কে রে সাবি? বলতে বলতে শশাঙ্কমোহন ঘরের মধ্যে এসে একেবারে সোজা আচমকা প্ৰবেশ করেন।
বাবা! একটা আর্ত শব্দ বের হয়ে আসে সবিতার কণ্ঠ হতে।
জামাই অনিলকে চিনতে শশাঙ্কমোহনের কষ্ট হয় না।
রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করেন, এ বাড়িতে তুমি কোন সাহসে আবার ঢুকেছ? স্কাউনড্রেল! এখুনি বের হয়ে যাও–
বাবা! আর্তকণ্ঠে ডেকে ওঠেন সবিতা।
না। চরিত্রহীন লম্পটের আমার বাড়িতে কোন প্রবেশাধিকার নেই। যাও বেরিয়ে যাও!
আপনার বাড়িতে থাকতে আমি আসিনি। আমি এসেছি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিল বলেন।
তোমার স্ত্রী! কে তোমার স্ত্রী? সবিতার তুমি কেউ নও। তোমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
সম্পর্ক আছে কি না আছে সেটা আপনার বিচারে সাব্যস্ত হবে না!
নিশ্চয়ই-একশ বার হবে। যাও বেরিয়ে যাও।
বেশ তো, সবিতারও যদি সেই মত হয়, নিশ্চয়ই বের হয়ে যাব।—সে-ই বলুক। সবিতা আবার কি বলবে! আমিই বলছি—
বলবার যদি কারো অধিকার থাকে তো একমাত্ৰ আছে সবিতারই। আপনি বলবার কে!
লজ্জা করছে না তোমার? নির্লজ্জ বেহায়া–
সবিতা!
সবিতা কিন্তু নিরুত্তর। পাথরের মতই যেন জমাট বেঁধে গিয়েছে। স্থির বোবা।
সবিতা তোমারও কি তাই মত? তাই যদি হয় তো বল, আমি চলে যাচ্ছি!
তবু সবিতার কোন সাড়া নেই।
বেশ তবে চললাম।
অনিল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই সবিতা ডাকলেন, দাঁড়াও আসছি। বাণী ঐ ঘরে ঘুমিয়ে আছে, তাকে নিয়ে আসি।
সবিতা! তীক্ষু কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন শশাঙ্কমোহন।
ক্ষমা করো বাবা, ওঁর অবাধ্য তো হতে পারব না—
সবিতা, তোর সঙ্গে যে নীচ জঘন্য ব্যবহার করেছে, তার পরেও—
কি করব বাবা, হিন্দুর মেয়ে-স্বামী তাদের যাই হোক না কেন স্ত্রীর তো তাকে ছাড়া অন্য পরিচয় নেই। তাছাড়া ওঁর ভুলকে যদি আমি ক্ষমা না করি, তবে উনি কোথায় দাঁড়াবেন? আমাকে যাবার অনুমতি দাও বাবা–
সবিতা, তুই কি ভুলে গেলি কি জঘন্য অপমান ঐ লোকটা তোকে করেছে, তবু তুই ওর সঙ্গে যাবি?
বাবা!
বেশ যা, কিন্তু এও জেনে যা আজ থেকে এ বাড়ির দরজাও তোর বন্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে জানব সবিতা বলে কোন মেয়ে আমার ছিল না।
আজ তুমি আমাকে হয়তো ক্ষমা করতে পারছ না। বাবা, কিন্তু একদিন যখন জানবে কতখানি নিরুপায় হয়েই আমাকে আজ তোমার অবাধ্য হয়ে তোমার মনে আঘাত দিয়ে যেতে হল সেদিন হয়তো আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে।
শশাঙ্কমোহন আর একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সবিতা চিত্ৰাপিতের মতই দাঁড়িয়েছিলেন।
অনিলও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
সমস্ত ব্যাপারটা যে হঠাৎ ঐভাবে ঘুরে যাবে। এ কথা তিনি আদপেই ভাবেননি। ঝোকের মাথায়ই তিনি সবিতাকে তার সঙ্গে চলে যাবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। নচেৎ সবিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কোন মতলবই ছিল না।
তিনি এত রাত্রে সবিতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তিনি এসেছিলেন সবিতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু টাকাকড়ি চেয়ে নিয়ে আপাততঃ চলে যাবেন মনে করে, কিন্তু ঘটনা দাঁড়িয়ে গেল অন্যরকম।
একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সবিতাই কথা বললেন, একটু দাঁড়াও, বাণীকে নিয়ে আসি।
বাণী!
