বলেন কি?
হ্যাঁ, ক্লোরোফরম করে নিয়ে গিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে ফিরে বাকি কথাটা বলে কিরীটী, তুমি স্টেশনটা watch করবে। রহমৎ সাহেব, আপনি স্টেশন মাস্টারকে একটা চিঠি দিয়ে দিন যদি প্রয়োজন হয় তো তিনি যেন ওকে সাহায্য করেন।
মৃত্যুঞ্জয়কে চিঠি দিয়ে স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী রহমৎ সাহেবকে বললে, বাছা বাছা সেপাইয়ের দরকার যে রহমৎ সাহেব!
কখন দরকার বলুন?
এখুনি। একবার আরামবাগে গিয়ে হানা দিতে হবে।
বেশ, এখুনি আমি ব্যবস্থা করছি।
বহরমপুর আসাবার আগের দিন সিটি হোটেলে রাত বারোটার পর গিয়ে যোগানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিল কিরাটী পূর্বেই।
যোগানন্দ কিরীটীর পরিচয় পেয়ে খুশী হয়। যোগানন্দের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয় কিরীটীর।
অনিল চৌধুরীর মোটামুটি ইতিহাস যতটুকু যোগানন্দের জানা ছিল সে কিরীটীকে বলে, কিছু না গোপন করে। এবং কিরীটীর কাছ থেকে যোগানন্দও রত্নমঞ্জিল ও সুবর্ণকিঙ্কনের ইতিহাস শোনে।
যোগানন্দ আর দেরি করে না। কেন যেন তার মনে হয় আচমকা রহস্যজনক ভাবে নিরুর্দিষ্ট অনিলের বুঝি একটা হদিস মিলল, আর তাই পরের দিনই প্রত্যুষে সবিতার সঙ্গে দেখা করে সব কথা তাকে খুলে বলে।
যোগানন্দের মুখে সব কথা শুনে চকিতে সবিতার একটা কথা মনে পড়ে। অনিল ও বাণীর চলে যাবার দিন সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য অনিল বাইরে গেলে সবিতা কৌতূহলভারে পোটলটি খুলেছিল এবং তার মধ্যে একটা কঙ্কন ও লাল মলাটের একটা নোটবই দেখেছিল। কিন্তু ভাল করে সব কিছু দেখবার সুযোগ পায়নি। সেই রাত্রেই স্বামী চলে যায় এবং বাণীকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রথম বিবাহের পর তখনও তার সুখের সংসারে ভাঙন ধরেনি। শিক্ষার, ভদ্রতার, রুচির গিলটির পাতটা ওপর থেকে খসে গিয়ে যখন অনিলের লোভী অসংযত, উচ্ছৃঙ্খল ও নির্লজ্জা পরবর্তী চরিত্রের দৈন্যটা প্রকাশ পায়নি, তখন একদিন কথায় কথায় তার স্বামীর মুখেই তার স্বামীর শৈশবের ইতিহাস শুনেছিল সবিতা। নবাব-অনুগৃহীত তার মাতামহদের শৌর্য ও ঐশ্বর্যের কথা, বহরমপুরে তাদের রত্নমঞ্জিলের গল্প অনেক কিছুই শুনেছিল।
কিরীটী কর্তৃক বিব্রত কাহিনী যোগানন্দের মুখে শুনে সবিতার কেন যেন ধারনা হল, হয়তো অনিল বহরমপুরেই গিয়েছে।
এবং সে স্বামীর সন্ধানে বহরমপুরে যাওয়াই স্থির করল।
যোগানন্দকে সেকথা বললেও। যোগানন্দ কিন্তু একই বহরমপুরে অনিলের খোঁজে যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু সবিতা রাজী হল না।
বাণীর জন্য মনটা তার সত্যিই বিশেষ চঞ্চল হয়ে ছিল।
সে বললে, আমি তোমার সঙ্গে যাব যোগেন। আমার স্থির বিশ্বাস, বাণী তার সঙ্গেই গিয়েছে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, সে যা খুশি তাই করুক। কিন্তু বাণীকে আমার ফিরিয়ে আনতেই হবে।
