হাঁটতে হাঁটতে যোগানন্দ বৌবাজার স্ট্রীট ধরে কিছুটা এণ্ডবার পর হঠাৎ বাঁয়ের একটা সরু অন্ধ গলির মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল।
মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়ে পড়ে।
রাত প্রায় পৌনে দশটায় দীর্ঘ অপেক্ষার পর যোগানন্দ আবার একসময় বের হয়ে এল।
আবার সে হেঁটেই চলল। মৃত্যুঞ্জয়ও তাকে অনুসরণ করে চলে।
হেঁটেই চলেছে যোগানন্দ।
স্পষ্ট বোঝা যায় লোকটি বেশ অন্যমনস্ক, কি যেন ভাবতে ভারতে চলেছে। রাত দশটা বাজাতে চলল। তবু কলকাতার রাস্তার জনপ্রবাহের এখনো যেন বিরাম নেই। শহরের কর্মব্যস্ততা তেমনি চলেছে যেন অব্যাহত। তবে বাসে ট্রামে ভিড়টা যেন কমে এসেছে।
দোকানপাট ক্রমে ক্ৰমে সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, একমাত্র খাবারের দোকান, পানসিগারেটের দোকান ও চায়ের রেস্তোরাঁগুলো ভিন্ন-বিশেষ করে শেষোক্ত জায়গায় খরিদ্দারের এখনো অভাব নেই।
মৃত্যুঞ্জয় লক্ষ্য করে—যোগানন্দ হেঁটে চলেছে। অন্যমনস্ক হয়ে এভিনু ধরে।
যোগানন্দ হেঁটে চলছিল। রানার ওখানেও আজ যোগানন্দ বিশেষ পান করেনি। সামান্য যা পান করেছিল তাতে শরীরটা একটু চনচন করে উঠেছিল বটে কিছুক্ষণের জন্য, তার চাইতে কিছুই হয়নি।
দুটো ডেরা যোগানন্দর। একটি কলেজ স্ট্রীটের উপরে সিটি হোটেলে তিনতলার নিভৃত একটি কক্ষ অন্যটি কালীঘাটে মহিম হালদার স্ট্রীটের উপর দোতলা একটা বাড়ি। আজকের রাতের মত যোগানন্দ আর কালীঘাটে ফিরবে না।
সিটি হোটেলের ঘরেই রাত কাটাবে ঠিক করেছিল ইতিমধ্যে মনে মনে। হোটেলে পেঁৗছে সোজা তিনতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুলে নিজের নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল যোগানন্দ।
দরজাটা ভিতর থেকে এঁটে দিল।
ঘরটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো।
একটি কাবার্ড, একটি ড্রেসিংটেবিল তার পাশে একটি আলনা।
এক পাশে একটি সিঙ্গল খাটে শয্যা বিছানো। একটি ছোট টেবিল ও একটি বেতের আরাম কেদারা।
জামাকাপড় খুলে ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করল যোগানন্দ।
স্নান করে একটা পায়জামা ও গেঞ্জি পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল।
ঘুমে দু চোখ জড়িয়ে আসছে।
আরাম-কেদারাটার উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝল যোগানন্দ।
মৃত্যুঞ্জয় তখন হোটেলের মালিক শশীকান্ত হাজরার সঙ্গে তার প্রাইভেট চেম্বারে বসে কথা বলছে।
মৃত্যুঞ্জয় পূর্বে কয়েকবার কিরীটীর সঙ্গে কাজ করেছে। এবং কিরাটীর সঙ্গে কাজ করে ভাবছে ঐ লোকটি সখের একজন গোয়েন্দা হলেও অদ্ভুত তার বিচার ও বিশ্লেষণশক্তি। কিরীটীর সঙ্গে কাজ করতে পারলে সে লাভবান হবে। তাই কিরীটীর নির্দেশ পেয়ে সে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল।
পরের দিন ঠিক বেলা নটায় পরমেশ্বর কিরীটীর সঙ্গে মেসে এসে দেখা করল।
