সেই রকম বলেই তো মনে হচ্ছে তোমার মুখে সব শুনে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝে উঠতে পারছ না কিরীটী, আমার স্ত্রীর আরো বহু টাকার স্বর্ণালঙ্কার আছে কিন্তু চোরের এই কঙ্কনটির ওপরেই কেবল নজর কেন?
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বলল, তাহলে তো কঙ্কন-রহস্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল বামদেব। আমার সব শুনে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই এই সুবর্ণ কঙ্কনের পশ্চাতে এমন কোন গোপন ইতিহাস আছে যেটা চোরকে বিশেষভাবে কঙ্কনটির প্রতিই লালায়িত করে তুলেছে।
আমার স্ত্রীও অবিশ্যি সেই কথাই বলছিল, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পুরাতন দিনের আর অবিশ্যি পিসেমশাই ব্যতীত কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু এমন কোন ইতিহাস ঐ কঙ্কনের সঙ্গে জড়িত থাকলে অন্ততঃ পিসেমশাইও কি সেকথা জানতেন না।
না জানতেও তো তিনি পারেন। সর্বদা তো তিনি বহির্বাটিতে জপতপ নিয়েই থাকতেন। শুনলাম?
হ্যাঁ। সংসারে থাকলেও কোনদিন তিনি সংসারী ছিলেন না।
আচ্ছা একটু আগে তুমি যে বলেছিলে, বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা তোমার বিক্রির কথাবার্তা হচ্ছে!
হ্যাঁ, ওই বাড়িটা অৰ্থাৎ ‘রত্নমঞ্জিলে’র বিক্রির কথাবার্তা চালাচ্ছি। একপ্রকার পাকাই হয়ে গিয়েছে বলা যায়, বায়না নেওয়া হয়েছে।
বাড়িটা অনেক দিনের না?
হ্যাঁ। আমাদের পূর্বপুরুষ নবাব সরকারের চাকরি করতেন। আসলে আমরা চট্ য্যে, অধিকারী আমাদের বংশের নবাব-প্রদত্ত খেতাব। নবাব সরকারে ঐ চাকরির সময়েই বহরমপুরে তিনি একখানা গৃহ নির্মাণ করেন, পরে পূর্ববঙ্গ হতে এসে পরবর্তী পুরুষ বসবাস করতে শুরু করেন এবং ক্রমে জমিদারীও ক্রয় করেন। তারপর একদিন আমার পিতৃদেব কলকাতায় এই বাড়ি করে চলে আসেন। এখানে এবং সেই হতে বহরমপুরের বাড়িটা প্রায় খালিই পড়ে ছিল কিন্তু বাড়িটার মাল-মশলা খুব ভাল থাকায় ও গঠনকৌশল সেকেলে এবং মজবুত থাকায় বাড়িটা পুরাতন হয়ে গেলেও এখনও অটুট আছে। বাড়িটা দেখতে অনেকটা পুরাতন কেল্লার মত গঙ্গার একেবারে ধারে এবং গঙ্গাও মজে গিয়েছে এবং বহুদিনের অব্যবহারে চারিপাশে এখন ঘন জঙ্গল হয়ে গিয়েছে।
বাড়িটা মানে তোমাদের ঐ রত্নমঞ্জিল কিনছে কে?
এক গুজরাটি ভদ্রলোকে। নাম রতনলাল রাণা।
লোকটার অবস্থা কেমন-নিশ্চয়ই ধনী?
তা তো নিশ্চয়ই!
তা হঠাৎ অমন জায়গায় একটা অতদিনকার পড়ে পুরনো বাড়ি কেনবার তাঁর সখ হল যে!
শুনেছি কাঁসার জিনিসপত্র তৈরির একটা ফ্যাক্টরী নাকি খুলবেন তিনি।
হুঁ—দাম? তাও আশাতীত।
কি রকম?
পঞ্চান্ন হাজার টাকা।
বল কি!
