মায়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সে বাপের যথেচ্ছাচারিতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মন তার বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইত তার সহজ মনের রুচিবোধের সংঘাতে।
সবিতার জীবনে যোগানন্দের আবির্ভাবটা দৈব যোগাযোগ ছাড়া কিছুই নয়।
বাসায় ফিরতে যোগানন্দের প্রায়ই গভীর রাত হত।
বছর দেড়েক আগে এক শীতের রাত্রে যোগানন্দ পায়ে হেঁটে ফুটপাথ ধরে বাসায় ফিরছিল।
সেরাত্রে একটু বেশী মাত্রাতেই যোগানন্দ মদ্যপান করেছিল। সমস্ত শরীরটা তো হাল্কা বোধ করছিলই, মাথার মধ্যেও কেমন শূন্যতা বোধ করছিল।
শীতের মধ্যরাত্রি জনহীন রাস্তা। একটা কুকুর পর্যন্ত কোথাও জেগে নেই।
বৌবাজারের কাছাকাছি এসে একটা তিনতলা বাড়ির ঝুল-বারান্দার নিচে আধো আধো অন্ধকারের মধ্যে একটি পুরুষ ও একটি নারীকণ্ঠের কথাবার্তার কিয়দংশ তার কানে যেতেই আপনা হতেই যোগানন্দ থেমে গিয়েছিল।
নারীকণ্ঠে করুণ মিনতির সুর, রাগ করো না, ফিরে চল।
আঃ, কেন বিরক্ত করছ, সবিতা! একশবার তো বলছি, যাব না। এখানে এই ফুটপাতেই আমি শুয়ে থাকব। বিরক্তিপূর্ণ খনখনে পুরুষকণ্ঠ।
আর কতকাল এমনি করে আমাকে জ্বালাবে বলতে পার! এখনো কি বুঝতে পারিছ না, কোন সর্বনাশের পথে তুমি ছুটে চলেছ!
মেয়ে বড় হয়েছে এখন, সে-ই বা কি ভাববে বল তো! এইজন্যই কি তুমি সে রাত্রে বাবার আশ্রয় থেকে টেনে নিয়ে এসেছিলে?
যাও না–বাপের ঘরে ফিরে গেলেই তো পার। তোমার পায়ে তো আমি শিকল দিয়ে রাখিনি।
ফিরে যাবার মুখ কি তুমি রেখেছ?
কেন, পরপুরুষের সঙ্গে তো আর গৃহত্যাগ করেনি। তবে লজ্জাটা কিসের?
তা যদি তুমি বুঝতে—
থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাকটিং না করে বাসায় ফিরে যাও।
না, তোমাকে আমি না নিয়ে যাব না।
আহা, কি কথাই বললে! এঁদো অন্ধকার ঘর মানুষ সেখানে থাকে! তার চাইতে এই রাস্তা ঢের ভালো।
ঠিক হয়ে উপার্জন করবার চেষ্টা কর, দেখবে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। চেষ্টা করলেই তুমি সব পারবে। আবার তোমার সব হবে।
সে আর হয়না। এ শকুনির পাশা, দান আর ওল্টাবে না।
হবে–সব হবে, মনকে একটু শক্ত কর।
পুরুষকণ্ঠ একেবারে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
আবার অনুনয় শোনা যায়, চল!
যাও তুমি–আমি আসছি।
না, আমার সঙ্গে চল। আর বাইরে থেকে না। দেখছি না কি ঠান্ডা বাইরে!
যাও না তুমি, আসছি।
যোগানন্দ এতক্ষণ একটা দোকানের কোলাপসিবল গেটের পাশে নিজেকে একটু আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ দেখল। অতঃপর নারীমূর্তি পাশের একটা গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
যোগানন্দ এবার এগিয়ে গেল।
যোগানন্দের পায়ের জুতোর রবার সোল থাকায় তার জুতোর শব্দ শোনা যায়নি।
সে সোজা গিয়ে একেবারে উপবিষ্ট পুরুষটির সামনে দাঁড়াল, শুনছেন?
