কিন্তু বায়না যে নেওয়া হয়ে গিয়েছে মা—
তাতে কি, ফেরত দিয়ে দাও! বায়না নিয়েছ তো কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে! বলবে ভেবেছিলাম বিক্রি করব কিন্তু ভেবে দেখলাম বিক্রি করতে পারছি না, ব্যাস!
বামদেব হাসলেন, পাগলী!
বারন্দায় একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে বামদেব ও তাঁর মেয়ে সুজাতা রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যখন কথাবার্তা বলছিল, বিনয় সেই সময় একা একা ঘুরে ঘুরে বাড়ির চারপাশ দেখছিল।
কিছুদিন ধরে বাড়িটার বিক্রয়-ব্যাপার নিয়ে যে সব ঘটনাগুলো ঘটেছে, বিনয়কে সেটা বেশ খানিকটা উত্তেজিত করে তুলেছিল। নিঃসন্দেহে এবং বহরমপুর পৌঁছে রত্নমঞ্জিলে পদার্পণ করবার পর থেকে কেমন যেন তার বার বার মনে হচ্ছিল, কোনক্রমেই এই রত্নমঞ্জিল বিক্রয় করা চলতে পারে না। টাকাই সব ক্ষেত্রে বড় কথা নয়, মানুষের সেন্টিমেন্টেরও একটা মূল্য আছে বৈকি।
পূর্ব ব্যবস্থামত ওদের সঙ্গে বহরমপুরে আসতে পারেনি। কিরীটী হঠাৎ শেষ মুহুর্তে বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়ায় ওদের সঙ্গ নিতে পারেনি। তবে বলেছে। দু-চারদিনের মধ্যেই আসছে।
এখানে আসবার পূর্বে বিনয় কিরীটীর সঙ্গে দেখা করেছিল। সেই রাত্ৰেই। কিরীটী বলে দিয়েছে বিশেষ করে কয়েকটি কথা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে-দিনে বা রাত্রে সর্বদা যেন তারা বিশেষ সাবধানে থাকে।
বিনয় শুধিয়েছিল, কেন বলুন তো? আপনি কি মনে করেন আমাদের আচমকা কোন বিপদ-আপদ ঘটতে পারে। সেখানে?
ঘটলে আশ্চর্য হবেন না বিনয়বাবু!
কিরীটীর সাবধান-বাণী বিনয় তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু এখানে পৌঁছাবার পর ও বাড়িটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মনের মধ্যে তার ঠিক শঙ্কা না হলেও কেমন একটা অসোয়াস্তি অনুভব করে যেন সে।
০৮. পুরাতন নবাবী আমলের বাড়ি
পুরাতন নবাবী আমলের বাড়ি।
বাড়িটার গঠন-কৌশলের মধ্যেও সেই নবাব আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় যেন। বহুদিনের সংস্কারের অভাবে বাড়িটা জীৰ্ণ হয়ে গেলেও, এর যা কাঠামো তাতে মনে হয় আরো ৬০-৭০ বৎসর অনায়াসেই এমনি দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রায় চোদ্দ কাঠা জায়গার উপরে বাড়িটা। সামনে ও পিছনে যে জায়গা আছে তাও প্রায় বিঘাঘানেক তো হবেই। বাড়িটা দোতলা এবং সর্বসমেত তিনটি মহলে ভাগ করা যায়।
নবাব আমলে অধিকারী বংশ ধন, প্রতাপ, শৌর্য ও পদমর্যাদায় যখন জমজমাটি ছিল, এই রত্নমঞ্জিল হয়ত মানুষজনের কোলাহলে তখন গমগম করত।
এখানো রত্নমঞ্জিলের বহিরাংশে জীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ হাতীশালা ঘোড়াশালা, নাটমন্দির, পাইক-পেয়াদাদের মহল একদা সেই অতীত শৌর্যেরই সাক্ষ্য দেয়।
বাইরের মহলেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিনয়।