হাঁ, আমাদের মেয়ে। একটু পরেই ঘুম হতে তুলে বাণীর হাত ধরে সবিতা এ ঘরে ফিরে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, চল।
তিনজনে সেই মধ্যরাত্রে জনহীন রাস্তার উপরে এসে দাঁড়ালেন।
১৫. শীতের রাত
শীতের রাত-নির্জন রাস্তা। শুধু রাস্তার দুধারে ইলেকট্রিকের আলোগুলো নিঃসঙ্গ রাতে যেন এক চোখ মেলে বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তিনজন হাঁটতে শুরু করে।
মেয়ে বাণী শুধায়, আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?
ঘুরিয়ে মেয়ের প্রশ্নের জবাবটা দেন সবিতা, বাবার সঙ্গে যাচ্ছি মা।
বাবা!
হ্যাঁ উনিই তোমার বাবা।
বাণী ঘুরে দাঁড়ায় অনিলের দিকে, সত্যি তুমি আমার বাবা!
হ্যাঁ, মা।
তবে তুমি এতদিন আসোনি কেন বাবা?
কাজ ছিল যে মা।
শেষ পর্যন্ত বৌবাজারের ঐ পুরাতন বাড়ির একতলায় এনে অনিল স্ত্রী ও কন্যাকে তুললেন।
ধনী পিতার একমাত্ৰ আদরিণী কন্যা। চিরদিন সুখৈশ্বর্যের মধ্যে পালিতা, তবু একটি কথা বলেননি। সবিতা। মুখ বুজে। সব কিছুকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
শুধু যে ঐ জঘন্য পারিপাশ্বিকের মধ্যেই এনে অনিল ফেলেছিলেন স্ত্রী ও কন্যাকে তাই নয়—সেই সঙ্গে চালিয়েছেন তার অত্যাচার।
এক এক করে সবিতার গায়ের সমস্ত সোনার গহনাগুলো বিক্রি করে সেগুলো নষ্ট করেছেন। এবং যতদিন সবিতার গায়ে গহনা ছিল দু বেলা আহার জুটেছে কিন্তু গহনা শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল চরম দারিদ্র্য ও অনাহার।
আর তখন থেকেই, মধ্যে মধ্যে অনিল বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত হতে লাগলেন। স্ত্রী ও কন্যার কোন খোজই রাখতেন না। অনন্যেপায় হয়ে সবিতা দু-চারটি টিউশনি যোগাড় করে কায়ক্লেশে নিজের ও মেয়ের জীবন চালাতে লাগলেন।
তাতেও বাদ সাধেন আনিল। মাঝে মাঝে ধূমকেতুর মত এসে আবির্ভূত হয়ে সবিতার সামান্য পুঁজি ও সম্বলের ওপরে রাহাজানি করে চলে যান।
নিজের জীবনের কথা ভেবে সবিতা মেয়েকে আর স্কুলে দেননি। বাড়িতে নিজেই লেখাপড়া শেখাতেন।
বাণী ক্ৰমে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে মা’র কষ্টটা দেখে সর্বদাই মা’র কাছাকাছি থাকত মাকে সুখী করবার জন্য। এবং তার বাপের প্রতি মারি যে ক্ষমা সেটা তাকে বরাবরই পীড়ন করত।
মা যে বাবার যথেচ্ছাচার সহ্য করে নির্বিবাদে শান্ত হয়ে, বাণীর মনে হত সেটাই তার বাপের উচ্ছৃঙ্খলতাকে যেন আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত মনের মধ্যে কোথাও এতটুকু জোর পেত না বাণী।