ঠিক এমনি সময় পশ্চাৎ হতে পূর্ব নারীকণ্ঠ প্রতিবাদ জানল, না-টাকা দেবেন না।
নারী সবিতা। সবিতা যায়নি, গলির মাথাতেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে উভয়ের সব কথা শুনছিল।
সবিতা!
না—টাকা তুমি নিতে পারবে না।
আঃ আপনি আবার এর মধ্যে এলেন কেন? যোগানন্দ বাধা দেয়।
চলে এস তুমি। সবিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে যোগানন্দর কথার কোন জবাব না দিয়ে।
বেশ, চলুন আনিলবাবু আপনাদের বাড়িতেই যাওয়া যাক। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, রাস্তায় থাকা আর উচিত হবে না। হঠাৎ কোন লাল পাগড়ীর উদয় হয় তো আমাদের তিনজনের কাউকে সে বিশ্বাস করবে না!
তাই চল। অনিল বলে।
কি জানি কেন সবিতা আর কোন প্রতিবাদ জানায় না। তিনজনে এসে অন্ধকার বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।
১৬. হ্যারিকেনের ম্লান আলো
হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে যোগানন্দ যেন মুগ্ধ হয়ে যায়। যদিও নেশা।টা তখনও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চনচন করছে।
যোগানন্দ ঘরে ঢুকতেই সবিতা মদের গন্ধ পেয়ে একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু যোগানন্দর কথায় সেটা কেটে গেল।
দিদি! কেন যেন আপনাকে দিদি বলতেই ইচ্ছে করছে। আপনি নিশ্চয়ই মদের গন্ধ পেয়েছেন। মদ আমি খেয়েছি দিদি, অস্বীকার করব না। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন। আপনার সঙ্গে আজ রাত্রে দেখা হবে জানলে মদ নিশ্চয়ই আমি খেতাম না। তবে মদ খেলেও, জানবেন মাতলামি আমি করি না।
কি জানি কেন, সবিতারও প্রথম হতেই যোগানন্দকে ভাল লাগে। তার সমস্ত অনুভূতি যেন বলে, লোকটা আর যাই হোক শয়তান বা দুষ্ট প্রকৃতির নয়। তাই আলাপ জমতে দেরি হয় না। যোগানন্দ সহজেই দু’দণ্ডে সবিতার মনে একটি স্থায়ী আসন করে নয়।
সে রাত্রে আর যোগানন্দর বিদায় নেওয়া হয় না।
রাত্রি ভোর হলে চা খেয়ে সে বিদায় নেয়। এবং যাবার সময় সবিতার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলের হাতে সত্যিই শ’খানেক টাকা গুঁজে দিয়ে যায়।
কিন্তু যে উচ্ছৃঙ্খলতার বীজ অনিলের রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল সেই উচ্ছৃঙ্খলতার পথেই সেই একশত টাকা উবে যেতে পাঁচ দিনও লাগল না।
তারপর যে অভাব সেই অভাব।
আবার নেয় টাকা অনিল যোগানন্দর কাছ থেকে এবং আবার তা ফুরিয়ে যায় একদিনে। ঐভাবে দুতিনবার চলে।
উপন্যাসের কল্পিত এক কাহিনীর মতই যেন যোগানন্দর আবির্ভাব সবিতা ও অনিলের জীবনে।
সেবারে কিছু দিন পরে আবার যখন এক রাত্রে ঘটল যোগানন্দর আবির্ভাব, অনিল বাসায় ছিল না।
সবিতাই যোগানন্দকে বসতে বললে বসুন, এসেছেন যখন যাবেন কেন?
তা বসছি। কিন্তু ঐ সম্বোধন, আপনি আজ্ঞেটা ছাড়তে হবে। দিদি বলে যখন ডেকেছি সে দাবিটা এই অধম জনের রাখতে হবে এবং শুধু রাখাই নয়, সেই সঙ্গে বড় বোন ছোট ভাইকে যেমন তুমি বলে ডাকে তেমনি বলবে তুমি এবার থেকে।
সবিতা হেসে বলে, তাই হবে।
তাই হবে না, বলুন তুমি!
