যোগানন্দর ডাকে কোনরূপ সাড়া না দিয়ে আবারও দরজার কড়াটা ধরে বার-দুই নাড়া দিল এবং এবারে সঙ্গে-সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল।
বয়স বোধ করি ত্রিশ-পয়ত্রিশ হবে, একটি মহিলা দরজা খুলে দিতে এসেছিলেন। পরিধানে সাধারণ কালোপাড় একটি মিলের শাড়ি, হাতে একগাছি করে শাঁখা। রোগাটে একহারা দেহের গড়ন। সিঁথিতে সিন্দুর ও কপালে একটি গোলাকার সিন্দুরের টিপা।
ভদ্রমহিলার চেহারা এমনিতে কুশ্ৰী নয়, কিন্তু দারিদ্র্য যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও শ্ৰীকে লেহন করে নিয়েছে। শুধু দারিদ্রই নয়, সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চোখে মুখে একটা ক্লান্তি! মহিলার হাতে একটি হ্যারিকেন বাতি ছিল। তিনি আগে আগে চললেন। যোগানন্দ তাকে অনুসরণ করে।
মহাবীর কোথায়? তাকে দেখছি না! যোগানন্দ প্রশ্ন করে।
বাজারে গিয়েছে। মহিলা জবাব দিলেন।
আর নারাণী?
নারাণী তো আজ চারদিন হল কাউকে না বলে চলে গিয়েছে কোথায়—
আমারই অন্যায় হয়েছে দিদি। কাজের ঝ ঞাটে কদিন এদিকে আসতে পারি নি। এক এক ঐ বাড়িতে মহাবীরকে নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার খুব কষ্ট হয়েছে!
না ভাই, কষ্ট আর কি–
ভয় করেনি?
ভয়! মহিলা মৃদু হাসলেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না, ভয় কি! সারাদিন ধরে টিনের ফ্যাক্টরীতে কাজ চলে—ঠং ঠেং শব্দ। বরং সন্ধ্যার পর ফ্যাক্টরী বন্ধ হলে একটু আরামই পাওয়া যায়। তাছাড়া মহাবীর তো আছেই।
ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে দুজনে একটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। বহু পুরাতন আমলের বাড়ির নিচের তলার ঘর। ছোট ছোট জানালা। অন্ধকার চাপা তাই আলো-বাতাসের অভাবে কেমন যেন! ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের বাহুল্যও তেমন নেই। একাধারে একটি চৌকির ওপরে সাধারণ একটি শয্যা বিছানো। আর এক কোণে একটি ছোট আকারের স্টীলের ট্যাঙ্ক।
একটি মাদুর পেতে দিয়ে মহিলা বললেন, বাস।
পরিধানে সুটি থাকায় কোনমতে কষ্টেসৃষ্টি পা গুটিয়েই যোগানন্দ মদুরের ওপরে বসে পড়ল।
এই দারিদ্র্যের মধ্যে তুমি আস—আমারই লজ্জা করে যোগেন!
ওকথা ভাবেন কেন দিদি? ভাই আসবে দিদির বাড়িতে, সেখানে দারিদ্র্য যদি কিছু থাকেই তাতে লজ্জার আবার কি! ওরকম ভাবলে কিন্তু আমার আর আসাই হবে না। কিন্তু মহাবীরটারও তো আচ্ছা আক্কেল! কতক্ষণ গিয়েছে?–
তা আধা ঘণ্টা তো হবেই—
এক আপনি বাড়িতে আছেন, সে খেয়ালও নেই নাকি?
না, ওর কোন দোষ নেই। ওর নিজের কি কাজ আছে, তাই বলে দিয়েছি। একেবারে কাজ সেরে আসতে।
মহাবীরকে বলেননি কেন দিদি একটা ঝি খুঁজে আনতে?
কি হবে! একা মানুষ কাজকর্মও বিশেষ কিছু নেই। আবার একটা ঝি দিয়ে কি হবে?
