বিবাদ হলো কেন?
এই কঙ্কনের ব্যাপার নিয়েই। আমার পিতামহী শরৎশশীর পুত্র না থাকায় পিসিমার বিবাহের সময় কঙ্কন জোড়া কন্যাকেই যৌতুক দিয়েছিলেন। পরে পুত্র জন্ম নেওয়ায় একদিন পিতামহী কথাপ্রসঙ্গে মেয়েকে বলেছিলেন—মীনু, এ বংশের নিয়ম কঙ্কন জোড়া এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূই পাবে। তোর যখন বিবাহ হয় তখন খোকা জন্মায়নি বলে এবং আর পুত্র হবার কোন সম্ভাবনা নেই ভেবেই কঙ্কন জোড়া তোকে যৌতুক দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন সে কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হচ্ছে খোকারই স্ত্রী এই বাড়ির ভবিষ্যৎ বধু। উত্তরে পিসিমা বললেন, সে কি মা! যে বস্তু একবার আমার বিবাহের সময় যৌতুক দিয়েছ, এতদিন বাদে সেটা আর কেড়ে নেবে কোন যুক্তিতে? আমিই বা লোকের কাছে মুখ দেখাব কি করে আর তোমাদেরই কি লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না? মাতামহী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে পিসিমাকে বললেন, ভেবে দেখা তুই মীনু, সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দৈবনির্দেশ ছাড়া কিছুই নয়। নিয়মানুযায়ী ও কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এই বংশের বধু। মৃত্যুর সময় আমার শাশুড়ী এই প্রতিজ্ঞই আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি বলেছিলেন, নাকি ভয়ানক অমঙ্গল দেখা দেবে। আমি বরং তোকে ওর চাইতেও দামী ও সুন্দর এক জোড়া কঙ্কন গড়িয়ে দেবো মা, ও কঙ্কন জোড়া তুই ফেরত দে।
কিন্তু পিতামহীর কোন যুক্তিই পিসিমা মানতে চাইলেন না এবং রীতিমত চেঁচামেচি ও ঝগড়া করে কড়া কড়া কতকগুলো কথা শুনিয়ে দিয়ে মাকে পিসিমা ঘর ছেড়ে হন।হন। করে চলে গেলেন। এসব কথা আমার মা’র মুখেই পরবর্তী কালে শোনা। মা শুনেছিলেন তার শাশুড়ী আমার পিতামহীর কাছ থেকে।
তারপর?
পিসিমার ঐ ধরনের ব্যবহারে পিতামহী অত্যন্ত মনে ব্যথা পান এবং পিতামহ ও দুঃখিত হন।
হুঁ, থামকি কেন বল্।
যা হোক, শোনা যায়। অতঃপর নাকি পিসিমা তাঁর মা’র ঘর থেকে বের হয়ে সোজা একেবারে বাইরের মহলে তার স্বামীর কাছে গিয়ে হাজির হলেন।
পিসেমশায় ঐ সময় তার নির্জন অন্ধকার কক্ষের মধ্যে প্রদীপের আলোয় বসে কি একখানি পুঁথি অধ্যায়ন করছিলেন, আচমকা স্ত্রীকে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে মাখ তুলে তাকালেন।
এই মুহুর্তে আমি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে চাই। যেখানে হোক অন্য কোথাও আমায় নিয়ে চল। পিসিমা বললেন তার স্বামীকে।
কি হল হঠাৎ আবার? এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?
বিচলিত—উত্তেজিত হই কি সাধোঁ? তুমি যদি মানুষ হতে এতটুকু লজ্জা-সরমও যদি তোমার থাকত তো দুঃখ ছিল কি আমার!
