বিদায় যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে চলল।
কিন্তু চকিতে দেখা ক্ষণপূর্বের সেই দাঁড়িগোফ-ভরা মুখখানা কেবলই মনের মধ্যে এসে উঁকি দিতে লাগল বারংবার যেন।
কে লোকটা?
এই নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ দিঘীর ধারে কে লোকটা।
বিনয়কে দেখে হঠাৎ অমন করে অদৃশ্য হলই বা কেন? বিনয়কে হয় সে লক্ষ্য করছিল। আড়ালে থেকে, হঠাৎ চোখচোখি হয়ে গিয়েছে।
বিনয় পথ চলে। কিন্তু তার মনের মধ্যে অহেতুক একটা অসোয়াপ্তি তাকে যেন পীড়ন করতে থাকে।
মাঝের মহলের দোতলায় খান-দুই ঘর ওদের থাকবার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া হয়েছিল। এবং মাঝের মহলে যেতে হলে ‘কেয়ারটেকার’ মনোহরের এলাকা পার হয়ে যেতে হয়।
সিঁড়ির কাছেই মনোহরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বিনয়ের। মনোহর গোটা দুই হ্যারিকেন জ্বেলে উপর উঠছিলো।
বিনয়কে দেখে মনোহর প্রশ্ন করে, এই যে দাদাবাবু! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? বড়বাবু আপনাকে খুঁজছিলেন!
বড়বাবু, দিদিমণি এঁরা সব কোথায় মনোহর?
উপরের দালনে বসে চা খাচ্ছেন।
বিনয় মনোহরের আগে-আগেই অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।
প্রকাণ্ড টানা বারান্দার একাংশে ছোট একটি বেতের টেবিলের দু’পাশে বসে সুজাতা ও বামদেব চা পান করছিলেন।
পাশেই আর একটা চেয়ার বোধ হয় বিনয়ের জন্যই খালি পড়ে ছিল। টেবিলের পাশেই একটা স্ট্যাণ্ডের উপরে একটি প্রজ্বলিত টেবিলল্যাম্প। জায়গাটায় একটা অস্পষ্ট আলোছায়া।
বিনয়ের পদশব্দে বামদেব ও সুজাতা দুজনেই এককসঙ্গে ফিরে তাকায়।
এই যে বিনয়, সারাদিন কোথায় ছিলে?
বিনয় খালি চেয়ারটার ওপরে গা ঢেলে দিয়ে বসতে বসতে বললে, আপনার রত্নমঞ্জিল সারভে করছিলাম মেসোমশাই।
সুজাতা কোন কথা না বলে ততক্ষণে বিনয়ের জন্য চায়ের কাপে চা ঢেলে চামচটা দিয়ে চিনি ও দুধ মেশাচ্ছিল। সে কেবল আড়চোখে বিনয়ের মুখের দিকে তাকাল।
বামদেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, এখানকার বনজঙ্গলে শুনছি। নানা বিষধর সাপ আছে বিনয়। একটু সাবধানে চলাফেরা করো। বরং একা একা না ঘোরাফেরা করে মানোহরকে সঙ্গে নিও। এখানকার সব কিছু ও জানে।
মনোহর দুইহাতে দুটো জ্বলন্ত লণ্ঠন নিয়ে ততক্ষণে উপরে উঠে এসেছে।
বামদেবের কথাগুলো তার কানেও প্রবেশ করেছিল। সে বললে, হ্যাঁ দাদাবাবু, এখানে সাপের ভারি উপদ্রব।
বিনয় তৈরী চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে গরম চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আরামসূচক একটা শব্দ করে বললে, সাপের ভয় থাকুক। আর যাই থাকুক মেসোমশাই—
আপনার রত্নমঞ্জিলের উপরে কিন্তু ভারি একটা মায়া পড়ে গিয়েছে আমার।
বামদেব হাসতে হাসতে বললেন, কেন হে, এই পুরনো ভাঙা বাড়ির মধ্যে এমন কি পেলে?
আছে মেসোমশাই আছে, আমার মন বলছে আছে, নচেৎ–
বল কি বলছিলে!