কিরীটীর মনের মধ্যে তখন বহরমপুরে গঙ্গার ধারে নবাবী আমলের এক পুরাতন কেল্লাবাড়ি রত্নমঞ্জিল ছায়াছবির মত আকার নেবার চেষ্টা করছে। নবাবী আমলের পুরাতন কেল্লা বাড়ি।
সামনে টেবিলের ওপর রক্ষিত টাইমপিসটা একঘেয়ে টিকটিক শব্দ জাগিয়ে চলেছে নিযুতি রাতের স্তব্ধতার সমুদ্রে।
পুলিসেই সংবাদ দেওয়ার আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কিরীটী ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে— পুলিস হয়ত বিশ্বাসই করবে না, কিন্তু চুপচাপ বসেও আর থাকতে পারলাম না—তাই তোমার শরণাগত হয়েছি। বামদেব আবার বললে।
কিরীটির মাথার মধ্যে তখনও রত্নমঞ্জিল ঘোরাফেরা করছে।
বহরমপুর! রত্নমঞ্জিল!
এখন তুমি কি পরামর্শ দাও কিরীটী?
একটু আমায় ভেবে দেখতে হবে। তবে প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, কাল সকালেই সর্বাগ্রে কোন ব্যাঙ্কে গিয়ে ঐ কঙ্কনটি তাদের সেফ কাস্টিডিতে তোমাকে রেখে আসতে হবে।
বেশ, তাই করব।
আচ্ছা আজ তাহলে আমি উঠি।
এস।
ভাল কথা, কত বায়না নিয়েছ, বলছিলে না বড়িটার জন্য?
নিয়েছি—দশ হাজার টাকা। কথা আছে সামনের মাসে দশ তারিখে বিক্রয়-কোবালা রেজিষ্ট্রি হবে।
০৩. কিরীটী বাড়ি ফিরছিল
মিঃ অধিকারীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে কিরীটী বাড়ি ফিরছিল। রাত বেশী নয়। কিন্তু শীতের রাত বলে এর মধ্যেই চারিদিক যেন নিযুতি হয়ে এসেছে। আর শীতও এবার যেন বেশ জাঁকিয়ে এসেছে শহরে। একেবারে হাড়কাঁপানো কনকনে।
যে ট্যাক্সীতে কিরীটী বামদেবের ওখানে গিয়ছিল, সেটা ছাড়েনি অত রাত্রে কোন ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না বলে। পাঞ্জাবী ড্রাইভার ট্যাক্সি চালাচ্ছিল। চলমান গাড়ির খোলা জানালা পথে শীতের রাত্রির কনকনে হাওয়া নাকে চোখে মুখে কিরীটির এসে ঝাপটা দিচ্ছে।
রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মধ্যে মধ্যে শুধু চোখে পড়ে কাচিৎ কখনো এক-আধটা পানের দোকান এখনও খোলা। তারই সামনে দেখা যায় এখনো দুচারজন শেষ খরিদ্দার। আর চোখে পড়ে এক-আধটা মিঠাঁইয়ের দোকান—তারাও একেবারে দরজা বন্ধ করার উদ্যোগ করছে।
দু-একটা ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ি পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে!
কিরীটির মাথার মধ্যে তখনও পাক খেয়ে ফিরছিল গঙ্গার ধারে একখানা নবাবী আমলের পুরাতন বাড়ি। বিক্রয়-কোবালা—যার এখনো রেজিষ্ট্রি হয়নি। কিন্তু বায়না হয়েছে দশ হাজার টাকা।
কে এক রাণা বাড়িটা কিছুদিন আগে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় বামদেবের কাছ হতে ক্রয় করে নেবে বলে বায়না দিয়েছে। কাঁসার বাসনের ফ্যাক্টরী খুলবে। কাসার বাসনপত্রের জন্য বহরমপুরের খাগড়া অঞ্চল অবশ্য বিখ্যাত। গুজরাটি ব্যবসায়ীর সেদিকটায় নজর পড়েছে। ব্যাপারটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে অত অধিক মূল্যে একটা পুরাতন আমলের বাড়ি ক্রিয় করেছে। যখন গুজরাটি ব্যবসায়ী, মিথ্যে সে নিশ্চয়ই অতগুলো টাকা ব্যয় করছে না।