চমকে ওঠে বাণী রত্নমঞ্জিলের সেই ভৃত্য মনোহরকে ফিসফিস করে তার বাপের সঙ্গে কথা বলতে শুনে।
ঘরের মধ্যে আমাকে শিকল তুলে আটকে দিয়েছিল কর্তা। কিন্তু বেটারা তো জানত না ঘরের দক্ষিণের জানালার একটা শিকা আলগা। শিকটা তুলে পালিয়ে এসেছি। অনেক লোকজন এসে গিয়েছে রত্নমঞ্জিলে।–
ওরা কে বুঝতে পারলে মনোহর? বাধা দেয় অনিল।
না। তবে কথায় বার্তায় মনে হল পুলিসের লোক। আমি আর এখানে এক দণ্ডও থাকব না। ধরতে পারলেই ওরা আমাকে পুলিসে দেবে।
ভয় পাচ্ছ কেন মনোহর। পুলিসে দিলেই অমনি হল? ওরা জানতে পারবে না যে আমরা এখানে থাকতে পারি!
না কর্তা, কাল সকালে বিনয়বাবুর কথা শুনে বুঝেছি, আপনাদের সন্ধান এখনো না পেলেও ওরা টের পেয়েছে এই জঙ্গলের মধ্যে কেউ থাকে। পুলিস নিয়ে খোঁজে আসলে ঠিক সবাইকে খুঁজে বের করবে। সময় থাকতে আপনিও পালান। মনোহর উত্তেজিতভাবে কথাগুলো বলে যায়।
না। সেই সিন্দুক না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি নড়ছি না।
আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। কর্তা, সত্যি মাটির নীচে কোন রকম সিন্দুক পোঁতা থাকলে আমরা কি খুঁজে পেতাম না এতদিন! আমরা এই এক মাস ধরে বাড়ির আশপাশ কত জায়গাতেই তো মাটি খুঁড়ে দেখলাম। আমার মনে হয় যদি কিছু থাকে তো ঐ বাড়ির মেঝের নীচেই কোথায়ও পোঁতা আছে।
না, তা হতেই পারে না।
তাই যদি না হবে তো ঐ বাড়িটা কিনবার জন্য সবাই এত চেষ্টা করছে কেন! এই তো দিন দুই আগে আর একজনও বাড়িটা কিনতে এসেছিল, বিনয়বাবু লোকটাকে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন!
মনোহরের যুক্তিটা কেন যেন আনিলের মনে লাগে।
হয়তো মনোহরের কথাই ঠিক। নচেৎ নোটবুকের নির্দেশমত কই কোন শিলাখণ্ডই তো এক মাস ধরে খুঁজে-খুঁজেও জঙ্গলের মধ্যে কোথাও পাওয়া গেল না!
তাছাড়া মনোহর যে বাদশাহী মোহর দুটি পেয়েছিল, সেও তো ঐ বাড়িরই মেঝের একটা ফাটলের মধ্যে সাপ মারতে গিয়েই!
অনিল বলে, মনোহর, তাহলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব, চল আজই রাত্রে ঘরের সেই মেঝেটা খুঁড়ে দেখি।
আমি আর ওর মধ্যে নেই বাবু। যা করবার আপনি করুন গে—আমার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন, আমি চলে যাই।
নিশ্চয়ই, মিটিয়ে দেব বৈকি-আগে টাকা পাই, তবে তো! কথার খেলাপ আমি করি না। যা পাব তার অর্ধেক ভাগ তোমার।
না কর্তা, আধাআধি বাখরায় কাজ নেই। আর, আমাকে হাজারখানেক টাকা দিন যেমন আগে বলেছিলেন, আমি চলে যাই। মাটি খুঁড়ে যা পাবেন তা আপনিই সব নেবেন।
টাকা এখন আমি কোথায় পাব, টাকা কি আমার হাতে আছে নাকি?
