মন স্থির করে ফেলে বিনয় এবার আর কালক্ষেপ করে না।
বালিশের তলা থেকে পাঁচ-সেলের হান্টিং টর্চটা হাতে নিয়ে গায়ে একটা শার্ট চড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল বিনয়।
নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে এল। নীচের সদর দরজাটা হ্যাঁ হ্যাঁ করছেখোলা, নজরে পড়ল তার। কোন কিছু ভাববার সময় আর নেই তখন। খোলা দরজাপথেই বের হয়ে গেল বিনয়। দ্রুতপায়ে ঘুরে বাড়ির পশ্চাতে বাগানে এল। অনুমানে যেদিকটা হতে অন্ধকারে লাল আলোটা ক্ষণপূর্বে দেখা গিয়েছিল সেই দিকেই অগ্রসর হল সন্তৰ্পণে।
বিশেষ সাবধানতার সঙ্গে মধ্যে মধ্যে হস্তধৃত টর্চের আলোর সাহায্যে এদিক-ওদিক খর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল বিনয়।
হঠাৎ মাটির আগাছার ওপরে একটা বস্তু ওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। একটি বর্ম চুরুটের জ্বলন্ত শেষাংশটুকু।
একটা সূক্ষ্ম ধোঁয়ার রেখা জ্বলন্ত চুরুটের প্রায়-ভস্মাবশেষ থেকে তখনও সর্পিল গতিতে একেবেঁকে উপরের দিকে উঠছে এবং আশেপাশে দগ্ধ চুরুটের একটা উগ্র কটু গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তখনো।
তাহলে এখানে ক্ষণপূর্বে নিশ্চয়ই কেউ ছিল। ঐ জ্বলন্ত চুরুটের শেষাংশটুকুই তার অবিসংবাদিত প্রমান। কেউ ছিল এখানে এবং যে ছিল সে চুরুট-সেবনে অভ্যস্ত।
পোড়া চুরুটের জ্বলন্ত শেষাংশ মাটিতে ঘষে নিভিয়ে পকেটে ভরে নিয়ে বিনয় আবার এগিয়ে চলে। কিন্ত আর কিছুই চোখে পড়ে না।
অন্ধকারে ঘুরতে ঘুরতে অন্যমনা হয়ে অবশেষে বিনয় একসময় একটা জায়গায় এসে পড়ে যার আশেপাশে বেশ গভীর জঙ্গল। খেয়াল হতে আর পথ চিনে উঠতে পারে না বিনয়। সর্বনাশ! এ কোথায় ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল সে? যেদিকে পা বাড়াতে যায় আগাছা ও কাঁটাঝোপে বাধা পড়ে। এগুতে পারে না। এত ঘন কাঁটাজঙ্গল যে তার মধ্যে দিয়ে পথ করে নেওয়াই দুঃসাধ্য। বুনো লতায় পা জড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ক্লেদাক্ত সরীসৃপের মত।
বিনয় যেন গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। এ কি ফ্যাসাদেই পড়ল সে!
এ কি গোলকধাঁধা? কোথায় নির্গমনের পথ? মাথা তুলে চারিদিকে তাকিয়ে রত্নমঞ্জিলেরও হদিস পায় না। ঘন আগাছা ও বুনো গাছপালায় দৃষ্টি ব্যাহত হয়।
হঠাৎ একটা সুমিষ্ট মেয়েলী হাসির খিলখিল শব্দে চমকে ওঠে। হাসির রেশটা অন্ধকারের বুকে একটা শব্দতরঙ্গ তুলে গেল যেন।
বিস্মিত হতচকিত বিনয় এদিক-ওদিক তাকায় অন্ধকার। কে? কে হাসলে আমন করে? কে?
আবার সেই মিষ্টি খিলখিল হাসির তরঙ্গ বয়ে গেল।
কে—কে হাসছ? চিৎকার করে বলে বিনয় যেন মরণীয়া হয়ে, কিন্তু চিৎকার করলেও শব্দটা যেন গলা দিয়ে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় না।
প্রত্যুত্তরে আবার সেই হাসি শোনা যায়।
কে? কে? আমি। মেয়েলী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল এবারে।
তুমি কে?
আমি রাত্রি।
রাত্ৰি!
হ্যাঁ, পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো?
