দূর থেকে রত্নমঞ্জিলের ‘কেয়ারটেকার’ মনোহরের যণ্ডাগুণ্ডা চেহারা দেখেই বুঝতে পারে, লোকটা বিশেষ সুবিধের হবে না।
ছট্টুলাল তার আস্তানা নিয়েছিল স্টেশনের কাছে একটা হোটেল।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার দিকে ঘুরতে ঘুরতে ছট্টুলাল রত্নমঞ্জিলের পশ্চাৎদিকে গিয়ে হাজির হল।
অন্ধকারে বাড়িটা একটাকালো ছায়ার স্তুপ যেন।
আচমকা কঁধের ওপরে কার মৃদু স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে তাকাল ছট্টু।
আবছা আলোছায়ায় দীর্ঘকায় একটা মূর্তি ঠিক তার পশ্চাতে দাঁড়িয়ে।
লোকটার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ।
কে তুই, এখানে কি চাস? গম্ভীর চাপাকণ্ঠে লোকটা প্রশ্ন করে।
লোকটার আচমকা আবির্ভাবে প্রথমে ছট্টু একটু হকচকিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সে সামলে নেয়।
রুক্ষকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়, তোর তাতে দরকার? তুই কে শুনি?
সহসা লোকটা তার ডান হাতের লৌহকঠিন বাঁকানো শীর্ণ আঙুলগুলো দিয়ে ছট্টুর কাঁধটা একটু টিপে দিতেই নিজের অজ্ঞাতেই ছট্টু একটা যন্ত্রণা-কাতর শব্দ করে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে আর তার বাকি থাকে না লোকটা দেহে প্রচুর শক্তি রাখে।
সোজা কথায় জবাব না দিস তো গলা টিপে শেষ করে দেবো।
এবার আর ছট্টু প্রতিবাদ জানাবার চেষ্ঠা করে না।
শক্ত ঠাঁই। এখানে চালাকি চলবে না বুঝতে পেরেছিল সে।
বল কাল থেকে এখানে কি মতলবে ঘোরাফেরা করছিস?
কি আবার মতলব! এমনিই দেখছিলাম বাড়িটা।
এমনি দেখছিলে চাদু! বেটা চালাকি করবার জয়গা পাওনি?
সত্যি বলছি দোস্ত—
এই থাম। দোস্ত! চোদ্দ পুরুষের দোস্ত আমার—খিঁচিয়ে ওঠে লোকটা।
শীর্ণ লোহার মত বাঁকানো ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে লোকটা ছট্টুর ডান হাতের কজিটা চেপে ধরে, চল আমার সঙ্গে। সত্যি কথা বলবি তো ছেড়ে দেব–নইলে ছাড়ছি না।
টানতে টানতে অন্ধকারে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লোকটা ছট্টুকে নিয়ে চলে। এতটুকু প্রতিবাদ করবারও সাহস পায় না ছট্টু! আট-দশ মিনিট প্রায় অন্ধকারে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টানতে টানতে একটা ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে এসে থামল।
দাঁড়া, পালাবার চেষ্টা করছিস কি মরবি!
ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল। লোকটা কোমর থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুললে।
ছট্টু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তখন।
ঘন অন্ধকার বনজঙ্গল, বিশেষ করে অপরিচিত জায়গা, ছুটে পালাবারও উপায় নেই।
ডান হাতের কজিটা ব্যথায় টনটন করছে। ঘরের এক কোণে একটা প্রদীপ জ্বলছে। লোকটা এবারে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ভিতরে আয়।
অজগরের চোখের সামনে বন্য জন্তুর যে অবস্থা হয়, ছট্টুরও সেই অবস্থা। সুড়সুড়ি করে একান্ত বাধের মত এক পা এক পা করে ছট্টু ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
বোস।
০৯. সুজাতা ও বিনয় বসেছিল
সুজাতা ও বিনয় বসেছিল।
সামান্য ব্যবধান দুজনের মধ্যে। দুজনের মধ্যখানে মাত্র ছোট একটা বেতের টেবিল। টেবিলের ওপরে কাচের টিপটটার মধ্যে হয়ত খানিকটা ঠাণ্ড চায়ের তলানি ও ভিজে নিংড়ানো কতকগুলো চায়ের পাতা। গোটাতিনেক চায়ের তলানি সমেত চায়ের কাপ। সন্ট্যাণ্ডের ওপরে জ্বলছে ছোট টেবিলল্যাম্পটা।
রাগ করেছে সুজাতা। নিশ্চয়ই রাগ করেছে, যদিও সেই রাগের সঙ্গে মিশে আছে একটা উগ্র অভিমান। রাগ আর অভিমানের মেশামেশিতে মুখখানা একটু গভীরই মনে হচ্ছে সুজাতার। ঠোঁটের কোণে বিনয়ের বঙ্কিম একটা চাপা হাসির নিঃশব্দ প্রকাশ।
রাগ আর অভিমান যাই হোক, বিনয় জানে সুজাতা এখন চট্ করে উঠে যাবে না। মান ভাঙিয়ে কথা বলবার একটা অবকাশ দিচ্ছে সুজাতা বিনয়কে। সত্যিই তো, সুজাতা যে ওদের সঙ্গে বহরমপুর এসেছে সে তো ওরই সঙ্গ-আকর্ষণে। বিনয়ের সান্নিধ্যকে একটু ঘনিষ্ঠ, আরো একটু নিবিড় করে পেতেই। নয় কি! সেই বিনয়ই যদি তাকে অবহেলা জানায়, রাগ-অভিমান হয় বৈকি। না, সুজাতার দোষ নেই।
বিনয় এবারে আপন মনেই সুস্পষ্টভাবে হাসল, তবে নিঃশব্দেই।
তারপর শ্ৰীমতী কোকিললাঞ্ছিতা!
কিন্ত নতুন নামকরণেও সুজাতা ফিরে তাকায় না। যেমন নিঃশব্দে বসে ছিল বসে রইল।
শ্ৰীমতী কৃষ্ণা-শোন শ্ৰীমতী কালোজিরে, রাগ করে যদি কথাই না বলো তো আজ দুপুরে যা সব অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে কিছুই শোনা হবে না কিন্তু!
কে শুনতে চায়! গোড়া কেটে আগায় জল না ঢাললেও চলবে।
তা চলবে না বটে, তবে ঐ যে বললাম অত্যাশ্চর্য ঘটনা শোনা হবে না!
এবার ঘুরে মুখোমুখি বসল সুজাতা। বোঝা গেল মুখে না বললেও মনে মনে সুজাতা বিনয়ের কথা শোনার জন্য উদ্গ্ৰীব ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
কি, বলব না বলব না!
কে বারণ করেছে বলতে!
শুনব বলেও তো কেউ সাড়া দিচ্ছে না!
ভণিতা না করে বলে ফেললেই তো হয়। কালা তো নাই যে শুনতে পাব না।
তা নয় বটে, তবে কানের সঙ্গে মনের একটা যোগাযোগ আছে কিনা। কথাগুলো বলে একান্ত নিম্পূহভাবে বিনয় সিগারেট-কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হয়ে উঠে। বিনয় আবার হাসে।
এবারে সুজাতাই তাগাদা দেয়, কই বললে না কি বলবে বলছিলে!
বিনয় আর বিলম্ব না করে দ্বিপ্রহরের তার সমস্ত অভিযান-কাহিনী যতটা সম্ভব সুষ্ঠভাবে বর্ণনা করে যায়। কোন কিছুই বাদ দেয় না।
লোকটা কে বলে তোমার মনে হয়! সুজাতা প্রশ্ন করে।
সেই থেকে তো সেই শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত মুখখানার কথাই ভাবছি। কে হতে পারেন। তিনি! বুঝতে পারছি না এখনো।
বাবাকে বললে না তো কিছু? না, বলিনি। ব্যাপারটা আগে ভাল করে খোঁজ না নিয়ে জানাজানি বা হৈচৈ করতে চাই না।