সেইদিনই যোগানন্দ ও সবিতা বহরমপুর যাত্রা করে।
২৩. কিরীটী থানায় গিয়েছে
কিরীটী থানায় গিয়েছে, এখনো সেখান থেকে ফেরেনি। বিনয় ও সুজাতা দোতলার ঘরে বসে সেই সম্পর্কেই আলোচনা করছে। এমন সময় যোগানন্দ ও সবিতা এসে সেখানে উপস্থিত হল।
সুজাতা বা বিনয় কেউ তাদের চেনে না। জীবনে কখনো তো দেখেনি। কিন্তু যোগানন্দর মধ্যস্থতায় পরস্পরের পরিচয় হল।
সবিতা এ বাড়ির ভাগ্নে-বৌ।
সবিতা কিন্তু সুজাতার মুখে গতরাত্রে বামদেবের আচমকা নিরুর্দিষ্ট হওয়ার কথা শুনে এখানকার ক’দিনের ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়।
বিনয়ও সংক্ষেপে রত্নমঞ্জিলের বিক্রয়-ব্যাপার নিয়ে গত মাসখানেকের ঘটনা ও সুবৰ্ণকিঙ্কনের সমস্ত ইতিহাস সবিতাকে বলে।
সবিতার চোখে যেন নতুন আলো ফুটে ওঠে। ইদানীংকার স্বামীর অধঃপতনের ইতিহাসটাও ঐ সঙ্গে সঙ্গে সবিতার চোখের উপর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বুদ্ধিমতী সবিতার মনে হয় এই দুই ব্যাপারের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথায়ও একটা যোগসূত্র আছে একে অন্য হতে বিচ্ছিন্ন নয়।
আর তাই যদি সত্য হয় তো এদের কাছে লজ্জায় সে মুখ দেখাবে কেমন করে?
এই সুজাতা, এই বিনয় তারা তো অনিলের থেকে তাকে পৃথক ভাববে না। সত্যি হোক মিথ্যে হোক আনিলের কলঙ্কের দাগ তো তার গায়ে কালি ছিটোবে।
তবু মনে মনে সে বার বার বলে, হে ভগবান! যেন সত্য না হয়। এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে যেন তার স্বামী না জড়িয়ে থাকে।
কিন্তু সবিতা জানত না নির্মম ভাগ্যবিধাতা তাকে কোন পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। নির্যাতন ও অপমানের এখনো কত বাকি।
তাড়াতাড়ি বাণী নোটবুকটার পাতার পর পাতা উল্টেপাল্টে পড়ে চলে। কিন্তু বিশেষ কিছুই আর চোখে পড়ে না। শেষের দিকে ছাড়া-ছাড়া পাতাগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা অসংলগ্ন, অস্পষ্ট, খেদোক্তিতে ভরা। একটা অনুশোচনা যেন বড় করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এমন সময় হঠাৎ দ্রুত পদশব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি বাণী খাতাটা যথাস্থানে রেখে ফু দিয়ে আলোটা নিভিয়ে শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
ঘরে এসে একটু পরেই তার বাবা অনিল যে প্রবেশ করল, বাণী তা বুঝতে পারে।
জেগে থাকলেও ঘুমের ভান করে কাঠ হয়ে শয্যায় পড়ে থাকে বাণী।
অনিল ঘরে ঢুকে দেশলাই দিয়ে প্রদীপটা জ্বালাল। প্রদীপের আলোয় ঘুরে একবার অদূরে শয্যায় শায়িত ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর পুটলি খুলে আলোর সামনে নোটবইটা নিয়ে বসল।
শেষরাত্রের দিকে বাণী কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেই জানে না।
একটা ফিসফাসে কথাবার্তার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়।