পিতার মৃত্যুর পর যোগানন্দ মামার বাড়িতে এসে ওঠে। কিন্তু দুদিনেই বুঝতে পারল সেখানে স্থান তো হবেই না এবং কোনরূপ সাহায্যও মিলবে না।
যোগানন্দ কলকাতায় চলে এল। হাতে সামান্য যা ছিল তারই উপরে নির্ভর করে একটা মেসবাড়িতে এসে উঠল। পনের টাকায় খাওয়া থাকা। সেই মেস বাড়িতেই আলাপ হয় যোগানন্দের শেয়ার মার্কেটের দালাল যতীন মিত্রের সঙ্গে। যতীন মিত্রের পরামর্শেই যোগানন্দ বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করল। মাস ছয়েক বাজারে ঘোরাফেরা করে শেয়ার সম্পর্কে বাজারদার ও তার ওঠানামা সম্পর্কে একটা মোটামুটি জ্ঞানলাভ করল এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই যোগানন্দ দালালী করে বেশ দু’ পয়সা উপার্জন করতে শুরু করে।
বছর দশেকের মধ্যে যোগানন্দ তার নিজের বিশিষ্ট আসনটি কায়েম করে নিল। যথেষ্ট অর্থাগম হতে লাগল। এবং অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিশেষ বস্তুর ওপরে তার আসক্তি জন্মাল। সুরা। কিন্তু সুরা তাকে ধ্বংস করতে পারেনি।
চা তৈরি করে সবিতা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন যোগানন্দের দিকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যোগানন্দ বলে, আচ্ছা দিদি, বলতে পারেন চা তো আপনি বিশেষ খান না। কিন্তু এমন চা তৈরী করেন। কি করে?
সবিতা যোগানন্দের কথায় হাসেন।
নেহাৎ কাজের ঝঞ্ঝাটে রোজ আসতে পারি না, নচেৎ ইচ্ছা করে রোজ এসে আপনার হাতের তৈরী চা খেয়ে যাই–
তা বেশ তো, এলেই তো হয়।
দাঁড়ান, এখন আপনাকে জোর করছি না বটে, সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর আপনাকে আমার বাড়িতে যে নিয়ে যাব। আর ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু রাত হল, এবারে আমাকে উঠতে হবে। বলতে বলতে যোগানন্দ উঠে দাঁড়াল।
হঠাৎ দরজার গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়ায়, তার পর পকেটে হাত দিয়ে কয়েকটা নোট বের করে বলে, টাকা আপনার নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গিয়েছে দিদি—এই টাকা কটা রাখুন।
না না, গত মাসে যে টাকা তুমি আমাকে দিয়েছিলে সেই টাকাই তো এখনও শেষ হয়নি!
বলেন কি দিদি! মাত্র তো একশটা টাকা দিয়েছিলাম। সে টাকা এখনো আছে মানে! খরচ আর কি, দুজন মাত্র তো লোক— আজকালকার দিনে একজনেরই খেতে তো একশ টাকা লাগে। নিন রাখুন টাকাটা—
না, ভাই। এখন থাক। প্রয়োজন হলে আমিই চেয়ে নেব তোমার কাছ থেকে।
সে আপনি যা চাইবেন তা আমার জানা আছে। নিন। ধরুন তো টাকাটা! যোগানন্দ টাকা কটা একপ্রকার জোর করেই সবিতা দেবীর হাতে গুজে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
অন্ধকার গলিপথটা অতিক্রম করে বড় রাস্তায় যখন এসে পড়ল। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। ট্রাম বাস প্রাইভেট কার ও জনপ্রবাহে আলো-ঝলকিত কলকাতা শহর তখনও প্রাণপ্রাচুর্যে ঝলমল করছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যোগানন্দ।
সবিতাদির স্বামী ও কন্যা বাণীকে খুঁজে বের করতেই হবে। যেমন করেই হোক তাদের খুঁজে বের করে সবিতাদিকে সুখী করতেই হবে। সবিতাদির মুখের দিকে যেন আর চাওয়া যায় না।
আশ্চর্য চরিত্র অনিলবাবুর!
