জুতোর মচমচ শব্দ তুলে পিয়ারী বামদেবের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল, এই যে অধিকারী মশাইয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখছি! গুপী, ওঁকে তুলে বসিয়ে দাও।
গুপী পিয়ারীর নির্দেশ পালন করে, এক হ্যাঁচকা টানে তুলে বামদেবকে বসিয়ে দিল।
তারপর অধিকারী মশাই, এবারে রত্নমঞ্জিল বিক্রী করবেন তো?
পিয়ারীর কথায় বামদেবের সর্বাঙ্গ আক্ৰোশে যেন জ্বলে ওঠে রি-রি করে। অবজ্ঞাভরে জবাব দেন, শয়তান! তুই যদি ভেবে থাকিস, এইভাবে অত্যাচার করে তুইও আমার স্বীকৃতি পাবি তো ভুল করেছিস।
গর্তের মধ্যে পড়েও এখনো তড়পানি যায়নি!! শোন বামদেববাবু, রানার কাছে যা কবুল করে বায়না নিয়েছ। সেই পঞ্চান্ন হাজার টাকাই তোমাকে দেওয়া হবে, যদি ভালয় ভালয় এই স্ট্যাম্পযুক্ত বিক্রয়কোবালায় শান্ত সুবোধ ছেলের মতই সই করে দাও। আর ত্যাঁদাঁড়ামি যদি কর তো, বিক্রয়কোবালায় সই তো করতেই হবে—একটি কপর্দকও পাবে না। এখন ভেবে বল কোন পথ নেবে!
মরে গেলেও বাড়ি বিক্রি করব না। বুঝতে পারছি সেই শয়তান ঘুঘু শেঠ রানারই সব কারসাজি! তুই তারই লোক। তোর মনিবকেও বলিস, আর তুই শুনে রাখ, তোদের হাতে মরব। তবু সই করব না।
হুঁ সহজ পথে তুমি তাহলে এগুতে রাজী নও! বেশ, তবে সেই ব্যবস্থাই হবে। গুপী তিন দিন ওকে কিছু খেতে দিবি না। এক ফোটা জল পর্যন্ত নয়। থাক উপবাস দিয়ে, দেখি ও তেজ কদিন থাকে!
ঘর থেকে বের হয়ে গেলে পিয়ারী।
গুপী একবার এগিয়ে এসে বললে, কেন মিথ্যে ঝামেলা করছি বামদেববাবু! ভালয় ভালয় রাজী যদি হয়ে যাও তো, আটকে কটা দিন তোমাকে রাখলেও দিব্যি রাজার হালে আরামে থাকবে। দলিলটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই ড্যাং ড্যাং করে নিয়ে চলে যাবে।
বামদেব গুপীর কথায় কোন সাড়াই দেন না।
কেবল মনে মনে ভাবতে থাকেন, কিরাটীর পরামর্শে বহরমপুরে এসে তিনি কি ফ্যাসাদেই না পড়লেন!। এতদিনকার জানাশোনা কিরীটী-বন্ধু কিরীটী যে তাকে এই বিপদের মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে দিব্যি কলকাতায় বসে রইল, দু’একদিনের মধ্যেই আসবে বলেছিল-নন্দিন আজ হয়ে গেল, হয়তো বেমালুম সব ভুলেই বসে আছে! বামদেবকে যে ঠেলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে হয়তো মনেই নেই তার!
শয়তানের পাল্লায় পড়েছেন, সহজে এদের হাত থেকে নিস্কৃতি মিলবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। কত দুর্ভোগ আছে বরাতে কে জানে!
বিনয় আর সুজাতা তারাই বা কি করবে! জানতেও পারবে না তারা কাল সকালের আগে যে, শত্ৰু হাতে তিনি বন্দী হয়েছেন!
আর জানলেই বা এই শয়তানদের হাত থেকে রক্ষা করবে। কেমন করে তারা তাঁকে!