কে! চমকে উপবিষ্ট পুরুষটি উঠে দাঁড়ায়।
ভয় নেই। চোরডাকাত নই। একটু মদ্যপান করেছি বটে। তবে মাতাল হইনি—অতএব মাতালও নই।
তা এখানে কি চাও?
বিশেষ কিছু না। ঘটনাচক্ৰে হঠাৎ আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর আলাপটা আমি শুনে ফেলেছি।
শুনেছো তো বেশ করেছ। এখন এখান থেকে সরে পড় দেখি।
আহা চটছেন কেন, শুনুনই না। হঠাৎ সংসারের প্রতি আমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন কেন?
কে তুমি জানতে পারি? কি মতলব বল তো?
অধীনের নাম যোগানন্দ। আর মতলব সেটা এখনো ভেবেচিন্তে ঠিক করে উঠতে পারিনি। ধরুন-মনে হচ্ছে আপনার যদি কোন কাজে লাগতে পারি। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়?
রসিকতা করছ নাকি!
আদপেই না। কারণ ওটা আমার ধাতে আদপেই সয় না। কিন্তু সেকথা যাক। এইভাবে রাত্রে ঠাণ্ডার মধ্যে এই ফুটপাতে বসে থেকে লাভ কি! যান না ঘরে ফিরে।
না।
আরে বাবা রাগ করছেন কার ওপর বলুন তো? ঐ নিরীহ ভদ্রমহিলাটির ওপরে! বেচারী হয়তো এখনো আপনার আশাপথ চেয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। যান–বাড়ি যান–
খুব তো উপদেশ দিচ্ছ! জান বাড়ির অবস্থা?
সে কতকটা অনুমানই করে নিয়েছি না জানলেও সঠিক। অভাব অভিযোগ এই তো! আমি আপনাকে না হয় কিছু টাকা ধার দিচ্ছি—পরে সময়মত শোধ দিয়ে দেবেন।
তুমি! তুমি আমাকে টাকা ধাব দেবে?
বিস্ময়ের একটা সীমা আছে, অনিল বিস্ময়ে একেবারে বোবা বনে যায়। এমন কথা তো কেউ গল্প-কাহিনীতেও শোনেনি। একটা অচেনা অজানা লোক—
খুব আশ্চর্য লাগছে কথাটা শুনে, না? তা হবারই কথা। আমি নিজেও মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয়ে যে যাই না তা নয়। রাতের বেলার আমিটাকে দিনের বেলার আমিটাই চিনতে পারে না তা পরে তো—যাকগে সে কথা, আপাতত কত দিলে আপনার বর্তমান Crisis টা কাটিয়ে উঠতে পারেন বলুন তো! কি নাম?
আমার নাম অনিল–
অনিল অর্থাৎ বায়ু-বাতাস! তা বেশ নাম। হ্যা বলুন তাে অনিলবাবু, আপাতত, কত হলে চলে? তবে হ্যাঁ, একটা অসম্ভব চাইলেও আমি দেব না। ঠিক যতটুকু আপনার বর্তমান পরিচয়ে পাওয়া উচিত তাই দেব। কারণ ফুটো কলসীতে জল ঢালা মানেই অপব্যয়।
লোকটার কথাবার্তায় অনিল উত্তরোত্তর বিস্মিত হচ্ছিল। এবং কৌতুকও বোধ যে করছিল না তা নয়।
অনেক প্রকার লোকই জীবনে অনিল দেখেছে। কিন্তু এরকম লোক বড় একটা তার চোখে পড়েনি, যে অচেনা অজানা পথের একটা লোককে অযাচিতভাবে এমনি করে টাকা ধার দিতে পারে সেধে!
কি ভাবছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তা বিশ্বাস করাটাও একটু শক্ত বৈকি।
একশ টাকা দিতে পার?
নিশ্চয়ই। দাঁড়ান। যোগানন্দ পার্স বের করে।