নচেৎ ঐ ঝানু গুজরাটী ব্যবসাদার এই ভাঙা বাড়িটা কিনবার জন্য অমন করে হন্যে হয়ে আপনার পেছনে ছুটে বেড়াত না।
কি জানি বাবা, আমার তো মনে হচ্ছে মিথ্যে এ-বাড়িটা নিয়ে একটা সোরগোল করা হচ্ছে। জবাব দেন। বামদেব।
বেশ তাই যদি হবে, তাহলে ঐ চিঠিটারই বা কি অর্থ বলুন আর আপনার কলকাতার বাড়িতে আমন চোরের উপদ্ৰবই বা কেন ইদানীং হচ্ছিল?
বামদেব বললেন, চোরের উপদ্রবের চাইতেও ঐ চিঠিটাই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করছে। বেশী।
কিন্তু গণ্ডগোল কি কেবল ঐ বেনামা চিঠিটাই সৃষ্টি করেছে মেসোমশাই, আপনার পূর্বপুরুষের সেই সোনার কঙ্কন!
তুমি কি সত্যিই মনে কর বিনয়, এই রাতত্বমঞ্জিলের সঙ্গে ঐ সোনার কঙ্কনের কোন যোগাযোগ আছে?
বিনয় এবারে হাসতে হাসতে জবাব দেয়, আমি কেন কিরীটীবাবুও তো সেই রকম সন্দেহ করছেন!
সুজাতা এবারে আলোচনার মাঝখানে বাধা দিল, কি হয়েছে তোমাদের বাবা বল তো? কেবল রত্নমঞ্জিল আর সুবর্ণ কঙ্কন! ঐ কথা ছাড়া কি তোমাদের আর কথা নেই?
বিনয় বুঝতে পারে সুজাতা চটেছে। তা চটবারই তো কথা। এখানে এসে পৌঁছনো অবধি সে রত্নমঞ্জিল নিয়েই ব্যস্ত সারাক্ষণ।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর যখন বের হচ্ছিল সুজাতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, কোথায় যােচ্ছ বিনয়, বলেছিল সুজাতা।
যেখানেই যাই না কেন, কালোজিরে যাচ্ছে না!
নাকুর সঙ্গে যাচ্ছে কে! যেতে হয় একা যাব।
তাই যেও।
যাবই তো। একশবার যাব। মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল সুজাতা।
একা একা মজাসে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াব, কোথাও কালোজিরেকে সঙ্গে নেবো না। বলেই বিনয় এগিয়ে যায়।—চললুম।
বিনয় বুঝতে পারে সেই দ্বিপ্রহরের জের এখন ফের শুরু হবে।
টেবিলের একপাশে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা ছিল, সেটা হাতে করে বামদেব ঘরে চলে গেলেন।
বিনয় আর সুজাতা বসে রইল।
অন্য সময় হলে বিনয় এই সুযোগে সুজাতার অভিমান ভাঙাবার জন্য তৎপর হত, কিন্তু আজ তার মন ঐ মুহুর্তে অন্য চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল।
সে ভাবছিল দিঘীর ধারে ঘনায়মান বিকেলে আবছায়ায় দেখা সেই অদ্ভুত দাড়িগোঁফাওলা লোকটার কথাই। লোকটা কে? হঠাৎ তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় আমন করে পালিয়েই বা গেল কেন?
ছট্টলাল বহরমপুরে পরের দিনই এসে পৌঁছয়। যে কাজের ভার নিয়ে সে বহরমপুরে এসেছে সে-সব কাজে চিরদিনই সে পোক্ত। কারণ গত দশ বছর ধরে ঐ ধরনের কাজের দ্বারাই সে জীবিকানির্বাহ করে আসছে।
প্রথম একটা দিন ছট্টুলাল রত্নমঞ্জিলের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াল। কিন্তু বাইরে থেকে রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে কোন ধারণা করা সম্ভবপর হল না তার পক্ষে।
চট্ করে রত্নমঞ্জিলের মধ্যে ঢুকতেও সাহস হয় না।