কিন্তু তোমার এ যুক্তি মানতে পারছি না বিনয়!
ব্যস্ত হয়ে না। এতদিনের একটা বিশ্বাসী লোককে হঠাৎ সন্দেহ করে তাকে অবিশ্বাস করাটাই বরং যুক্তির ব্যাপার হবে না। তোমার বাবাকেও এ সম্পর্কে কিছু বলে না আপাতত।
দেখ একটা কথা বলি, লোকটাকে আমার কেন যেন প্রথম থেকেই ভাল লাগেনি—
বিনয় হেসে সান্তুনা দেয়। ভয় নেই, আমি সতর্ক থাকব।
আহারাদির পর বিনয় নিজের নির্দিষ্ট ঘরে শয্যার ওপরে এসে যখন গা ঢেলে দিল, চিন্তার ঘূর্ণাবর্তটা মন থেকে সরে গেল না, অবিশ্রাম পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে লাগল চিন্তাটা।
অন্ধকার রাত্রি। চাঁদ উঠবে সেই রাতের শেষ প্রহরে। শিয়রের ধারে খোলা জানালাপথে এক টুকরো স্বপ্নের মতো রাতের কালো আকাশের একটা খণ্ডাংশ ও কয়েকটি অনুজ্জ্বল তারা চোখে পড়ে।
নীচের বাগানের অন্ধকারের স্রোত পার হয়ে একটানা একটা বিবির শব্দ কানে আসছে। নিযুতি রাতের একতারা যেন বেজেই চলেছে ঝি বির রবে।
মনোহরের ব্যবহারটা বিনয়কে কেবল বিস্মিত করেনি ভাবিতও করে তুলেছে। সুজাতার সন্দেহ মিথ্যা নয়, সত্যিই মনোহর সিঁড়ির মাথায় অন্ধকারেও আত্মগোপন করে ওদের কথাবার্তা শোনবারই চেষ্টা করকছিল।
কিন্তু কেন?
এ-বাড়িতে অনেকদিনের লোক ঐ মনোহর। পাকানো বাঁশের মত পেটানো মজবুত শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকু খুঁত নেই নির্ভেজাল। বলতে গেলে বাড়ির মালিকের অনুপস্থিতিতে মনোহরই দীর্ঘদিন ধরে হয়ে ছিল এ-বাড়ির সর্বেসর্ব। বামদেব ক্কচিত কালেভদ্রে এখানে এলেও এ-বাড়ি সম্পর্কে এতকাল তার কোনই আগ্রহ ছিল না। পিতৃপুরুষের নবাবী আমলের পুরাতন এই ভাঙা বাড়িটার ওপরে তার কোনরূপ আকর্ষণই ছিল না। এবং এ-বাড়ি এইভাবেই হয়ত পড়ে থাকত, যদি আচমকা গুজরাটী ব্যবসাদার রানা এই বাড়ি কেনবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করত।
কিন্তু হঠাৎ রানাই বা এ-বাড়িটা কেনবার জন্য এত আগ্রাহন্বিত হয়ে উঠল। কেন?
খাগড়াই বাসনের ফ্যাক্টরি খুলবে স্রেফ একটা বাজে কথা। এ-বাড়ি কেনবার পিছনে আসল উদ্দেশ্য যে তার অন্য, সেটা বুঝতে বিনয়ের অন্তত কষ্ট হয়নি।
বাড়িটা সে কিনতে ইচ্ছুকই শুধু নয়, বিশেষভাবেই ইচ্ছুক। উদ্দেশ্যটাই বা কি?
বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয়ই। নচেৎ বাড়ির মূল্য বাবদ এই ভাঙা সেকেলে একটা বাড়ির পিছনে নিছক খেয়ালের বশে আজকালকার দিনে কেউই অতগুলো টাকা ঢালতে এগিয়ে আসবে না। বিশেষ করে রানার মত একজন ঝানু ব্যবসাদার। যারা প্রতি টাকার পিছনে অঙ্ক কষে লাভটা বুঝে চলে এবং শুধু রানাই নয়, আরো একজন খরিদ্দার এগিয়ে এসেছে বাড়িটার জন্য।
এতএব এর পশ্চাতে একটা যে রহস্য আছে সেটা বঝুতে কষ্ট হয় না।
সেদিন রাত্রে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলেও সেই রকমই মনে হয়েছে বিনয়ের।
১০. ঘুম একেবারে লোপ পেয়েছে
একটু তন্দ্ৰামতও যদি আসত! চোখের পাতা থেকে ঘুম যেন আজ একেবারে লোপ পেয়েছে।
সত্যি, আজ রাতে ঘুম আসবেই না নাকি! মাথার বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে হাতঘড়িটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। বিনয়।
অন্ধকারে রেডিয়াম ডায়ালের সময়-সঙ্কেতের অক্ষরগুলো জোনাকির আলোর মত জ্বলজ্বল করছে।
আশ্চর্য, রাত দশটা বেজে দশ মিনিট মাত্ৰ!
শয্যা হতে উঠে পড়ল বিনয়। চোখেমুখে একটু জল দিলে। যদি ঘুম আসে!
ঘরের কোণে মাটির সরাইয়ে ঠাণ্ডা জল ছিল, সেই জল হাতে ঢেলে বেশ করে চোখে মুখে ঘাড়ে ঝাপটা দিয়ে ভিজিয়ে দিল।
রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি যেন অনেকটা প্রশমিত হয়।
এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বিনয় শিয়রের ধারে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়ায়।
রাক্রির ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া সিক্ত চোখেমুখে একটা স্নিগ্ধ পরশ দেয়।
নীচের বাগানে অন্ধকারে গাছপালাগুলো এখানে ওখানে খণ্ড খণ্ড ভাবে যেন স্তুপ বেঁধে আছে।
অন্ধকার যেন জায়গায় জায়গায় একটু বেশী ঘন হয়ে উঠেছে। একটু বেশী স্পষ্ট।
এই বাগান অতিক্রম করেই নাটমন্দির এবং তার পশ্চাতে সেই মজা দিঘিটা।
অন্যমনস্ক বিনয় সিগারেটটায় মৃদু টান দিচ্ছিল, সামনের অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৰ্ষিত হয়। অনেক দূরে গাঢ় অন্ধকারের বুকে হঠাৎ একটা রক্তচক্ষুর মত লাল আলো দেখা যাচ্ছে যেন। আলোটা মাটি থেকে হাত-চার-পাঁচ উপরেই হবে বলে মনে হচ্ছে। বিস্মত বিনয় একদৃষ্টি লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ তার মনে হল, আলোটা এদিক ওদিক দুলছে না! হ্যাঁ, তাই তো। দুলছেই বটে। জমাট-বাঁধা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটা রক্তপদ্ম যেন ঢেউয়ে ঢউয়ে এদিক-ওদিক দুলছে। দু মিনিট সময় প্রায় লাল আলোটা শূন্যে অন্ধকারের মধ্যে এদিক-ওদিক দুলে দপ করে একসময় আবার নিভে গেল।
কয়েকটা মুহুর্ত বিনয় বোবা বিস্ময়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ইতিমধ্যে জ্বলন্ত সিগারেটটায় পুড়ে পুড়ে নিঃশেষিতপ্রায় হয়ে তর্জনী ও মধ্যমার বন্ধনীকে প্রায় স্পর্শ করে। তর্জনী ও মধ্যমায় একটা তাপ অনুভূত হয়।
হঠাৎ চমকে উঠে নিঃশেষিতপ্রায় দগ্ধ সিগারেটের শেষ জ্বলন্ত প্রান্তটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে ঘষে নিভিয়ে দিল বিনয়।
দূরে হলেও লাল আলোটা নীচের বাগানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকেই দেখা গিয়েছিল। দক্ষিণ প্রান্তে প্রাচীর। প্রায় একমানুষ সমান উঁচু প্রাচীর। আজই তো দ্বিপ্রহরে বিনয় ঘুরে ঘুরে দেখেছে ওখানে যাতায়াতের কোন পথ নেই।
শেষ সীমানায় প্রাচীর।