সাবিতাদির মত স্ত্রী পেয়েও তিনি সংসার বেঁধে সুখী হতে পারলেন না। অথচ সাবিতাদির মত স্ত্রী সংসারে কজনের ভাগ্যে লাভ হয়! আর ওদের বিবাহটাও নাকি হয়েছিল পরস্পরে। পরস্পরকে ভালবেসে।
প্রফেসার বাপের শিক্ষিত মেয়ে, অনিলবাবু নিজেও উচ্চশিক্ষিত, তবু যে কেন সব এমনি হয়ে গেল!
সুখের সংসারই দুজনে পেতেছিলেন, মফস্বল শহরে এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপকের কাজ নিয়ে গিয়ে। দুটো বছর আনন্দেই কেটেছিল। তারপরই লাগল আগুন।
একটি ছাত্রীকে পড়াতেন, হঠাৎ একদিন সেই ছাত্রীকে নিয়ে হলেন পলাতক আনিলবাবু। সবিতাদি তখন পাঁচ মাস অন্তঃসত্ত্বা। ছোট মফস্বল শহরে একেবারে টি টি পড়ে গেল ব্যাপারটা নিয়ে।
লজায় অপমানে সবিতা পালিয়ে এলেন কলকাতায় বাপের কাছে। বাপ শশাঙ্কমোহন সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কেবল বললেন, যাক ভালই করেছিস। রাস্কেল! হাতের কাছে পেলে চাবুক মেরে পিঠের ছাল তুলে নিতাম। আজ থেকে জানবি তোর বিয়েই হয়নি।
কিন্তু বাবা, তার সন্তান যে আমার গর্ভে! দু হাতে মুখ ঢাকলেন সবিতা।
শশাঙ্কমোহন যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কথাটা শুনে!
তাঁর গলা দিয়ে কয়েকটা মুহূর্ত কোন শব্দই বের হয় না।
তারপর একসময় ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক আছে, ঐ তার সন্তান-যে আসছে তাকে নিয়েই তুই বেঁচে থাক। ঐ অপদার্থটার কথা ভুলে যা—ভুলে যা সব কথা।
যাই হোক, সবিতা পিতা শশাঙ্কমোহনের কাছেই থেকে গেলেন। ঐ একমাত্র মেয়ে শশাঙ্কমোহনের। স্ত্রীর আগেই মৃত্যু হয়েছিল। বড় আদরের মেয়ে। কন্যা বাণী জন্মাল।
দশ বছর অনিলের আর কোন সংবাদই পাওয়া গেল না। সবিতা নিজেও জেনেছিলেন আর হয়তো জীবনে কোনদিনই তার সন্ধান পাওয়া যাবে না।
এমন সময় হঠাৎ একদিন শীতের মধ্যরাত্রে প্রাচীর টপকে অনিল শশাঙ্কমোহনের বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন।
পরিচিত গৃহ।
স্ত্রীর শয়নকক্ষটা চিনে নিতে তার কষ্ট হয়নি। সবিতা একাই তাঁর ঘরে শুয়েছিলেন।
পাশের ঘরে দাদুর সঙ্গে ঘুমিয়েছিল বালিকা বাণী, অনিলের মেয়ে।
সবিতার গাতে হাত দিয়ে ঠেলে তুললেন অনিল তীকে ঘুম থেকে।
কে!
চুপ। চেঁচিও না—আমি অনিল।
তুমি। বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে গেছেন সবিতা।
হ্যাঁ, আমি। আমি আবার ফিরে এসেছি সবিতা।
তুমি ফিরে এসেছ!
ডায়বিটিসের রোগী শশাঙ্কমোহন। রাত্রে ভাল করে ঘুম হয় না।
তিনি যে ইতিমধ্যে পাশের ঘরে আলো জ্বলা ও চাপা কথাবার্তার আওয়াজে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুজনের একজনও তা টের পাননি।