পুরাতন লাল রংয়ের শালুতে বাঁধা একটা ছোট পুঁটলি।
প্রদীপের স্নান আলোর সামনে বসে কম্পিত হাতে বাণী পুঁটলিটা খুলে ফেলল।
পুঁটলিটা খুলতেই একটা ছোট চৌকো সাইজের কারুকার্য করা হাতীর দাঁতের তৈরী কৌটো বের হল। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থাকে বাণী।
ধীরে ধীরে কৌটোর ঢাকনিটা খুলতেই স্নান প্রদীপের আলোয় তার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রকাশিত হল সযত্নে তুলোর ওপরে রাখা একটি সুবর্ণকিঙ্কন।
সেকেলে জড়োয়া একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী কঙ্কনটি।
হাঙ্গরমুখী কঙ্কন। দু’পাশ হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে।
কঙ্কনের গায়ে যে সুক্ষ্ম ছিলার কাজ তাও দেখবার মত।
নারীমনের সহজাত কৌতূহলেই বাণী কঙ্কনটা একবার হাতে নিয়ে দেখে।
বাইরে একটা মৃদু পত্রমর্মর শোনা গেল।
চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কঙ্কনটি কৌটোয় ভরে পুঁটলির মধ্যে রেখে যথাস্থানে গিয়ে রেখে দিল।
সুবৰ্ণকিঙ্কন! লাল মলাটের নোটবই তার পিতামহ শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর রোজনামচা–ডায়েরী!
নিশ্চয়ই ঐ নোটবইয়ের মধ্যে তাহলে ঐ কঙ্কন সম্পর্কে কোন কথা আছে। কার ঐ কঙ্কন?
অদম্য কৌতূহলকে নিবৃত্ত করে রাখতে পারে না আর বাণী। ঘরের মেঝে থেকে ইট তুলে গর্তের মধ্যে যেখানে লাল মলাটের নোটবইটা লুকোনো থাকে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বাণী নোটবইটা বের করে আনলে।
প্রদীপের আলোয় বসে দ্রুত একটার পর একটা ডায়েরীর পাতা উল্টে যেতে লাগল।
হঠাৎ মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি আবদ্ধ হল।
মৃন্ময়ী জানে না যে ঐ সুবর্ণকিঙ্কনের কথা অনেকদিন আগেই আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শুনেছি। অনিলের জন্মের বছর দেড়েক আগে তিনি একদিন হঠাৎ সন্ধ্যেবেলায় বহিমহলে আমার ঘরে এসে হাজির হলেন। একথা সেকথার পর একসময় আমাকে বললেন, দেখ বাবা, তোমাকে আজ একটা কথা বলব। আমাদের পূর্বপুরুষদের কিছু সঞ্চিত হীরা জহরৎ ও বাদশাহী মোহর আছে। বাবা মৃত্যুর সময় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ঐ ধনরত্ন রত্নমঞ্জিলের ঐ নৈঋত কোণে যে শিংশপা বৃক্ষটি আছে, তার গোড়া থেকে পূব কোণে এক জায়গায় মাটির নীচে একটি শিলাখণ্ড প্রোথিত আছে, সেই শিলাখণ্ডের নীচে একটি ছোট লোহার সিন্দুকে সেই ধনরত্ন লুকানো আছে, সিন্দুকটির কোন চাবি নেই। সিন্দুকের ওপরে পাশাপাশি অনেকটা দুটি বলয়ের আকারে খাঁজ কাটা আছে। ঐ বলয়াকার খাঁজের মধ্যে দুটি কঙ্কন বসিয়ে চাপ দিলেই আপনা হতেই তখন সিন্দুকের ডালাটি নাকি খুলে যাবে। মীনুর হাতে যে দুটি সুবর্ণকিঙ্কন দেখেছ, যা তোমার শ্বাশুড়ি তাকে দিয়েছেন, একমাত্র ঐ দুটি কঙ্কনের সাহায্যেই খোলা যায়। অন্য কোন কঙ্কন দিয়েই সিন্দুক খোলা যাবে না। শরীর আমার ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। কবে আছি কবে নেই—তই তোমাকে এই গোপন তথ্যটি বলে গেলাম। যদিচ এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই একমাত্র অধিকার আছে। ঐ ধনরত্নে, তবু তোমাকে বলে রাখলাম এইজন্য যে আর তো পুত্র আমাদের হবে না, তোমরাই হবে সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী।
কথাটা শুনে আমি চুপ করেই রইলাম।
শ্বশুরমশাই একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, মীনুকেই আমি একথা বলে যেতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাকে বলিনি, কারণ সে আমার নিজের সন্তান হলেও সে অস্থির চপল ও উগ্র প্রকৃতির। বিলাসব্যসনই দেখেছি তার জীবনের একমাত্ৰ কাম্য। সে হয়তো ঐ ধনরত্নের লোভ সামাতে পারবে না। পূর্ব-পুরুষের নির্দেশ আছে, অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া নিতান্ত অভাব না হলে কোন মতেই যেন ঐ সঞ্চিত গুপ্তধনে না হাত দেওয়া হয়। তুমি নির্লোভ, নীতিপরায়ণ। তুমি সে লোভকে জয় করতে পারবে, তাই তোমাকে আরো বলে গেলাম।
এতক্ষণে বাণীর কাছে সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পিতার এই জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ে থাকার উদ্দেশ্য তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।
পিতা তার তাহলে সেই গুপ্ত ধনৈস্বর্যের লোভেই এখানে এসেছে, তাই সে দিবারাত্র জঙ্গলের মধ্যে এখানে ওখানে মাটি খোঁড়ে, জঙ্গল সাফ করে।
বাণী আবার ডায়েরী পাতা ওল্টাতে লাগল। আর এক পাতায় লেখা আছে :
মৃন্ময়ীকে স্পষ্টই আজ বলে দিয়েছি, বামদেবের ভাবী স্ত্রীই ঐ কঙ্কনের যখন একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তখন কঙ্কন তাকে এ বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে একটি ফিরত দিয়ে যেতেই হবে। মৃন্ময়ী শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছে।
২২. বামদেবের জ্ঞান ফিরে এল
শেষ রাত্রির দিকে বামদেবের জ্ঞান ফিরে এল।
প্রথমটায় তো বামদেব বুঝতেই পারেন না, এ তিনি কোথায়! চিন্তাশক্তি ধোঁয়াটে দুর্বল। কিন্তু ক্ৰমে ক্রমে যখন জ্ঞান স্পষ্ট হয়ে এল, দেখলেন হাত-পা বন্ধাবস্তায় জীৰ্ণ পুরাতন একটা ঘরের মধ্যে মাটিতে পড়ে আছেন।
অদূরে ঘরের কোণে একটা হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে।
কিছুই মনে পড়ে না, কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না-এ তিনি কোথায় এলেন। কেমন করেই বা এলেন। ছিলেন তো রত্নমঞ্জিলের নিজের ঘরে শয্যায় শুয়ে!
তবে এখানে এলেন কেমন করে, কখনই বা এলেন!
মচমচে একটা জুতোর শব্দ শোনা গেল। তারপরই ভেজানো দরজা ঠেলে দুজন ঘরে প্রবেশ করল। প্রথম ব্যক্তিকে দেখেই কিন্তু বামদেব চমকে উঠলেন। পরন্তু সকালে ঐ লোকটিই রত্নমঞ্জিল কেনবার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিল।
নামটাও মনে পড়ে—পিয়ারী!
দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কিন্তু চিনতে পারলেন না বামদেব। গুপীনাথকে তো বামদেব ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি, চিনবেন কি করে!