ভোরের আলো একটু একটু করে আকাশপটে দেখা দেয়। সুজাতাকে সাস্তুনা দিয়ে কিরীটী বলে, বামদেববাবু শত্রুর হাতে পড়লেও চিন্তা করবার কিছু নেই। কারণ আমার ধারণা চট্ করে প্রাণে মারবে না তাঁকে তারা।
প্রাণে মারবে না কি করে আপনি নিশ্চিত জানলেন কিরীটীবাবু?
কারণ এ তো বোঝাই যাচ্ছে, এই রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারেই তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোন জায়গায় গুম করেছে। সেক্ষেত্রে তাকে প্রাণে মেরে ফেললে তো কোন সুবিধাই হবে না তাদের। তাহলে তো যেজন্য নিয়ে যাওয়া সেটাই ভেস্তে গেল।
সুজাতা না বুঝতে পারলেও বিনয় কিরীটীর কথার যুক্তিটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। এও বুঝেছে সে, এই বিপদে অস্থির হয়ে হা-হুতাশ করলেও কোন ফল হবে না। যা করবার ধীরেসুস্থে করতে হবে।
সত্যি, তুমি ব্যস্ত হয়ো না সুজাতা। কিরীটীবাবু যখন এসে পড়েছেন, মেসোমশাইকে যেমন করে হোক উদ্ধার আমরা করবই।
বিনয়ের আশ্বাস পেয়ে সুজাতা নিশ্চিন্ত না হলেও চুপ করে থাকে।
কিরীটী বিনয়কে সম্বোধন করে এবারে বলে, আমাদের সময় নষ্ট করলে চলবে না বিনয়বাবু। চলুন সবার আগে শ্ৰীমান মনোহরের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক তার কাছ থেকে কিছু বের করা যায় কিনা।
দুজনে আবার নীচে গেল।
কিন্তু ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল ঘর শূন্য। ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
আশ্চর্য! মনোহর গেল কোথায়?
খোঁজ করতে দেখা গেল, ঘরের জানালার একটা শিকা আলগা। সেই শিকটা তুলেই ইতিমধ্যে মনোহর পালিয়েছে তাহলে।
কিরীটী কিন্তু মনোহরের পলায়নের ব্যাপারে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হল না। সে বিনয়কে বললে, বিনয়বাবু, আপনি এখান থেকে কোথাও যাবেন না। আমি থানা থেকে এখুনি একবার ঘুরে আসছি।
থানায় গিয়ে কিরীটী দখল মৃত্যুঞ্জয় বসে আছে তারই অপেক্ষায়।
কি খবর মৃত্যুঞ্জয়?
পিয়ারীকে follow করছিলাম। শহর থেকে মাইল দুই দূরে গঙ্গার ধারে যে আরামবাগ আছে সেই দিকে তাকে যেতে দেখেছি।
থানায় দারোগা রহমৎ সাহেবও সেখানে বসেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ের কথা শুনে তিনি বললেন সে কি! সে তো একটা পোড়ো বাড়ি। চারিদিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দিনের আলোতেও সেইখানে পা দিতে গা ছমছম করে, সাপে ভর্তি জায়গাটা।
কিন্তু রহমৎ সাহেবের কথায় কান না দিয়ে কিরীটী মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, কাল কতক্ষণ পর্যন্ত তার উপর তুমি চোখ রেখেছিলে মৃত্যুঞ্জয়?
বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময় তাকে আরামবাগের দিকে যেতে দেখি। ঘণ্টা দুয়েক তার ফেরবার প্রতীক্ষায় আমি ছিলাম। কিন্তু তাকে আর ফিরতে দেখিনি। তাতেই আমার মনে হয়, ঐখানেই কোথাও পিয়ারী আডডা নিয়েছে।
কিন্তু সেখানে তো মানুষ থাকতে পারে না কিরীটীবাবু! আবার রহমৎ সাহেব বললেন।
তা না থাকুক, কিন্তু স্থানটিতে সাধারণের যাতায়াত যেমন নেই তেমনি নিরাপদও বটে। মৃদু হেসে কিরাটী বলে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, এদিকে কাল মাঝরাতে রত্নমঞ্জিল থেকে রামদেববাবুকে কারা যেন লোপাট করে নিয়ে গিয়েছে, শুনেছেন?