কি?
ঐ কঙ্কন জোড়া তোমার মা যখন বলেছেন, ফিরিয়ে দেবে তুমি তাঁকে। তারপর এ বাড়ি থেকে আমরা বেরুব।
না না, তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। পারবো না-আমি তা পারবো না।
হঠাৎ এবার শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরটা যেন বদলে গেল। তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কঠিন কণ্ঠে বললেন, শোনা মৃন্ময়ী, এ বাড়ি ছেড়ে যদি সত্যিই যেতে চাও তুমি তো আমার কথা তোমাকে সর্বাগ্রে মানতে হবে
আমি—
শোন আরো একটা কথা-যদি আমার কথা তুমি না রাখ, তাহলে জানবে কালই এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাব-এই আমার শেষ কথা।
মৃন্ময়ী অতঃপর বলে ওঠে, না না—ও কথা বলো না। আমার অমঙ্গলের কথা আন্দীে আমি চিন্তা করিনি। আমি আমাদের একমাত্র সন্তান আনিলের কথা ভেবেই বলেছি। যদি ওর কোন অমঙ্গল হয়–
কি জানি কেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র পুত্রটিকে প্রাণের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন। মৃন্ময়ীর কথায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, তারপর আবার একসময় বললেন, বেশ তবে এক কাজ কর—একটা কঙ্কন তোমার হাতে থাক, অন্যটা খুলে মাকে দিয়ে এস।
আশ্চর্য! মৃন্ময়ী তার স্বামীর প্রস্তাবটিকে মুহূর্তকালের জন্য ভাবলেন, তারপরই রাজী হয়ে গেলেন।
ঠিক হল ঐদিনই সন্ধ্যার পর রাত্রে তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিয়ে।
যাবার পূর্বে শ্যামসুন্দরের ইচ্ছামত মৃন্ময়ী একখানি কঙ্কন তার মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন আর বললেন, অন্যটা তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ধারণ করবেন তার স্বামীর মঙ্গলের জন্য। শরৎশশী দেবী মেয়ের কথায় হ্যাঁ বা না কোন কথাই বললেন না। আর, কেবল হাত পেতে একখানা কঙ্কনীই মেয়ের কাছ থেকে নিলেন।
মৃন্ময়ী একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু তাঁর মাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না যে, সেই রাত্রে ওঁরা ঐ গৃহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
ঠিক ছিল রাত বারোটার পর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, চারদিক নিযুতি হয়ে গেলে শ্যামসুন্দর অন্দরে এসে তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে যাবেন।
নির্দিষ্ট সময়ে স্ত্রীকে ডাকতে এসে তাঁর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে শ্যামসুন্দর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে তাঁর বালক পুত্রটি একাকী শয্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহটা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। হাতে তাঁর কঙ্কনটি নেই। আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহের পাশে পড়ে আছে একটা খালি শিশি—তাতে লেখা বিষ। ঐ রাত্রেই শ্যামসুন্দর জমিদারবাড়ি ছেড়ে চলে যান এক বস্ত্ৰে।
তার পর? শ্যামসুন্দরের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি? কিরীটী শুধাল।
না।
মৃন্ময়ী তাহলে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন?
হুঁ।
কিন্তু এসব কথা তুমি জানলে কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।
পিসিমার এক বুড়ি ঝি ছিল, তারই মুখে সব কথা শোনা। সে পিসিমাকে বিষপান করতে দেখেনি বটে—তবে পিসেমশাইকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিল।
তারপর কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি?
না।
০২. বামদেব অধিকারী
একটু থেমে বামদেব আবার বলতে লাগলেন।
অনিলদা আমার পিতামহের কাছেই মানুষ হতে লাগল। দীর্ঘ ষোল বৎসর পরে পিসেমশাই আবার একদিন আমাদের ওখানে ফিরে এলেন, এখনো তিনি বেঁচে আছেন। পরে অবশ্য এ গল্প তাঁর মুখেও আমার শোনা।
এই পর্যন্ত বলে বামদেব অধিকারী চুপ করলেন।
কিরীটীও স্তব্ধ।
বাইরে নিযুতি রাত্রি।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আজ পর্যন্ত পিসিমার হাতের সেই কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেনই বা পিসিমা আত্মহত্যা করলেন আর কি করেই বা পিসিমার হাত হতে কঙ্কনটি চুরি হয়ে গেল—আজও সে রহস্য উদঘাটিত হল না। যা হোক, অপহৃত সে কঙ্কনটির কথা সকলে ভুলেই গিয়েছিল পিসিমার মৃত্যুর ব্যাপারের সঙ্গে সঙ্গে এবং এতদিন পর্যন্ত সে কঙ্কনটির কথা আর কারো মনেও পড়েনি। কিন্তু মাত্র মাসখানেক আগে আমাদের বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা বিক্রির কথাবার্তা শুরু হবার পর হতেই আমাদের কলকাতায় এই বাড়িতে ঘন ঘন চোরের উপদ্রব শুরু হলো-?
চোরের উপদ্রব? বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ এই গত মাসখানেক ধরে পাঁচ-সাতবার চোর এসেছে এই বাড়িতে এবং প্রত্যেক বারই আমার স্ত্রীর ঘরে। আমাদের কোন সন্তানসন্ততি নেই। একমাত্ৰ আছে আমাদের এক পালিতা পিতৃমাতৃহীন বন্ধু কন্যা সুজাতা। সুজাতা ও আমার স্ত্রী এক ঘরেই শোয়। কারবারের কাজে মধ্যে মধ্যে আমাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়। দেখেছি। আমি বাইরে গেলেই বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হয়। সাধারণত—
আচ্ছা একটা কথা! কিরীটী প্রশ্ন করে।
কি?
চোর এসেছে কিন্তু কিছু চুরি যায়নি?
সেটাই আশ্চর্য; চোর এসেছে বটে কিন্তু কিছুই চুরি যায়নি।
কি রকম?
তাই। প্রথমটায়। তাই ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি, পরে হঠাৎ একটা কথা মনে হয় ভাবতে ভাবতে—
কি?
চোর এসেছে বার বার আমার স্ত্রীর হাতের ঐ কঙ্কনটির লোভে।
বল কি। কিন্তু—
সেই কথাই বলছি। বামদেব বলতে লাগল, শেষবার চোর এসে প্রথমে আমার স্ত্রীর ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত থেকে কঙ্কনটি খুলে নেবার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থকাম হয়, তখন কঙ্কনটা আমার স্ত্রীর হাতসমেতই কেটে নিয়ে যাবার মতলবে ছিল বোধ হয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ধারাল অস্ত্রের কোপটা পাশের বালিশে পড়তেই স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। পরের দিনেই সকালবেলা আমি ফিরে আসি। প্রথমটায় আমরা ধারণাও করতে পারিনি যে চোরের লক্ষ্য ঐ কঙ্কনটির উপরেই। পরে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শেষবারের ঐ চেষ্টার পর অমঙ্গলের সম্ভবনা সত্ত্বেও আমার স্ত্রীর হাত হতে কঙ্কনটি খুলে বাধ্য হয়ে সিন্দুকে তুলে রাখি, কিন্তু তাতেও রেহাই নেই, গতরাত্রেও আবার চোর এসেছিল। এবং লোহার সিন্দুকটাই ভাঙবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জামান সিন্দুক খুলতে পারেনি। এতে আরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, চোরের লক্ষ্য ঐ হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনই। তোমার কি মনে হয় কিরীটী? বামদেব কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।