বেশ বলব।
আঃ সত্যি কি যে আনন্দ পেলাম দিদি। আর বুঝতে পারলাম ভগবান এখনো এই হতভাগ্যটাকে একবারে ভোলেননি।
বোস, চা করে আনি।
চা নিশ্চয়ই হবে, আপনার হাতের চা না খেয়ে নড়ছিই না। কিন্তু অনিলবাবুকে দেখছি না কোথায়ও, বেরিয়েছেন বুঝি?
সবিতা চুপ করে থাকে।
দিদি!
সে নেই।
নেই?
দশ দিন বাড়িতে আসেন না।
সে কি!
ও আর এমন কি! সবিতা হাসে।
তাই তো—তাহলে—যোগানন্দ বলে।
কি ভাই?
একা একা আছেন–
অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
তা যেন হল। কিন্তু আপনাদের চলছে কি করে? কিছু মনে করবেন না দিদি—
যেমন করে আগে চলছিল। দুটো টিউশনি করি। কিন্তু দুজন স্ত্রীলোক একা একা এই বাড়িতে ভয় করে না তো দিদি?
এমন সময় হঠাৎ অনিল ফিরে এল, হাতে একটা পোটলা।
এই যে যোগানন্দ! কতক্ষণ? অনিল প্রশ্ন করে।
এই কিছুক্ষণ। কিন্তু এ দশ দিন ডুব দিয়েছিলে কোথায়? যোগানন্দ বলে।
বর্ধমানে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনিল বললে।
হঠাৎ বর্ধমানে দেশের বাড়িতে? প্রশ্ন করে এবারে সবিতা।
হ্যাঁ, অনেক দিন যাইনি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম একবার। যা দেখলাম, বাড়িঘর অবশ্য ভেঙে গিয়েছে, কঁচা টিনের বাড়ি—একটা পাক ঘর ছিল, সেইটা কোনমতে টিকে আছে।
তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে সেখানে গিয়ে থাকলেই তো হয়! কিন্তু ঐ বাড়ির কথা তো কোন দিনও তুমি আমাকে বলনি? সবিতা বলে।
বলবার মত নয় বলেই বলিনি। সে যে এ বাড়ির থেকেও এক ডিগ্ৰী–
তা হোক, তবু তো নিজের ভিটে-পরের ভাঙা বাড়িতে ভাড়া টানার চাইতে নিজের পড়ো ভাঙা ভিটেও ঢের সুখের, ঢের সম্মানের। চল আমরা কালই সেখানে যাব।—
তাই যাও না অনিল—যোগানন্দ বলে।
ক্ষেপেছ তুমি যোগানন্দ! সেখানে কোথায় যাবে? কথাটা শুরুতেই চাপা দিয়ে দেয় অনিল।
কেন, একটা ঘর তো আছে বলছিলো! সবিতা বলে।
থাকাটাই তো কেবল সব নয়, সেখানকার ম্যালেরিয়া–
তা হোক–
না না, ওখানে যাওয়া হবে না। অনিল বলে ওঠে।
যোগানন্দ উঠে দাঁড়ায় ঐ সময়, অনিল তার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে যায় এবং যোগানন্দর কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নেয়।
যোগানন্দ টাকা দিতে গিয়ে এবারে বলে, এমনি করে বার বার পরের জমি থেকে মাটি কেটে এনে নিজের ঘরের গর্ত তো ভরাট করতে পারবে না। অনিল। যা হোক একটা কিছু করো না।
ঘাবড়াও মাৎ ভায়া! তোমার দেনা এবার বোধ হয়। শিগগিরি শোধ করে দিতে পারব আর সব অভাবও ঘুচিবে।
কি রকম?
দেখ না। অভাব বাধ হয় এবার সত্যিই ঘুচল!
ভাল। যোগানন্দ মৃদুকণ্ঠে বলে।
ভাল নয় হে, সত্যিই দেখো কেমন বরাতের চাকাটা ঘুরে যায়।