বিনয়ের মনে হয় যেন খুব কাছ থেকেই কণ্ঠস্বর ভেসে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কিন্তু বিনয় কাউকে দেখতে পেলে না।
কোথায় তুমি?
কাছেই আছি। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তো! থাকুন। এখন বাকি রাতটুকু, পথ খুঁজে পাবেন না। মাথা খুঁড়ে মরলেও না।-কৌতুকে যেন উচ্ছসিত কণ্ঠ।
পথ খুঁজে পাব না! না। পথ জানলে তো পথ খুঁজে পাবেন। শুধু জঙ্গলই নয়, এটা হচ্ছে মা মনসার স্থান। ভীষণ সাপ ওই জায়গাটায়।
সাপ!
হ্যাঁ। আর বেশীক্ষণ পথ খুঁজতে হবে না, ওরা এলো বলে।
কারা?
কালসাপ সব। মা-মনসার চেলারা!
তুমিও তো আছে!
আমাকে ওরা চেনে, আমায় ছোবল দেবে না।
বিনয় অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মেয়েটির কণ্ঠস্বরও আর শোনা যায় না!
একসময় বিনয়ই আবার প্রশ্ন করে, আছ না চলে গেলে?
যাইনি, আছি। কিন্তু কেন বলুন তো? জবাব এল।
আমাকে একটু পথটা দেখিয়ে দাও না!
বা রে আব্দার! আমি পথ দেখাতে যাব কেন?
পথটা খুঁজে পাচ্ছি না যে
উঁহু। দেবো না।
দেবে না?
না ঠিক আছে, একটা শর্তে পথ দেখিয়ে দিতে পারি—
কি শর্তে?
রত্নমঞ্জিল ছেড়ে চলে যাবে বল! কথা দাও, তাহলেই পথ দেখিয়ে দেবো! রাজী আছ। আমার ঐ শর্তে?
না।
তবে থাকো। ভাবিছ দিনের বেলায় পথ খুঁজে পাবে! তা হচ্ছে না, তার আগেই তোমার মৃতদেহ রাণীদিঘির পাঁকের তলায় পুঁতে ফেলবে।
কে-কে পুঁতে ফেলবে?
কেন, দুর্বাসা মুনি!
দুর্বাসা মুনি? সে আবার কে?
এসে যখন ঘাড় টিপে ধরবে তখনই জানতে পারবে দুর্বস মুনি কে! তার চাইতে যাও না। কলকাতায় ফিরে। কেন মিথ্যে প্রাণ দেবে!
প্রাণের ভয় আমি করি না।
প্রাণের ভয় করো না!
না!
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কোন পক্ষেরই কোন সাড়া নেই। হঠাৎ আবার মেয়েটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে একেবারে পাশে, এস, আমার হাত ধর।
আশ্চর্য!
নারীমূর্তি। প্রসারিত হাত।
হাত ধর! গুণ্ঠনবতী নারী আবার আহ্বান জানাল।
সে যেন হঠাৎ মাটি খুঁড়ে উঠেছে একটা চকিত বিস্ময়ের মত।
চল। আর দেরি করো না, টের পেলে বিপদে পড়বে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত বিনয় হাতটি তার বাড়িয়ে দিল। একটি কোমল হাত তার মণিবন্ধ চেপে ধরল। স্পর্শ তো নয়, একটা পুলক-কোমল শিহরণ! রহস্যময়ী পথ-প্রদর্শিকার এই পথ যে অত্যন্ত সুপরিচিত, চলতে চলতে বিনয় খুব ভাল ভাবেই সেটা বুঝতে পারছিল।
ফণীমনসা ও কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে অন্যথায় এই অন্ধকারে অক্লেশে সহজ গতিতে ঐভাবে কারো পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
নিঃশব্দেই দুজনে অন্ধকারে কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছিল। এবং ঠিক ঐ মুহূর্তটিতে বিনয়ের সমস্ত মন জুড়ে একটিমাত্র স্পর্শের অনুভূতিই তার সমগ্র চেতনাকে যেন একটি মিষ্টি-স্নিগ্ধ সৌরভের মতই আমোদিত করে রেখেছিল, যে কোমল পেলাব মণিবন্ধটি সে পরম বিশ্বাসে ও আশ্বাসে নিবিড় করে ধরেছিল তারই স্পর্শটুকু।