কলকাতাতেও এবারে বাণী বাবাকে ঐ খাতাটা পড়তে ও সযত্নে আগলে বেড়াতে দেখেছে।
কৌতূহল হয়েছে খাতাটার মধ্যে কি আছে জানিবার জন্য, কিন্তু সুযোগ বা সুবিধা পায়নি কলকাতাতে।
এখানে আসবার পর একদিন দ্বিপ্রহরে বাপের অনুপস্থিতিতে চুরি করে গোপনে খাতাটার কিছু অংশ পড়েছে।
জীর্ণ লালচে পাতায় কার ফোন ডায়ারী লেখা আছে।
সাল তারিখ দিয়ে নিয়মিত ডায়ারী নয়। এলোমেলা অসংলগ্ন ভাবে লেখা ঠিক ডায়ারী নয়, যেন কতকটা আত্মজীবনী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর।
মার কাছেই শুনেছিল বাণী একদিন, তার পিতামহের নাম ছিল শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী।
এবং প্রথম হতেই তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ। সংসারের প্রতি তীর কোন আকৰ্ণ ছিল না। এবং দৈবচক্রে আকস্মিক দুর্ঘটনায় সে রাত্রে তার পিতামহী মৃন্ময়ী দেবী নিহত হন। সেই রাত্রেই তার পিতামহ শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, আর কোন সংবাদই পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি।
তিনি আজও জীবিত কি মৃত কেউ তা জানে না।
এবং পিতৃমাতৃহীন তার বাপ মানুষ হন তীর দিদিমার কাছে মামার বাড়িতেই।
অত্যন্ত আত্মভিমানী পুরুষ ছিলেন তাঁর বাপ। বছর কুড়ি বয়স যখন তাঁর, সেই সময় একদিন তার চেয়ে বয়সে ছোট মামার সঙ্গে কি কথায় রাগারাগি হওয়ায় সেই যে একবস্ত্ৰে মাতামহের গৃহ ছেড়ে চলে আসেন, আর ওমুখো এ জীবনে হননি।
একটা মফস্বল শহরে গিয়ে সেখানকার কলেজে পড়ে টিউশনি করে বি. এ. পাস করে কলকাতায় এসে এম. এ. পড়তে শুরু করেন। সেই সময়ই তার মাতামহের সঙ্গে ও তার মারি সঙ্গে আলাপ।
১৮. কিরীটী বহরমপুর যায়নি
কিরীটী বামদেবের সঙ্গে বহরমপুর যায়নি ইচ্ছা করেই। বহরমপুরের রত্নমঞ্জিল ও সুবৰ্ণকিঙ্গনকে কেন্দ্র করে যে একটা রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা কিরীটীর কাছে আর অজ্ঞাত ছিল না।
আগাগোড়া গত ক’দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না। সব কিছুর মূলে ঐ রত্নমঞ্জিল।
কঙ্কনটা চুরি করার চেষ্টা। রানার রত্নমঞ্জিলটা ক্রয় করবার বিশেষ আগ্রহ এবং অসম্ভব মূল্যে স্বীকৃত হয়ে বায়না দেওয়া, তারপর কোন এক অপরিচিতের পত্র মারফৎ সাবধান বাণী রত্নমঞ্চিল না বিক্রয় করবার জন্য—সব কিছু জড়িয়ে একটি রহস্যই যেন দানা বেঁধে উঠছিল সব কিছুর মধ্যে।
ঐ রত্নমঞ্জিল!