লেক অঞ্চলে যে হঠাৎ-ধনী ও তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীর উন্ন্যাসিক এক অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে ও গত মহাযুদ্ধে কালোবাজারে ফেঁপে-ওঠা সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে উঠেছে—সেইখানেই একটা দোতলা ফ্ল্যাটের দুখানা ঘর নিয়ে পিয়ারী থাকে পরমেশ্বর বললে।
পরমেশ্বরের ট্যাক্সিতে চেপেই পিয়ারী ফিরে গিয়েছিল। এবং লেক অঞ্চলের সেই ফ্ল্যাটবাড়ির সামনেই তাকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে পরমেশ্বর।
ইতিমধ্যে খুব ভোরে ফোন মারফৎ কিরীটী যোগানন্দর সংবাদও মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে পেয়েছিল।
হোটেলের ম্যানেজার হাজরার কাছ থেকে যোগানন্দ সম্পর্কে মৃত্যুঞ্জয় যেটুকু সংবাদ সংগ্রহ করতে পেরেছিল সেটা যেমনি অস্পষ্ট তেমনি ধোঁয়াটে।
যোগানন্দের পুরো নাম যোগানন্দ রায়।
নিয়মিত ঠিক ভাড়া দিলেও দিনের বেলায় তো কোন দিনই নয়—রাতেও কখনো কখনো হাপ্তায় এক-আধ-দিন কটায় মাত্র সেই ঘরে।
ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। বিশেষ সজন বলেই মনে হয়।
কি করে, চাকরি না ব্যবসা তাও ম্যানেজার বলতে সক্ষম হয়নি। তবে অবস্থা বেশ সচ্ছল বলেই মনে হয়, বেশভুষা অত্যন্ত কেতাদুরস্ত ফিটফাট।
ভিজিটার্স কখনো কাউকে আসতে দেখা যায়নি। সঙ্গে করেও গত তিন-চার বছরে কাউকে কখনও তাকে কেউ আনতে দেখেনি।
লোকটা যে মদ্যপান করে সেটা হোটেলের চাকরের মুখেই শোনা।।
২০. কিরীটী এল লালবাজার
পরমেশ্বরকে বিদায় দিয়ে কিরীটী সোজা এল লালবাজার। এবং সুভায্যের ঘরে ঢুকল।
সুভাষ বললে, কিরাটী যে, কি ব্যাপার?
একটা কাজ করতে পারবে ভাই?
কি বল?
কি ব্যাপার বলা তো কিরীটী?
হরিদ্ধারে হরকি পিয়ারীর কাছে ভরদ্বাজ আশ্রমে শ্যামসুন্দর চক্রবতী নামে একজন সংসারত্যাগী ভদ্রলোক থাকেন। আমি শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর নামে একটা চিঠি দেব, তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বামদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষদের যতটা সম্ভব সংবাদ লোকটিকে সংগ্রহ করে আনতে হবে, আর জেনে আসতে হবে তিনি তাঁর পুত্র অনিল চক্রবর্তীর কোন সংবাদ রাখেন কিনা।
ব্যাপারটা খুলে বল ভাই। অতঃপর কিরীটী সংক্ষেপে রত্নমঞ্জিল ও সুবর্ণকিঙ্কন সম্পর্কে সমস্ত বললে সুভাষকে।
এবং পরিদিন কিরীটী বহরমপুর রওনা হয়।
অপমানে আক্ৰোশে ফুলতে ফুলতে পিয়ারী রত্নমঞ্জিল থেকে বের হয়ে এল।
বিনয়ের শেষের কথাগুলো তখনও যেন তাঁর সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফোটাছিল।
বামদেব যে তার প্রস্তাবে রাজী হবেন না পিয়ারী সেটা কিছটা পূর্বেই অনুমান করেছিল, তাই সে আরো দুজনকে সঙ্গে এনেছিল, তার বিশ্বস্ত ও বহু পাপানুষ্ঠানের সহচর গুপীনাথ ও ছট্টুলালকে।
গুপীনাথের তাঁবে ছিল কলকাতার একদল নিম্নশ্রেণীর জঘন্য প্রকৃতির গুন্ডা।