তা যেন হল, কিন্তু মাঝখান থেকে ঐ বেটা দাড়ি কোথা থেকে এল। তাই তো ভাবছি।
চল না পিয়ারী, একবার বহরমপুর ঘুরে আসা যাক।
উঁহু। সেখানে গিয়ে ভিড় করে কোন লাভ হবে না। তার চাইতে আমি বলি কি, এ গোলমালে কাজ কি বাবা! দাও না বাড়িটা ছেড়ে।
ছেড়ে দেব! কভি না। বললাম তো জান কবুল, শেষ পর্যন্ত দেখব।
শোন রতনলাল, এসব ব্যাপারে জলের মত টাকা খরচ করতে হবে। পারবে? রাজী আছ?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িটা উদ্ধার করে যদি দেখা যায়, ওসব গুপ্তধন-টন স্রেফ সব ধাপ্পা, কিছুই নেই, তখন সে টাকার শোক সামলাতে পারবে তো বন্ধু!
মরদবাচ্চা আমি। টাকা বহু কামিয়েছি। জীবনে পিয়ারী—এক দু লাখ যদিই যায় তো পরোয়া করি না। মোদা কথা রত্নমঞ্জিল আমার চাই–
ঠিক?
ঠিক। রানা সজোরে টেবিলের উপরে একটা ঘুষি বসাল।
হুঁ, তাহলে শোন রানা। এসব ব্যাপারে টাকা তো খরচ করতেই হবে, কৌশলেরও দরকার, ওসব ছট্টুলালদের দ্বারা হবে না। আমি নিজে যাব বহরমপুর। সেখানে গিয়ে আগে সব ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে দেখি, তারপর—
কবে যাবে?
যত তাড়াতাড়ি পারি যাব। কিছু টাকা দাও।
টেবিলের টানা চাবি দিয়ে খুলে একমুঠো নোট বের করে পিয়ারীর সামনে রাখলে রানা। একান্ত নির্বিকারভাবেই পিয়ারী নোটগুলো নিয়ে পকেটে রাখল।
পিয়ারী রানার বহুদিনকার পরিচিত।
পিয়ারীর ক্ষমতার উপরেও রানার যথেষ্ট আস্থা আছে।
যুদ্ধের সময়ে ব্যবসার একটা অংশ যখন চোরাপথে বাঁকাভাবে চলছিল, সেই বাঁকাপথেই পিয়ারীর সঙ্গে আলাপ হয় রতনলাল রানার এবং সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।
পিয়ারীর পদবী কি এবং কোথায় তার দেশ, কি তার জাত, কি মাতৃভাষা—কেউ কোনদিন জানতে পারেনি।
উর্দু, হিন্দি, বাংলা ও ইংরাজী চার-চারটে ভাষায় পিয়ারী এত সহজভাবে কথাবার্তা চালাতে পারে যে ওর মধ্যে কোনটা তার মাতৃভাষা বোঝাই দুষ্কর।
অত্যন্ত ঢ্যাঙ, রোগ। পরিধানে কখনো থাকে দামী সুট। প্রত্যেকটা ক্রিজ তার স্পষ্ট। আবার কখনো থাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সেরওয়ানি অথবা ধূতি-পাঞ্জাবি ও তার উপরে জহরকেট। হাতে সর্বদা একটি মার্কোভিচের টিন ও সিগারেট-লাইটার।
কথাবার্তা বলে খুব কম। এমন একটা কঠিন গাম্ভীর্যের আবরণ দিয়ে সর্বদা নিজেকে আবৃত রাখে। যে আপনা হতেই তাকে যেন এড়িয়ে চলবার ইচ্ছা হয় সকলের।
পিয়ারী বা মিঃ পিয়ারী নামেই সে সর্বত্র পরিচিত।
পিয়ারীকে বিশ্বাস করবার রতনলালের কারণও ছিল, যেহেতু দু-তিনবার অত্যন্ত দুরূহ জটিল ব্যাপারে পিয়ারী তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।
তবে পিয়ারীর পলিসি হচ্ছে ফেল কড়ি মাখ তেল!