ঠিক সেজন্য নয় দিদি। মহাবীর পুরুষমানুষ, আর এক আপনি এখানে স্ত্রীলোক-অন্য একজন স্ত্রীলোকের থাকা খুবই প্রয়োজন।
চিরকাল তো এইভাবেই কাটিয়েছি বাণী আর আমি। তোমার দাদা কালেভদ্রে কখনও ক্কচিৎ। আসতেন—
দাদার আমলে যা হয়েছে হয়েছে—
কিন্তু থাক সেকথা। তাদের কোন সন্ধান পেলে?
না, এখনো কোন সন্ধানই পাইনি। তবে আপনি ভাববেন না, তারা ফিরে আসবেই। তারপর একটু থেমে বলে, চলুন না দিদি, আপনি আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন।
না ভাই, তা হয় না।
কেন হয় না? একা একা এখানে পড়ে থাকেন—মহাবীর তো এখানে রইলই, তারা ফিরে এলে মহাবীরই তো আমাদের সংবাদ দিতে পারে। আপনি আমার ওখানে থাকলে আমিও নিশ্চিত থাকতে পারি।
তুমি আমার জন্যে চিন্তা করো না ভাই।
বাইরের দরজার কড়া নড়ে উঠল।—মহাবীর ফিরে এল বোধ হয়! সবিতা বললেন।
আমি যচ্ছি, দরজা খুলে দিয়ে আসছি। যোগানন্দ ওঠবার চেষ্টা করে। কিন্তু মহিলা বাধা দেন, না না, অন্ধকারে তুমি পথ ঠিক করতে পারবে না। তুমি বসো, আমি দরজা খুলে দিয়ে আসছি। সবিতা অন্ধকারেই দ্রুতপদে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
একটু পরেই মহাবীরের জুতোর শব্দ দরজার বাইরে শোনা গেল।
তোমার বাবু এসেছেন মহাবীর! শোনা গেল মহিলার কণ্ঠস্বর।
মহাবীরের বয়স হয়েছে। পঞ্চাশের উর্ধ্বে। কিন্তু দেহের গঠন এখনও অটুট আছে।
১৪. মহাবীরের গলার শব্দ
মহাবীরের গলার শব্দ পেয়ে যোগানন্দ বাইরে এসে দাঁড়ায়, একলা মাইজীকে রেখে এতক্ষণ তুমি বাইরে ছিলে মহাবীর!
আমি তো যেতে চেয়েছিলাম না হুজুর। কিন্তু মাইজী বললেন—
নারায়ণী চলে গেছে। একটা ঝি তো খুঁজে আনতে পারতে মহাবীর!
আমি তো বলেছিলাম, মাইজী বারণ করলেন।
কালই একটা ঝি খুঁজে আনবে।
মহাবীর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে স্টেভ জ্বলিয়ে সবিতা চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছিলেন কেতলিতে।
ঘরে ঢুকে যোগানন্দ তাই দেখে বললে, এখন আবার চায়ের জল চাপালেন দিদি!
তা হোক, তুমি তো চা ভালবাস।
যোগানন্দ জানে, প্রতিবাদ জানালে দিদি মনে ব্যাথা পাবেন, তাই আর কোনরূপ প্রতিবাদ জানাল না।
জুতো খুলে হাঁটু মুড়ে আবার মাদুরের ওপরে বসল।
সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এই গৃহকোণটি সম্পর্কে যোগানন্দের কি যেন দুর্বলতা—তার উচ্ছৃঙ্খল নিয়মকানুনহীন জীবনের এই গৃহকোণটি যে কতখানি অধিকার করে আছে, ভাবতে গেলে নিজেরই তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। যেদিন হতে এই গৃহকোণটি সে চিনেছে, সেইদিন হতেই যেন সে এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছে এখানে। ভালবাসা, স্নেহমমতা কোনদিনই এসবের কোন স্থান ছিল না যোগানন্দের জীবনে। জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মাকে হারিয়েছিল। সতের বছর বয়সের সময় বোপকেও হারায়। এমন কিছু সঞ্চয় বাপ রেখে যাননি যোগানন্দের জন্য বা এমন কিছু শিক্ষাও দিয়ে যেতে পারেননি, যাতে করে সহজ স্বাভাবিক পথে জীবনটাকে যোগানন্দ কাটিয়ে দিতে পারত। অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল যোগানন্দের।