ভাটিয়া দত্ত-সাহার চেম্বারে ঢুকতে যাবে সুইংডোর ঠেলে, একজন ভদ্রলোক বের হয়ে এল মুখোমুখি হতেই বললে, রানা যে, কি খবর?
একটু কাজ আছে ভাই মুখুজ্জে।
ও।
রানা ভিতরে প্রবেশ করল এবং মুখুজ্জে চলে গেল।
তাহলে উনিই সেই স্বনামধন্য শেঠ রতনলাল রানা! কিরিটী মনে মনে ভাবে।
রত্নমঞ্জিল বায়না করেছে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় কিনবার জন্য ও-ই!
ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন দেখা যাচ্ছে—লোকটির দেখা পাওয়া গেল!
কিরীটী অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ছকে ফেলে।
কিরীটীর মনে পড়ল। হঠাৎ ভাবতে ভাবতে, গোপন নোটবুকে তার ঐ পিয়ারী নামটি অনেকদিন আগে থেকেই টোকা আছে।
ক্রমশ সবই মনে পড়ে।
লোকটা গতিবিধি যে কেবল অত্যন্ত সন্দেহজনক শুধু তাই নয়, বছর খানেক আগে একবার ও মাসছয়েক আগে আর একবার দুটো জটিল নোট জাল ও ওপিয়াম স্মাগলিংয়ের কেসের সঙ্গে ঐ নামটি বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িয়ে ছিল কিরীটীর মনে পড়ল।
কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও লোকটাকে ধরা ছোঁয়া যায়নি সে সময়।
তেলা মাছের মত হাতের মুঠোর মধ্যে এসেও প্রায় প্রমাণের অভাবে পিছলে গিয়েছিল যেন।
তখনই বুঝেছিল কিরীটী লোকটি যেমনি ধূর্ত, ক্ষিপ্র ও তেমনি শয়তান। অসংখ্য ডেরা আছে লোকটার।
কোথায়ও এক দিন, কোথায়ও দুদিন বা বড়জোর দিন চারেকের বেশী এক নাগাড়ে থাকে না কখনো।
সর্বত্র গতিবিধি।
কি করে কি ভাবে চলে তাও সঠিক জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।
তাতে করে আরো সন্দেহটা পিয়ারীর উপর ঘনীভূত হয়েছে কিরীটীর। এবং সেই থেকেই তীক্ষ্ণ নজর আছে পিয়ারীর উপর কিরীটিার। লোক-চরিত্র সম্পর্কে কিরীটীর যতটা জ্ঞান আছে, তাতে করে অন্তত এটুকু তার কাছে অস্পষ্ট নেই যে লোকটা গভীর জলের মাছ।
কিরীটী তাই রানার সঙ্গে পিয়ারীর ঘনিষ্ঠতা দেখে চমকে উঠেছিল।
পিয়ারী রানার সঙ্গে কেন? কতদিনের আলাপ ওদের আর কেনই বা ঐ ঘনিষ্ঠতা? এবং কোন সূত্রে আলাপ ওদের?
প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে রানা চেম্বার থেকে বের হয়ে এল।
কিরীটীও নিঃশব্দে অলক্ষ্যে রানাকে অনুসরণ করে।
রানা তার অফিসে পৌছে পিয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে গেল।
কিরীটী তখন গাড়ি থেকে নেমে পরমেশ্বরের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাকে বললে, পরমেশ্বর, তুমি একটু দূরে গিয়ে তোমার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা কর।
ঐ যে ড্যাঙা লোকটা দেখলে ও যদি এসে তোমার ট্যাক্সি ভাড়া করে তো তাকে পৌঁছে দেবে ও ঠিকানাটা ওর মনে রাখবে। আর তা যদি না হয় তো আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। মোট কথা আমার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয় ভালই, নচেৎ কাল সকালে আমার সঙ্গে সকাল নটার মধ্যে দেখা করবে।
পরমেশ্বর সম্মতি জানিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল।
আধঘণ্টা পরে প্রায় পিয়ারীকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়ে যেতে লক্ষ্য করলে কিরাটী। কিন্তু রানাকে বের হতে দেখল না।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন রানা বের হল না, কিরীটী রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে চলল।
মোড়ে এসে দেখল পরমেশ্বরের ট্যাক্সিটা সেখানে আশেপাশে কোথায়ও নেই।
খানিকটা আরও এগিয়ে গিয়ে হাত-ইশারায় একটা খালি ট্যাক্সি ডেকে কিরিটী উঠে বসল।
১৯. অজ্ঞাত ব্যক্তি লিখিত পত্র
রাত আটটা নাগাদ বামদেবের ওখান হতে টেলিফোনে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি লিখিত পত্রের কথা জানতে পারল কিরীটী।
বামদেবের সঙ্গে কথা শেষ করে কিরীটী সেফায় বসে একটা সিগার ধরাল।
নানা চিন্তা তার মাথার মধ্যে এসে ঘোরাফেরা করছে তখন।
হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় উঠে গিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে লালবাজারে কানেকশন চাইল।
ফোন ধরেছিল যে তাকে কিরীটী জিজ্ঞাসা করে মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ সি. আই. ডি অফিসার আছে কিনা দেখ তো!
মৃত্যুঞ্জয় নতুন সি. আই. ডি. তে ঢুকলেও ছেলেটি খুব চালাক, চটপটে ও কর্মঠ।
মৃত্যুঞ্জয় ওই সময় লালবাজারেই ছিল। সে এসে ফোন ধরে। কে? আমি মৃত্যুঞ্জয় কথা বলছি।
কে, মৃত্যুঞ্জয়?
হ্যাঁ। আপনি কে?
আমি কিরীটী রায়। শোন একটা জরুরী কাজ করতে পারবে মৃত্যুঞ্জয় এখুনি?
কি ব্যাপার বলুন তো?
সংক্ষেপে তখন রানার অফিসের ঠিকানা ও চেহারার একটা বৰ্ণনা দিয়ে সেখানে গিয়ে বাড়িটার উপরে ও সেখানে অন্য কেউ আসা-যাওয়া করে। কিনা তাদের ওপরে নজর রাখবার জন্য মৃত্যুঞ্জয়কে বলল কিরীটী!
মৃত্যুঞ্জয় সব শুনে বললে, আমি এখুনি যাচ্ছি।
মৃত্যুঞ্জয় নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছবার মিনিট কয়েক বাদেই লক্ষ্য করল, যোগানন্দকে রাণার আফিসে গিয়ে প্রবেশ করতে।
ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে পাড়াটা তখন বেশ নির্জন হয়ে গিয়েছে।
মৃত্যুঞ্জয় দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী একটা সরু গলিমত জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। স্থির সতর্ক দৃষ্টি তার থাকে রানার অফিস-বাড়িটার দিকে।
রানার গাড়িটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
রাত প্রায় সোয়া নটা নাগাদ যোগানন্দ বের হয়ে এল এবং সতর্ক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে শ্লথ মন্থর পদে হেঁটে চলল। এবং প্রায় যোগানন্দ হাত দশবারো এগুবার পরই রানা নেমে এসে গাড়িতে উঠল।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
মৃত্যুঞ্জয় তখন বেশ একটু দ্রুতপদেই এগিয়ে গেল রাস্তার মোড়ের দিকে। যোগানন্দ তখন বেশী দূর যায়নি, ফুটপাথ ধরে ধীরে শ্লথ গতিতে হেঁটে চলেছে।
মৃত্যুঞ্জয় অনুসরণ করে যোগানন্দকে একটা নির্দিষ্ট ব্যাবধান রেখে নিঃশব্দে।