছে। অতঃপর কিরীটী সোজাপথে না গিয়ে ইচ্ছা করে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল।
কিরীটী মনে মনে বুঝি মৃদু হাসে এবং সে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয় মনে মনে তাঁর অনুমানটা মিথ্যে নয় বলে। সে ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আদেশ দেয়, সদািরজী, সোজা পার্কসার্কাসের দিকে চল। সঙ্গে সঙ্গে সর্দারাজী গাড়ি ঘোরায়। পার্কসাকাস অঞ্চলে কিরীটীর এক শিল্পী বন্ধু থাকে। সবিতাব্রত সেন। কিরীটীর নির্দেশে সর্দারাজী সেই দিকে গাড়ি চালায়।
নির্জন রাস্তায় কেবল গ্যাসের আলোগুলো টিম টিম করে জুলছে। এদিক হতে। ওদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে রাস্তাটা শূন্য—একেবারে খাঁ খাঁ করছে।
সবিতাব্রতর বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে এসে কিরীটী সর্দারাজীকে থামতে বললে সর্দারাজীকে গাড়ির স্পীডটা স্লো করতে বললে এবং একসময় চলন্ত ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল, ট্যাক্সি আবার স্পীড নিল।
অন্য গাড়িটাও ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। পশ্চাতে গড়ির সাইডলাইট দুটো দপ করে হঠাৎ ঐ সময় নিভে গেল।
কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে একটা লাইটপোস্টের আড়ালে আত্মগোপন করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর এক সময় এগিয়ে গিয়ে সবিতাব্রতর বাড়ির দরজার গায়ে কলিং বেলটা টিপল।
কিরীটী বারিকয়েক বাজাবার পর দরজার ওপাশে পদশব্দ শুনতে পেল।
দরজা খুলে দিতে লোক আসছে, কিরীটী বুঝতে পারে।
দরজা খুলতেই সামনে সবিতাব্রতর সঙ্গে চোখাচৌখি হয়ে গেল কিরীটীর।
এত রাত্রে কিরীটীকে দেখে সবিতাব্রত কম বিস্মিত হয়নি। সবিতাব্রত ঘুমোয়নি, জেগে বসে একটা ছবিতে রিটাচ দিচ্ছিল সন্টুডিওর মধ্যে।
ব্যাপার কি রে! এত রাত্রে তুই? সবিতাব্রত প্রশ্ন করে।
কথা আছে—চল ভেতরে। কিরীটী বললে।
না করে কেবল আহ্বান জানল, আয়।
দরজা বন্ধ করে দুজনে ওপর উঠতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কিরীটী প্রশ্ন করে, জেগে ছিলি মনে হচ্ছে—
হ্যাঁ, একেটা ছবির রিটাচ দিচ্ছিলাম।
সবিতাব্রতর দোতলায় বসবার ঘরের মধ্যে ঢুকে ইজিচেয়ারটার ওপরে গাটা এলিয়ে দিতে দিতে আরাম করে চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে, এক কাপ কফি খাওয়াতে পারিস সবিতা?
করছি—
সবিতাব্রত বলতে গেলে একাই থাকে। দ্বিতীয় প্রাণী এক বৃদ্ধ ভৃত্য। ইলেকট্রিক স্টেভে দুইেকাপের মত কফির জল চাপিয়ে দিল সবিতাব্রত।
গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, বাকি রাতটুকু এখানে কটাব চেয়ারে শুয়েই-একটা বালিশ দে!
কিরীটী যে বিনা কারণে এই শীতের মধ্যরাত্রে তার বাড়িতে এসে ওঠেনি। সবিতাব্রত তা জানে। মনের মধ্যে কৌতূহল উঁকিঝুঁকি দিলেও ও সম্পর্কে এতক্ষণ কোন প্রশ্নই করেনি। আকারণ কৌতূহল কিরীটী পছন্দ করে না। কোন দিন প্রশ্রয়ও দেয় না।
কিন্তু কিরীটী নিজেই সবিতাব্রতর কৌতূহলের অবসান ঘটায়।
আচ্ছা জব্দ করা গেছে বেটাকে-বলতে বলতে কিরীটী নিঃশেষিত কফির কাপট একপাশে নামিয়ে রেখে ভাল করে হেলান দিয়ে শোয় চেয়ারের ওপরে।
কিরীটীর হাস্যোদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সবিতাব্রত প্রশ্ন করে, কাকে আবার জব্দ করলি?
সে আছে। একজন। বামদেববাবুর ওখানে গিয়েছিলাম—সর্দারজীর ট্যাক্সিতে ফিরছি, দেখি বেটা আমায়। ফলো করছে। হঠাৎ মনে হল রাতটা তোর এখানে এসে কাটিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে। বেটা বোধ হয় এখনো ট্যাক্সিটা ফলো করছে।-বলতে বলতে কিরীটী হাসল।
আলোটা নিভিয়ে দেব? সবিতাব্রত প্রশ্ন করে।
তা দে।
ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে সবিতাব্রত এগিয়ে গিয়ে আবার ছবিটা নিয়ে বসল পাশের ঘরে। দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই রইল।