চারিদিকে জঙ্গল ও আগাছা। প্রকাণ্ড নাটমন্দিরটার প্রশস্ত চত্বরের চারিদিকে সুউচ্চ বড় বড় থাম, শীর্ষে শীর্ষে কারুকার্য। সুউচ্চ খিলানের মাথায় কবুতর বাসা বেঁধেছে, নির্বিবাদে বংশবৃদ্ধি করছে।
মধ্যাহ্নশেষের নিস্তব্ধ নির্জনতায় কবুতরের কুজন চলেছে। মেঝেতে ধরেছে দীর্ঘ সর্পিল ফাটল।
শীতের সূর্য প্রায় অস্তগমনোন্মুখ। শেষ আলোর স্নান রশ্মি গম্বুজ-শীর্ষে শীর্ষে অস্ত পরশটুকু বুলিয়ে যাচ্ছে।
নাটমন্দিরের পাশ দিয়ে একটু সরু পায়ে-চলা পথ, দু’পাশে আগাছা জন্মে পথটাকে প্রায়। ঢেকে দেবার যোগাড় করেছে। সেই পথ ধরে বিনয় আরো পিছনে এগিয়ে যায়।
পথটা এসে শেষ হয়েছে একটা দিঘীর সামনে।
প্রশস্ত বাঁধানো রানা। কিন্তু তাতেও ফাটল ধরেছে, জন্মেছে আগাছা।
অতীতের ধ্বংসে জীর্ণ অবশেষ। ক্লান্ত বিনয় দিঘীর ভগ্ন রানার উপরেই বসে পড়ল।
দিঘীর চারপাশে অজস্র গাছপালা হুমড়ি খেয়ে যেন দিঘীর বুকের ওপরে পড়েছে, দিঘীর কালো জলে তারই ছায়া স্তুপ বেঁধে আছে।
দিঘীর নোংরা জল দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন এদিকে মানুষের হাতের স্পর্শ পড়েনি অবহেলিত পরিত্যক্ত।
সর্বত্ৰ যেন অযত্ন ও অবহেলা।
অন্যমনস্কভাবে বিনয় কতক্ষণ ভগ্ন রানার উপরে বসে ছিল মনে নেই, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট খসি খসি শব্দে চমকে পাশে তাকাল।
রানার ওপরে বিনয় যেখানে বসে ছিল তার প্রায় হাত দশেক তফাতে দিঘীর ঢালু পাড় ও ঘন জঙ্গলের সামনে প্রদোষের স্নান আলোয় দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় এক পুরুষ।
মাথায় বঁকড়া বঁকড়া চুল, মুখভর্তি দাড়ি-পরিধানে ধুতি, গায়ে একটা ধূসর রঙের চাদর।
বড় বড় দুটো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিনয়ের প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। চক্ষু তো নয়, যেন। অন্তর্ভেদীদুটো জ্বলন্ত পাথর।
লোকটার সঙ্গে চোখাচৌখি হতেই চক্ষের পলকে লোকটা পিছনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। একটা দুঃস্বপ্ন যেন মিলিয়ে গেল।
বিনয় প্রথমটায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা সত্যি না তার দেখবারও ভুল বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু লোকটা পশ্চাতের ঘন জঙ্গলের মধ্যে চকিতে অন্তৰ্হিত হলেও তখনও সেখানকার গাছপালাগুলো দুলছিল।
গাছপালাগুলোর মধ্যে একটা আলোড়ন জাগিয়ে যে লোকটা অন্তৰ্হিত হয়েছে ক্ষণপূর্বে, দোদুল্যমান গাছপালাগুলোই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। স্বপ্ন নয়, দেখারও ভুল নয়।
বিনয় একবার ভাবলে এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা অনুসন্ধান করে দেখে কিন্তু ঠিক সাহস হলো না, কারণ চারিদিকে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
একাকী এই অচেনা জায়গায় ঐ রকম একটা লোককে অনুসরণ করাটা মনে হল ঠিক বিবেচনার কাজ হবে না। বরং কাল সকালে কোন এক সময় দিনের আলোয় এসে ঐ জায়গাটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। এখন ফিরে যাওয়াই সমীচীন হবে।