শুধু তাই নয়, রত্নমঞ্জিলের একটা ভগ্নাংশ যেটা গত ভূমিকম্পের সময় ধ্বসে গিয়েছিল, সেটাও ঐ জঙ্গলের মধ্যেই যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ভগ্ন দালান ও জঙ্গল দুটোতে মিলে জায়গাটা অগম্য ভয়াবহ করে রেখেছে। যত বিষধর সাপের আডিডা সেখানে এখন।
যাই হোক বার বার ব্যর্থ হলেও বিনয় দমল না। অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে এল। পরের দিন কলকাতায় গিয়ে। তারপর ঐ জঙ্গল ও ভগ্ন ধ্বংসাবশেষ দালানের আশেপাশে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেমন করে যে উপায়েই হোক সেই রাত্রের রহস্যময়ী নারীকে খুঁজে বের করতেই হবে।
সেই মজা জঙ্গলাকীর্ণ দিঘিটার আশেপাশেও কম ঘোরাঘুরি করেনি বিনয়। সেই দাড়িগোফ শোভিত মুখখানার দেখাও আর মেলেনি যেমন তেমনি মেলেনি সেই তেমনি দেখা রহস্যময়ীর।
এদিকে দিনসাতেক হয়ে গেল কিরীটী রায়ের দেখা মিলল না।
এমনি করে আরো দুটো দিন কেটে গেল।
সেদিন সকালে সবে দোতলার বারান্দায় চায়ের আডডাটা জমে উঠেছে, এমন সময় মনোহর এসে বললে কে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান কর্তবাবুর সঙ্গে। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন, ভদ্রলোক নাকি কলকাতা থেকে আসছেন।
বামদেব বিস্মিত হলেন। কলকাতা থেকে এত দূরে কে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল!
বললেন, যা, উপরেই পাঠিয়ে দে।
মনোহর চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।
আর কেউ নয়। আগন্তুক স্বয়ং পিয়ারী।
পরিধানে দামী মুগার সুট। মাথার চুল থেকে পায়ের দামী গ্লেসকীডের জুতোটি পর্যন্ত চকচকে ঝকঝকে পালিস করা হাতে মার্কোভিচের টিন।
মুখে একটা আলগোছে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট।
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে আপনিই-বোধ হয় মিঃ অধিকারী?
হ্যাঁ আপনি?
গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং! স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন বামদেব পিয়ারীকে, যদিচ তাকে চিনতে পারলেন না।
বামদেব যে পিয়ারীকে চিনতে পারবেন না সে তো জানা কথাই, কারণ ইতিপূর্বে কখনো তো তাকে তিনি দেখেননি।
বিনা আহ্বানেই একটা খালি চেয়ার টেনে বসতে বসতে পিয়ারী বললে, আমি আপনার পরিচিত নই। মিঃ অধিকারী, আপনি আমাকে তাই চিনতে পারছেন না।
না–
আমি আসছি। কলকাতা থেকে বিশেষ একটা কাজে আপনার কাছে। আমার নাম পিয়ারীলাল দেশমুখ। পিয়ারী বলেই লোকে আমায় জানে।
কিন্তু কাজটা কি বলুল তো?
এই রত্নমঞ্জিল আপনার কাছ থেকে আমি কিনতে চাই।
বামদেব সত্যিই এবারে চমকে উঠলেন।
আবার রত্নমঞ্চিলের নতুন ক্ৰেতা!
বিনয়ও বিস্মিত দৃষ্টি তুলে নতুন করে আবার পিয়ারীর দিকে তাকাল। আবার একজন ক্ৰেতা!
কিন্তু বাড়ি তো ইতিপূর্বেই বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে মিঃ পিয়ারী! বললেন বামদেব।
মৃদু হাসলে পিয়ারী।
বায়না নেওয়া হয়ে গেছে? তা যাক না!
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। বায়না আমন হয়ই। নাকচ করতে কতক্ষণ লাগবে মশাই!
বিনয়ও অবাক হয়েছে যেন কথাটা শুনে।
নাকচ করব?
হ্যাঁ, সব সংবাদই আমি নিয়ে এসেছি। পঞ্চান্ন হাজার টাকা দর হয়েছে তো। আশি হাজার টাকা দাম আপনাকে আমি দেব। ঐ সঙ্গে বায়নার টাকাও দেব। বলুন, isn’t a fair offer! বক্তব্যের শেষে বিশেষ করে ঐ শেষ কটি কথার ওপর জোর দিয়ে পিয়ারী বামদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের অর্ধনিঃশেষিত জ্বলন্ত সিগারেটটা তর্জনী মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে বারান্দার বাইরে নিক্ষেপ করে টিন হতে আর একটি সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করল।
বামদেব ভাবছিলেন, পঞ্চান্ন হাজার থেকে একেবারে আশি হাজার!
লোভনীয় টোপ বটে নিঃসন্দেহে।
ভেবে দেখুন। মিঃ অধিকারী, আপনি যদি আমার terms-এ agree করেন তো এখুনি বায়না, বাবদ ষাট হাজার আমি অগ্রিম দিতে প্রস্তুত। বলতে বলতে পিয়ারী আলতোভাবে ধীরে ধীরে মুখের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
টাকাটা যেন পিয়ারীর কাছে কিছুই নয়।
বামদেব নিশ্চুপ।
পিয়ারীই আবার কথা বলে, আমি অত্যন্ত সোজা এবং এক কথার মানুষ। বিজনেস যা করি। তার মধ্যেও গোলমাল রাখতে ভালবাসি না।
পার্শ্বে উপবিষ্ট বিনয় বুঝতে পেরেছিল বামদেবের কোথায় দ্বিধা হচ্ছে। লোভনীয় টাকার পরিমাণে শুধু বামদেব কেন, যে কোন মানুষের পক্ষেই এক্ষেত্রে লোভ সামলানো দুষ্কর।
বিশেষ করে এই জীর্ণ বাড়িটার—যার ন্যায্য দাম পচিশ-ত্রিশ হাজারের কখনই বেশী হতেই পারে না। সেক্ষেত্রে আশি হাজার টাকা একটা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির দাম আশি হাজার দিতে যে উদ্যত তার কাছ হতে এক লক্ষ টাকা পাওয়াও দুঃসাধ্য হবে না।
তাছাড়া আশি হাজার টাকা যখন বাড়িটার দাম উঠেছে, এর আসল মূল্যও নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশীই হবে। নচেৎ এই জীর্ণ একটা বাড়ির জন্য কোন পাগলও এত টাকা দিতে যেত না।
কিন্তু মিঃ পিয়ারী, তা তো হবার নয়! পরিষ্কার কণ্ঠে এবারে বিনয়ই জবাব দিল।
বিনয়ের কথা শুনে বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকাল পিয়ারী এবারে বিনয়ের মুখের দিকে।
আপনি?
আমার আত্মীয়। জবাব দিলেন বামদেব।
ওঃ, কিন্তু কেন সম্ভব নয় বলুন তো?
শুনলেন তো একটু আগেই মেসোমশাইয়ের কাছে, এ বাড়ি বিক্রয়ের জন্য বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে।
বললাম তো সে আর এমন একটা কঠিন ব্যাপার কি! ছেড়ে দিন না ব্যাপারটা আমার হাতেই, আমিই সব settle করে নেব। বাকি যা সামলাবার আমিই সামলাব।
না, তা আর হয় না মিঃ পিয়ারী। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, ক্ষমা করবেন। জবাব দিল আবার বিনয়ই।
অতঃপর পিয়ারী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ধুমপান করে।