সেই পিয়ারী যখন স্বেচ্ছায় রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা নিজহাতে তুলে নিল, রতনলাল সত্যিই অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করল।
অর্থব্যয় হবে ঠিক, কিন্ত যাহোক একটা ফয়সালা পিয়ারী করে দেবেই শেষ পর্যন্ত একটা কিছু।
রতনলালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিয়ারী তার অফিস-কামরা হতে বের হয়ে এল। সিঁড়ির সামনে এসে তার সর্বোচ্চ ধাপের ওপরে দাঁড়িয়ে হাতের টিন থেকে একটা সিগারেট বের করল।
ওষ্ঠ্যপ্রান্তে সিগারেটটা চেপে ধরে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। লাইটারের সাহায্যে। তারপর ধীরমন্থর পদে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।
এতদিন রানার রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে ভাল করে থিতোয়নি।
রানার মুখে দু-চারবার শুনেছে মাত্র। অবশ্য রত্নমঞ্জিলের মোটামুটি ইতিহাস তার অজ্ঞাত না।
রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে এতদিন সে বেশী মাথা ঘামায়নি, কারণ ওই ব্যাপারে তার এতদিন ততটা ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু এবারে তাকে ভাবতেই হবে।
রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারে খণ্ড খণ্ড ভাবে এতদিন যা সে শুনেছে এখন সেগুলো সব একত্রে গ্রথিত করে অখণ্ডভাবে চিন্তা করবার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে। সে সব কিছু একত্রে দেখলে দাঁড়াচ্ছে, যে কোন কারণেই হোক। ঐ পুরনো বাড়ি রত্নমঞ্জিলের একটা সিক্রেট বা রহস্য আছে। এবং সেই কারণেই রতনলাল ছাড়াও রত্নমঞ্জিলের দ্বিতীয় খরিদ্দার মাথা তুলেছে।
এই দ্বিতীয় খরিদ্দারটি কে?
তবে এও ঠিক লোকটা যে সম্পদশালী তা বোঝাই যাচ্ছে, নচেৎ রানার সঙ্গে টেক্কা দেবার সাহস হত না। এই হচ্ছে প্রথম কথা।
দ্বিতীয়তঃ বামদেব অধিকারী হঠাৎ ব্যবহমপুরে গেলেন কেন?
তৃতীয়তঃ শ্ৰীমান দাড়িটি কে?
একটা দিন ও রাত পুরো নিজের মনে মনে চিন্তা করল। পিয়ারী এবং নিজের কার্যপদ্ধতিও ছকে ফেলল একটা।
অজগরের চোখের সম্মোহনে যেমন শিকার সামনের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, ঠিক তেমনি করেই ছট্টুলাল এগিয়ে গিয়ে মাটিতেই বসে পড়লো।
হাত বাড়িয়ে লোকটা ঘরের কোণে প্ৰজ্বলিত প্রদীপের শিখাটা একটু উসকে দিল।
আলোর তাতে করে বিশেষ উনিশ-বিশ হল বলে মনে হয় না, তবে প্রদীপের সেই আলোয় এবার ছট্টুলাল যেন নিজের অজ্ঞাতেই লোকটার মুখের দিকে তাকাল। অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লোকটার চেহারা।
মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ। বয়েস হলেও লোকটার শরীরের বঁধুনি যেন এখনও অটুটাই আছে। পরিধানে একটা লাল রংয়ের কাপড়। খালি গা। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা। দেহের সমস্ত পেশী এখনও সজাগ ও স্পষ্ট। লোকটা দৈর্ঘ্যে প্রায় ছ। ফুটের কাছাকাছি হবে। চওড়া বক্ষপট। উন্নত সুদৃঢ় স্কন্ধ। কিন্তু চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মত যেন ঝকঝকে করে জ্বলছে দু খণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গারের মত।