কিরীটী বুঝেছিল তাকে ঐ রহস্যের কিনারা করতে হলে ভেবেচিন্তে বুঝে অত্যন্ত সাবধানে মাটি বুঝে অতঃপর প্রতিটি পা ফেলে ফেলে এগুতে হবে।
এবং যতটা সম্ভব নিজেকে আড়ালে রেখে কাজ করতে হবে। যেন কোন মতেই কারো না সন্দেহ জাগে এতটুকু যে কিরীটী রত্নমঞ্জিলের ব্যপারে জড়িয়ে পড়েছে।
কিরীটী আড়াল থেকে কাজ করবে। একপ্রকার স্থির করেছিল, যেদিন বামদেবের ওখান থেকে নিমন্ত্রণ সেরে ফিরবার পথে সে অনুসৃত হয়েছিল।
তাই পরের দিন যখন তার বন্ধু অফিসারকে বলে। লালবাজার থেকে দত্ত অ্যাণ্ড সাহার অফিসে রানার সামনে একটা টোপ ফেলবার ব্যবস্থা করেছিল, নিজে তখন চুপ করে বসে থাকেনি।
কিছু পরেই সাধারণ এক ভাটিয়ার ছদ্মবেশ ধারণ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার উপরে এসে ভাবছে কোন পথে এখন অগ্রসর হওয়া যায়, হঠাৎ পাশ দিয়ে তার পরিচিত একটি ট্যাক্সিকে যেতে দেখে হাত-ইশারায় কিরীটী ট্যাক্সিটা থামাল।
ট্যাক্সি ট্রাইভার পরমেশ্বর কিরীটীর বিশেষ পরিচিত হলেও ছদ্মবেশধারী কিরীটীকে কিন্তু চিনতে পারে না প্রথমটায়।
ট্যাক্সিতে চেপে কিরীটী তাকে নির্দেশ দিতেই ট্যাক্সি ছুটল।
নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ট্যাক্সিটা থামিয়ে পরমেশ্বর ট্যাক্সির দরজা খুলে দিতে যেমন উদ্যত হয়েছে কিরীটী বাধা দিল, এখন নামব না, দরজা বন্ধ করে দাও পরমেশ্বর।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে ফিরে তাকায় পরমেশ্বর পশ্চাতে আরোহীর দিকে।
কি চিনতে পারছ না? কিরীটী বললে।
এতক্ষণে কিরীটীর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে পরমেশ্বর তাকে চিনতে পারে।
হেসে বলে, স্যার আপনি! ইস একদম চিনতে পারিনি স্যার!
সঙ্গে সঙ্গেই পরমেশ্বর বুঝতে পারে কোন গোপন তদন্তের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কারো গতিবিধির উপর নজর রাখবার জন্য কিরীটীর এই ছদ্মবেশে অভিসার।
পরমেশ্বর রাস্তার একধারে গাড়িটা পার্ক করে রাখে। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করে কিরীটী গাড়ি থেকে নামল। পরমেশ্বরকে অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের বড় বাড়িটার গেটের দিকে।
মাস্তবড় পাচতলা একটা বাড়ি। অসংখ্য অফিস সেই বাড়িটার ঘরে ঘরে। এবং তখনও সেখানে কর্মব্যস্ততার একটা চাঞ্চল্য।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় দত্ত অ্যান্ড সাহার চেম্বারের দিকে এগিয়ে চলে কিরীটী একসময়।
এবং চেম্বারের সুইং ডোরের অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষা করে।
প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে কিরীটী লক্ষ্য করে একজন হৃষ্টপুষ্ট ভাটিয়া লিফটে চেপে তিনতলায় এসে উঠল, সঙ্গে তার ঢ্যাঙামত একজন লোক, হাতে তার মার্কোভিচের একটা টিন ও ওষ্ঠে ধৃত সদ্য-জ্বালানো একটি সিগারেট।
আমার আর ভিতরে গিয়ে কি হবে শেঠ! ঢাঙা লোকটি ভাটিয়াকে বলে।
তাহলে তুমি গাড়িতেই গিয়ে অপেক্ষা কর পিয়ারী। দেখি শালা দত্ত আবার ডাকল কেন?
কিরীটির মনে হয় ঐ পিয়ারী লোকটা তার একেবারে অপরিচিত নয়।
তাই বসি গে। তুমি তাহলে কাজ সেরে এস। পিয়ারী নামধারী ঢাঙা লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।