কি হয়েছে শুনিই না। হাসতে হাসতে পিসেমশাই শুধান।
আমি এখানে এ বাড়িতে আর এক মুহুৰ্তও থাকব না।
কেন হল কি? হবে। আবার কি—বিবাহের পর স্ত্রীলোকের একমাত্র স্থান তার স্বামীর গৃহে তা সে পর্ণকুটিরই হোক বা গাছতলাই হোক। আমায় নিয়ে চল—
তুমি তো জান মৃন্ময়ী, আমি সহায়-সম্বলহীন, নিজের বলতে আমার একটি কুঁড়েঘরও নেই। করুণ কণ্ঠে পিসেমশাই বলেন।
তা জানি না, বিবাহ করেছি। স্ত্রীকে ভাতকাপড় মাথা গোঁজবার ঠাঁই দিতে পার না–পুরুষমানুষ হয়ে কথাটা বলতে লজ্জা করল না।
পুরুষমানুষ হলে হয়ত লজ্জা করত, কিন্তু আমি যে ঘরজামাই। পুরুষ হলে কি ঘরজামাই হতাম! করুণ হেসে জবাব দেন তিনি।
কোন কথা শুনতে চাই না, এই মুহুর্তে তুমি আমাকে অন্য কোথায়ও নিয়ে যাবে কিনা বল। নচেৎ তোমার সামনেই আমি গলায় দড়ি দেব।
তা না হয় হল, কিন্তু ব্যাপার কি তাও বলবে না?
নেহাৎ অনিচ্ছার সঙ্গেই স্বামীর পীড়াপীড়িতে মৃগীয় দেবী তখন সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে পিসেমশাইয়ের গোচরীভূত করলেন। সমস্ত শুনে পিসেমশাই বললেন—মিথ্যে তুমি রাগ করছো মৃন্ময়ী। তোমাকে নিয়ে অন্যত্র কোথায়ও আজই যাব, কিন্তু কঙ্কন জোড়া এখান হতে চলে যাবার পূর্বে তোমায় ফেরত দিয়ে যেতে হবে। অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা তার কণ্ঠে প্রকাশ পেল।
না, আমি ফেরত দেব না। একবার যা দান করেছে, তার ওপরে আর ওদের কোন অধিকার নেই। প্রতিবাদ জানালেন পিসিমা।
উঁহু, ফেরত তোমাকে দিতে হবেই। পিসেমশাইয়ের চিরদিন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে যেন একটা বজের আভাস পাওয়া গেল।
না–দেবো না। কারণ আমি জানি এ কঙ্কন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক অমঙ্গল আমাকেই ঘিরে ধরবে। আমি ঠাকুরমার মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, সন্ন্যাসীপ্রদত্ত আশীবাদী এই কঙ্কন জোড়া। কোন এক সন্ন্যাসীর পরামর্শেই নাকি এই হীরকখচিত কঙ্কন জোড়া গড়িয়ে সন্ন্যাসীর মন্ত্রপূত আশীৰ্বাদসহ এই বংশেরই কোন পূর্বপুরুষ তার স্ত্রীর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই হতেই কঙ্কন জোড়া এ বাড়ির জ্যেষ্ঠ বন্ধুর হাতে থাকে এবং সন্ন্যাসী নাকি বলে গিয়েছিলেন-যতদিন এই কঙ্কন কোন নারীর হাতে থাকবে ততদিন তাকে কোনদিন বৈধব্য স্পর্শও করতে পারবে না, এমন কি কোন অমঙ্গলই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এবং একমাত্র মৃত্যু ভিন্ন এ কঙ্কন একবার হাতে পরে খুলে ফেললেও মহা। সর্বনাশ হবে।
পিসেমশাই নাকি অতঃপর শান্তকণ্ঠে পিসিমাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, শোনা মৃন্ময়ী, তোমার কথা হয়ত মিথ্যা নয়, কিন্তু সবটাই তো তোমার শোনা কথা—
না না-শোনা কথা নয়! পিসিমা বলেন।
তা ছাড়া কি? বংশপরম্পরায় ঐ কাহিনী মুখে মুখে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া একটা কথা কি জান, ভাগ্যে যা লেখা আছে তা কেউ জানতে কি আজ পর্যন্ত পেরেছে, না পারে? শোন আমি যা বলি, তুমি এখানে থাকতে চাও না। আর একটা মুহুৰ্তও বেশ-এখানে থেকে নিয়ে তোমাকে আমি যাব। কিন্তু তার আগে যা বললাম তা তোমায় করতে হবে–