ওসব বাজে কথা রাখুন। দেখি। যা দেবেন বলেছিলেন-হাজার টাকা, এখনি মিটিয়ে দিন। আপনার কথায় লোভে পড়ে এতদিনকার পুরনো মুনিবের সঙ্গে অনেক নেমকহারামি করেছি। আর নয়, দিন টাকাটা বের করে দিন, ভোর হয়ে এল, ছুটে গিয়ে আবার আমাকে শেষরাত্রের প্রথম ট্রেনটা ধরতে হবে।
বললাম তো, টাকা এখন কোথায় যে দেব!
আবার চালাকি খেলছেন কেন? বার করুন তো টাকাটা, চটপট!
বলেছি তো টাকা নেই, তা দেব কোথা থেকে?
টাকা নেই মানে! মনোহরের কণ্ঠস্বরটা এবারে বেশ স্পষ্ট ও ঝাকালো মনে হয়।
টাকা নেই মানে টাকা নেই। চলে যেতে হয় চলে যা। ঠিকানা রেখে যা, টাকা আমি ঠিক পৌঁছে দেব।
মাইরি। সোনার চাঁদ আমার!
মুহুর্তে অনিলের চোখ দুটো আগুনের মত দপ করে জ্বলে ওঠে। বাঘের চোখের মত তার চোখ দুটো জ্বলতে থাকে যেন।
চাপাকণ্ঠে গর্জন করে ওঠে, এই উল্লক! মুখ সামলে কথা বল!
ওঃ, আবার চোখরাঙানি! এক ঘায়ে এক্কেবারে ঠাণ্ডা করে দেব।
মনোহরের মুখের কথাটা শেষ হয় না-অকস্মাৎ যেন বাঘের মতই চোখের পলকে লাফিয়ে পড়ে অনিল মনোহরের ওপরে এবং লোহার মত শক্ত দু হাতে তার গলাটা টিপে ধরে।
ভয়ার্ত কণ্ঠে চেচিয়ে ওঠে এতক্ষণে বাণী, বাবা! বাবা!
অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে মনোহর টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় এবং অনিল দু হাতে তার গলা টিপে বুকের ওপরে উঠে বসে।
বাণী ছুটে এসে বাপকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করে দু হাতে টেনে ধরে। কিন্তু বৃথা, অনিল তখন মরীয়া হয়ে উঠেছে।
আকস্মিক বেকায়দাভাবে আক্রান্ত হয়ে মনোহরাও সুবিধা করতে পারে না। অনিলের হাতের লৌহকঠিন আসুরিক পেষণে খুব শীঘ্রই কাহিল হয়ে পড়ে।
অনিল হয়তো মনোহরকে শেষই করে ফেলত, কিন্তু বাণী মরীয়া হয়ে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মনোহরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অনিল।
দু পাশের শিরা ফুলে উঠেছে, রক্তচাপে সমস্ত মুখটা লাল হয়ে উঠেছে মনোহরের। হাঁপাচ্ছে সে তখন। একটা লাথি দিয়ে মনোহরকে ঘর থেকে বের করে দেয় অনিল।
মনোহরও একছুটে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অনিল গর্জাতে থাকে, হারামজাদাকে শেষ করে ফেলাই উচিত ছিল। তুই বাধা দিলি কেন? টাকার সাধ ওর জন্মের মত মিটিয়ে দিতাম।
বাণী স্তম্ভিত নির্বাক।
বাপের এই মূর্তির সঙ্গে পূর্বপরিচয় তো তার কখনো ঘটেনি! এ যে তার কল্পনাতীত! এই তার বাপ!
হাত-পা যেন বাণীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। শব্দ বের হয় না গলা দিয়ে।
২৪. আরামবাগে এসে উপস্থিত
বেলা প্রায় নটা নাগাদ জনাদশেক পুলিশ নিয়ে কিরীটী ও রহমৎ সাহেব আরামবাগে এসে উপস্থিত হল।
অতীতের নবাবী ঐশ্বর্যের ভগ্নস্তুপ।
বেদনার্ত হাহাকারে যেন আজও স্মরণ করিয়ে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া দিনকে।
দেখছেন তো মিঃ রায়! এই ভগ্নস্তুপের মধ্যে কোন মানুষ কি থাকতে পারে? রহমৎ সাহেব। আবার বলেন।